ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

প্রযুক্তি

মেটাভার্স: মহাবিশ্বের নতুন রূপকল্প  

মেটাভার্স: মহাবিশ্বের নতুন রূপকল্প  

রাশেদ মেহেদী 

প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০২২ | ০২:৫৩

ফেসবুক ইনকরপোরেশনের নাম 'মেটাভার্স'-এ পরিবর্তন সাদা চোখে গুরুত্বপূর্ণ নাও মনে হতে পারে। নাম তো অনেক কিছুরই বদলায়। ২০১৫ সালে গুগল এলএলসি বদলে হয়ে গিয়েছিল অ্যালফাবেট। বাংলাদেশেও মোবাইল ফোন অপারেটর 'সেবা' বদলে হয়েছে বাংলালিংক। 'একটেল' হয়েছে রবি।

মেটাভার্স একটু অন্যরকম। এখানে বাস্তব দুনিয়ায় বসে ভার্চুয়াল চশমায় নতুন মহাবিশ্ব দেখার রোমাঞ্চ আছে। সেই রোমাঞ্চের সন্ধান কিন্তু ফেসবুকের মার্ক জাকারবার্গ প্রথম দেখাননি। মার্কিন লেখক নিল স্টিফেনসন ১৯৯২ সালে 'স্নো ক্র্যাশ' নামে একটি উপন্যাস লিখে পশ্চিমের দুনিয়ায় হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন। 'স্নো ক্র্যাশ' মূলত ছিল বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি। আরও স্পষ্ট করে বললে 'সাইবার পাঙ্ক'। সেখানে লস অ্যাঞ্জেলেসের একুশ শতকের এক কল্পিত অবস্থার বর্ণনা দিয়েছিলেন লেখক। যেখানে পিজা ডেলিভারির বক্সে লাগানো থাকে মাইক্রোচিপ, কুরিয়ার সার্ভিসের লোকজন ব্যবহার করেন স্কেটবোর্ড, সেখানেও নিয়ন্ত্রক মাইক্রোচিপ। পিজা ডেলিভারি বয় হিরো তার গল্পটা বলতে থাকেন। তিনি তার বন্ধুদের নিয়ে ভার্চুয়াল ইউনিভার্স তৈরি করেন, যার নাম দেন মেটাভার্স। এই যে আজকের ভার্চুয়াল চ্যাট রুমে আড্ডা, বৈঠক, গেমিং, কেনাকাটা- সবকিছুই ছিল সেই মেটাভার্সে। অথচ সেই ১৯৯২ সালে একুশ শতকের এই ভার্চুয়াল বিপ্লবের কথা চিন্তা করেছিলেন একজন লেখক। উনিশ শতকে বসে যেমন এইচজি ওয়েলস বা জুলভার্ন বিজ্ঞানের কল্পিত জগতে পাঠকদের নিয়ে যেতেন। পরে সেই কল্পিত জগতের অনেক কিছুই বিজ্ঞানের নতুন আবিস্কার হিসেবে সামনে আসে।

নিল স্টিফেনসনের 'স্নো ক্র্যাশ' উপন্যাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র লস অ্যাঞ্জেলেসের মাফিয়া আঙ্কেল এনজো সেই মেটাভার্সে এক বিপজ্জনক এক খেলায় মেতে ওঠেন। যেখানে মানুষের মস্তিস্কের দখল নেওয়ার জন্য বিশেষ একটি মাদক স্নো ক্র্যাশের ডিজিটাল রূপান্তরের জন্য গবেষণা শুরু করেন। একটি জৈব ভাইরাস ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কম্পিউটারে বিটম্যাপ পড়তে অভ্যস্ত হ্যাকারদের মগজের কোষে আঘাত করে নতুন ল্যাঙ্গুয়েজ ম্যাপ তৈরি করে। যার নাম 'লু লু লা লা'। ফলে ভাইরাসে সংক্রমিত ব্যক্তিটি বাস্তবের সবকিছু ভুলে অদ্ভুত এক পাগলে পরিণত হয়ে যায়। প্রথমদিকে বিটম্যাপ রিডার হ্যাকারদের আক্রমণ করলেও এটি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে। এসব মানুষ কি মাফিয়া বস আঙ্কেল এনজোর দাসে পরিণত হয়েছিল?

'স্নো ক্র্যাশ' প্রকাশের সময় ফেসবুকের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গের বয়স ৮। আর একটু বড় হয়ে কিশোর জুকারবার্গ নিশ্চয় উপন্যাসটা পড়েছিলেন। তার চোখের সামনে তখন মাইক্রোসফট, অ্যাপল, ইয়াহু এবং গুগলের যাত্রাপথে ভার্চুয়াল জগৎ ক্রমবিকাশমান। কিন্তু তখনও 'স্নো ক্র্যাশ'-এর ভার্চুয়াল ইউনিভার্স বা মেটাভার্সের যাত্রা শুরুর অনেকখানি বাকি ছিল। একটি ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে পুরো দুনিয়া শুধু নয়, একেবারে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে ধারণ করা। সেই কাজটিই ১৭ বছরে এসে শুরু করতে পেরেছিলেন জুকারবার্গ ও তার বন্ধুরা।

আজকের মেটাভার্স কোম্পানি ধারণ করে আছে একই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম। ফেসবুকে আসলে কী নেই? আপনার নিজের পরিচয়ের সব তথ্য, প্রতিদিনের যাপিত জীবনের চিত্র তো আছেই। সুঃখ-দুঃখ শেয়ার করছি টাইমলাইনে, কথা বলছি মেসেঞ্জারে। ব্যবসা করছি, তাও ফেসবুকে। ফেসবুকে ছবি শেয়ার করে তৃপ্তি না পেলে ইনস্টাগ্রাম আছে; একেবারে জীবন্ত রূপ। এর বাইরে হাতে থাকে স্মার্টফোন, যেটা যুক্ত একটি নম্বর দিয়ে মোবাইল নেটওয়ার্কে। সেই নম্বরটিইবা মেটাভার্সের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না কেন? অতএব ব্যবহার করতেই হবে হোয়াটসঅ্যাপ। পুরো দুনিয়ায় মুহূর্তে কল করার স্বাধীনতা এমন যত্ন করে আর কোনো অ্যাপ দেয়?

