দুদক কর্মকর্তার চাকরিচ্যুতি
দুর্নীতিবাজরা উৎসাহিত হবে

প্রতীকী ছবি
সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১৫:২৯
সরকারি, আধা-সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে কারণ দর্শাও, বিভাগীয় মামলা, সাময়িক বরখাস্ত, চাকরিচ্যুতির মতো ব্যবস্থা অস্বাভাবিক বা নজিরবিহীন নয়। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশন তথা দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় পটুয়াখালীর উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে বুধবার যেভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, তা স্বাভাবিক হতে পারে না। সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে শুক্রবার প্রকাশিত প্রতিবেদনসূত্রে জানা যাচ্ছে, গত কয়েক বছরে তিনি বড় ধরনের বেশকিছু দুর্নীতির ঘটনা তদন্ত করেছিলেন। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি দুর্নীতি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। যেমন তিনি ৫৫ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে জাতীয় পরিচয়পত্র তথা এনআইডি প্রদানের দুর্নীতির তদন্তের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের একজন পরিচালকসহ ৫০ জনকে আসামি করেছিলেন। সর্বশেষ কক্সবাজারে তিনটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরুতেই ভূমি অধিগ্রহণে বড় ধরনের দুর্নীতি ধরেছিলেন তিনি। স্থানীয় রাজনীতি ও প্রশাসনের বড় কর্তাদের অনেকের যোগসাজশে প্রায় ৮০ কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তের মাধ্যমে ধরেছিলেন। এসব কাজের জন্য যেখানে শরীফ উদ্দিন রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত হতে পারতেন, সেখানে নিজের প্রতিষ্ঠান থেকেই তাকে চাকরিচ্যুত হতে হলো! আমরা মনে করি, এই ঘটনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অভিযানের ক্ষেত্রে নেতিবাচক নজির হয়ে থাকবে এবং এতে দুর্নীতিবাজরাই উৎসাহিত হবে।
এটা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই যে, দুদকের এই উপসহকারী পরিচালক কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপের গায়ে কোপ দিয়েছিলেন। বিভিন্ন দুর্নীতির তদন্ত করতে গিয়ে তিনি যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন, তাদের অনেকেরই প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালী তো বটেই; তাদের খুঁটির জোরও নিঃসন্দেহে অনেক বেশি। আমরা প্রায়ই দেখে থাকি- মোটা অঙ্কের দুর্নীতির অর্থ কীভাবে ঘাটে ঘাটে বণ্টিত হয়। স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হওয়ায় তারা স্বভাবতই পর্দার অন্তরালে নানা খেলা খেলে থাকতে পারেন। বস্তুত কক্সবাজারে শরীফ উদ্দিনের সর্বশেষ উদ্ঘাটিত দুর্নীতির তদন্ত প্রতিবেদনও ইতোমধ্যে তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ 'প্রত্যাহার' করে নিয়েছে। আমরা দেখছি, গত বছর ৩০ জুন ওই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলেও দীর্ঘদিন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং তা বাতিল করে কথিত 'পুনর্তদন্ত' করা হয়েছে। অভিযুক্তরা উল্টো দুদকে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের স্তূপ তৈরি করেছে। ওই জুন মাসেই তাকে পটুয়াখালী বদলি করা হয়েছে। ৩০ জানুয়ারি ছুটিতে চট্টগ্রামের বাসায় এলে একটি গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় একজন নেতাকে সঙ্গে নিয়ে চাকরিচ্যুতির হুমকি দিয়ে এসেছেন। দুদকে তার 'জীবন নষ্ট' করে দেওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে এসেছেন। এর দুই সপ্তাহের মাথায় শরীফ উদ্দিনের চাকরিচ্যুতি কি সেই হুমকিরই বাস্তবায়ন? আমরা মনে করি, একজন সৎ ও যোগ্য কর্মকর্তার এমন পরিণতি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক।
আমরা দেখছি, দুদক কর্মচারী বিধিমালার যে ধারায় শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, তার ভাষ্য ও প্রয়োগ যথেষ্ট বিতর্কিত। এই ধারা অনুযায়ী কমিশন সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে তিন মাসের নোটিশ বা তিন মাসের বেতন দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে চাকরিচ্যুত করতে পারে। বাংলাদেশের আর্থ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় এর অপব্যবহারের আশঙ্কা অমূলক হতে পারে না। যে কারণে শরীফ উদ্দিনের পদচ্যুতির পর দুদকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা মানবন্ধন ও স্মারকলিপি পেশ করেছেন। লক্ষণীয়, এই ধারা সংযোজন করা হয় কথিত ওয়ান-ইলেভেনের অগণতান্ত্রিক সরকারের আমলে। গণতান্ত্রিক আমলে এসেও দুদক সেই ধারার অপব্যবহার করছে, মেনে নেওয়া কঠিন। আমরা মনে করি, সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে শরীফ উদ্দিনের বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত। এটা ঠিক, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, অভিযোগগুলো কারা দিয়েছে। অনেক অভিযোগের তদন্তে তিনি রেহাইও পেয়েছেন। কয়েকটি নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। এর মধ্যে বিনা নোটিশে চাকরিচ্যুতি 'জরুরি' হয়ে পড়ল কেন? দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান ও দক্ষতার জন্য যেখানে শরীফ উদ্দিন ও পরিবারের নিরাপত্তা বিধান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল; সেখানে তাকে জীবন ও জীবিকার ঝুঁকিতে ঠেলে দেওয়া হলো কাদের প্ররোচনায়? সুশাসন ও শৃঙ্খলার সামষ্টিক স্বার্থেই এর জবাব পেতে হবে।