কে হচ্ছেন মাউশির ডিজি?

.
সাব্বির নেওয়াজ
প্রকাশ: ০২ এপ্রিল ২০২৪ | ১৯:৫৯ | আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০২৪ | ২০:৩১
‘শিক্ষাভবন’ হিসেবে পরিচিত মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালকের পদ পেতে বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের সরকার সমর্থক কর্মকর্তাদের মধ্যে শুরু হয়েছে ব্যাপক দৌড়ঝাঁপ। বর্তমান মহাপরিচালক প্রফেসর নেহাল আহমেদের চাকরির মেয়াদ ঈদুল ফিতরের ছুটির মধ্যে আগামী ১৩ এপ্রিল শেষ হয়ে যাচ্ছে। তবে ঈদের সরকারি ছুটির কারণে আগামী ৯ এপ্রিলই মূলত তার শেষ কর্মদিবস।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত কয়েকদিনে এ পদের নিয়োগের জন্য আগ্রহীদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত। এ পদের জন্য এখন চলছে ব্যাপক লবিং। রাজনৈতিক আনুকূল্য পেতে চলছে বিভিন্ন পর্যায়ে দেন-দরবার। কেউ কেউ ছাত্রজীবনে সরকার সমর্থক রাজনীতির অভিজ্ঞতার প্রমাণ ও পারিবারিক সংশ্লিষ্টতাও তুলে ধরছেন সরকারের নীতিনির্ধারকদের মাঝে। শিক্ষাপ্রশাসনে জোর আলোচনা রয়েছে, বর্তমান মহাপরিচালক প্রফেসর নেহাল আহমেদ এক বছরের জন্য এ পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন। তবে তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত নয়। যে কারণে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের শীর্ষ এ পদের দাবিদার অন্যরাও তদবিরে পিছিয়ে পড়তে রাজি নন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মাউশি মহাপরিচালকের পদটি গ্রেড-১ (সচিব) পদমর্যাদার। অতীতে অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন ছাড়া বাকিরা সবাই অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদা নিয়ে অবসরে গেছেন। এটি বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ। মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে পদটি খুবই আকর্ষণীয় বলে শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কাছে বিবেচিত হয়। এ পদে নিয়োগের জন্য সরকারপ্রধানের অনুমোদন প্রয়োজন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন সাপেক্ষে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এ পদে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়ে থাকে। নিয়মানুসারে, শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যদের মধ্যে থেকে চাকরির জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে ডিজি নিয়োগের কথা থাকলেও গত ২৫-৩০ বছর ধরে রাজনৈতিক বিবেচনায়ই এ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষাভবন হিসেবে খ্যাত মাউশি রীতিমতো অবৈধ টাকার খনি। এখানে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ বহু পুরোনো।
সূত্রমতে, বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির কাজ সম্পাদন করে থাকে এ প্রতিষ্ঠানের আঞ্চলিক কার্যালয়গুলো। এছাড়া বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের ১৫ হাজার কর্মকর্তার নিয়োগ-বদলি-পদোন্নতি, টাইম স্কেল, বৈদেশিক প্রশিক্ষণ ও শিক্ষাবোর্ডসহ সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে প্রেষণে নিয়োগ দেওয়ার জন্য কর্মকর্তা বাছাইয়ের দায়িত্ব মাউশির ওপরে। পাশাপাশি সারাদেশের সাড়ে ছয় হাজার বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষকদের নিয়োগ, এমপিওভুক্তি, টাইম স্কেলসহ সবকিছু নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা এ কার্যালয়ের। স্বাভাবিকভাবেই এ প্রতিষ্ঠানের ডিজি পদে নিয়োগ পেতে সরকার সমর্থক শিক্ষকরা ব্যাপক লবিংয়ে নেমেছেন। গত কয়েকদিনে এ পদের জন্য রাজনৈতিক তদবির বেশ জোরালো হয়েছে।