ভবিষ্যতে মেটাভার্সের পরিসর আরও বিস্তৃত হবে, সেটা বলাই বাহুল্য। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে ফেসবুকের একক নিয়ন্ত্রণের বাইরে আর যা থাকে, তা হচ্ছে সার্চ ইঞ্জিন গুগল এবং অ্যামাজনের ক্লাউড সার্ভিস আর ই-কমার্স। এ দুটি সার্ভিসও জাকারবার্গের মেটাভার্সের নানাভাবে অংশীদার। আর কিছুদিন গুগল, অ্যামাজন সরাসরি মেটাভার্সের সঙ্গে একীভূত হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এর পর ব্যবহারকারীর মস্তিস্কের কোষে 'স্নো ক্র্যাশ'-এর সেই ডিজিটাল ভাইরাসের রূপান্তরের জন্য নতুন কোনো ডিভাইস বা যন্ত্রের প্রয়োজন হবে না। যাপিত জীবনের প্রতিটি তথ্য, প্রতিটি পদক্ষেপ থাকবে মেটাভার্সের নিয়ন্ত্রণে। যে কোনো মুহূর্তেই ব্যবহারকারীর মস্তিস্কের কোষে পৌঁছে দেওয়া হবে রোমাঞ্চ, উত্তেজনা কিংবা নিয়ন্ত্রণের নতুন কোনো তত্ত্ব।

অবশ্য এখনই স্পষ্ট সেই ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি। শিক্ষিত মানুষ কিংবা নিরক্ষর মানুষ, বিজ্ঞান চর্চাকারী কিংবা কুসংস্কারে বিশ্বাসী- সবার সামনে আছে ফেসবুক ভিডিও আর ইউটিউব। দেখছেন এবং শুনছেন; সত্য না মিথ্যা যাচাই করার সময়ই পাচ্ছেন না। তার আগেই মস্তিস্কে ফেসবুক, ইউটিউবের 'কনটেন্ট' এতটাই দোলা দিচ্ছে যে, সম্মোহিত হয়ে পড়ছেন। ফেসবুক-ইউটিউবে কান চিলে নেওয়ার কথা বললে কানে হাত দিয়ে দেখার আগেই চিলের পেছনে ছুটতে শুরু করছেন। সেই ছোটা ব্যবহাকারীকে ক্লান্ত করছে, কখনও গভীর খাদে ফেলে দিচ্ছে। আইনি ব্যবস্থা নিয়ে, বিধিনিষেধ দিয়ে, কনটেন্ট সরিয়ে ফেলার আগেই 'ভাইরাল' হয়ে যাচ্ছে।

মনে হয়, হাতের মুঠোয় সবকিছু; আসলে কিছুই নেই। মস্তিস্কে রক্তপ্রবাহের মতোই প্রতিনিয়ত প্রবাহিত হচ্ছে ভার্চুয়াল দুনিয়ার অসংখ্য ডাটা। রক্তপ্রবাহের মতোই এই ডাটা প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলে জীবন অচল হয়ে যাবে। শুধু একটি দেশ নয়, বরং বিশ্বব্যবস্থা সংকটে পড়ে যাবে। এখন কোথাও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য আর কষ্ট করে, বিপুল ব্যয়ে যুদ্ধজাহাজ পাঠানোর দরকার নেই। আপনার কাছে যদি একটা দেশের মানুষের জীবন যাপন, আচরণ, অভ্যস্ততা, শিক্ষা-রুটি সংক্রান্ত বিষয়ে যথেষ্ট ডাটা থাকে এবং তা যদি বিশ্নেষণ করার মতো পর্যাপ্ত দক্ষতা থাকে; তাহলে যে কোনো মুহূর্তেই আক্রমণ করা যেতে পারে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম থেকে ড্রোনের মতো নিজের নিয়ন্ত্রিত ডাটা ছুড়ে দিয়েই।

কভিড-১৯ মহামারি ভার্চুয়াল ডাটানির্ভরতা অপরিহার্য করে তুলেছে। ভার্চুয়াল দুনিয়াটা আসলে ডাটার দুনিয়া। এখন ডাটা সোনা, রুপা, হিরের চেয়েও মূল্যবান। আর জাকারবার্গের মেটাভার্স হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ডাটা সম্ভার। বাস্তবের মহাবিশ্ব এখনও বড় রহস্য; মানুষের তৈরি মহাবিশ্বের নতুন রূপকল্প 'মেটাভাসর্'। এটা যে কোনো সময় ব্যবহারকারীকে বন্ধু, শত্রু কিংবা সম্মোহিত ক্রীতদাসে পরিণত করার সীমাহীন ক্ষমতা রাখে। আমরা কি প্রস্তুত?

রাশেদ মেহেদী: সাংবাদিক

আরও পড়ুন

×