শিক্ষাখাতের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, অসংখ্য পদপ্রত্যাশীদের মধ্য থেকে এ পদের জন্য ঘুরেফিরে বর্তমান ডিজিসহ পাঁচজনের নাম শিক্ষা প্রশাসনে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে। পদপ্রত্যাশীরা নানাভাবে জানার চেষ্টা করছেন, এ পদে নিয়োগের জন্য কাদের নাম তালিকা আকারে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যারা এ পদে আলোচনায় আছেন তারা হলেন, বর্তমান মহাপরিচালক প্রফেসর নেহাল আহমেদ (চুক্তিভিত্তিতে), মাউশির পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) প্রফেসর শাহেদুল খবির চৌধুরী, মাউশি পরিচালক (মাধ্যমিক) সৈয়দ জাফর আলী, মাউশির অপর পরিচালক (প্রশিক্ষণ) প্রফেসর ড. প্রবীর কুমার ভট্টাচার্য্য, ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর তপন কুমার সরকার এবং বরিশাল বিএম কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. আমিনুল হক। এর বাইরেও বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের আরও কিছু জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক এ পদের অন্যতম প্রত্যাশী হলেও তারা সেভাবে আলোচনায় নেই।
জানা গেছে, নানাভাবে আলোচনায় আসা পাঁচজনের চারজনই রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী প্রার্থী। প্রফেসর নেহাল আহমেদ পারিবারিকভাবেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সততা এবং প্রশাসনিকভাবে তার দক্ষতার সুনাম রয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন রাজধানীর ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবেও তার সাফল্য রয়েছে। সাবেক একজন রাষ্ট্রপতির আপন ভাগিনা।
অধ্যাপক নেহাল আহমেদ ২০২২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মাউশিতে মহাপরিচালক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯৩ সালের ২৭ নভেম্বর ১৪তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারে প্রভাষক পদে নিয়োগ পেয়ে লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজে যোগদান করেন। চাকরি জীবনে তিনি লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ, ধামরাই সরকারি কলেজ, জগন্নাথ কলেজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি মহিলা কলেজ, সরকারি ভিকু মেমোরিয়াল কলেজ, শহীদ স্মৃতি সরকারি কলেজসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করেন। তিনি সর্বশেষ ঢাকা কলেজে ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন।
মাউশির পরিচালক শাহেদুল খবির চৌধুরী ১৪তম বিসিএসের অর্থনীতির অধ্যাপক। তিনি ২০০৯ সাল থেকে ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের বিভিন্ন পদে এবং ২০১৯ সালের ২৪ মার্চ থেকে বর্তমান পদে বহাল আছেন। তিনি বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাড়ি হওয়ায় তিনি বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীর আনুকূল্য পেতে চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে।
অধ্যাপক সৈয়দ জাফর আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা। তাঁর বাড়ি বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলে। তিনি ১৭তম বিসিএসের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক। স্বাধীনতা বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সংসদের তিনি সাধারণ সম্পাদক। সদালাপী ও সজ্জন হিসেবে শিক্ষাপ্রশাসনে পরিচিতি সৈয়দ জাফর আলীও প্রশাসনিকভাবে অভিজ্ঞ ও দক্ষ। এর আগে তিনি মাউশির প্রশাসন শাখার সহকারী পরিচালক, পরিদর্শন ও নীরিক্ষা অধিদপ্তরে (ডিআইএ) উপ-পরিচালক এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডেও (এনসিটিবি) কাজ করেছেন। একাধিক সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রভাবশালী একজন মন্ত্রীর আশীর্বাদ রয়েছে তার ওপরে। সৈয়দ জাফর সমকালকে জানান, তিনি সদ্য বর্তমান পদে এসেছেন। ডিজি হতে তিনি কোনো তদবির করছেন না।
শিক্ষা ক্যাডারের সূত্রগুলো জানায়, অধ্যাপক ড. প্রবীর কুমার ভট্টাচার্য্যেরও প্রশাসনিকভাবে দক্ষতার সুনাম রয়েছে। তিনি এর আগে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) উপ-পরিচালক এবং মাউশির সরকারি কলেজ শাখার উপ-পরিচালক ছিলেন। তিনি ১৪তম বিসিএসের গণিত বিষয়ের অধ্যাপক। তিনিও ফরিদপুরের বাসিন্দা। জানা গেছে, ফরিদপুর অঞ্চলের একজন মন্ত্রীর আশীর্বাদ রয়েছে তার ওপরে। সমকালের সঙ্গে আলাপকালে প্রবীর কুমার ভট্টাচার্য্য জানান, তিনি কোনো চেষ্টা-তদবির করছেন না।
ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকারও ১৪তম বিসিএস এর শিক্ষা ক্যাডারের সদস্য। ঢাকা বোর্ড তিনি সফলতার সঙ্গেই চালাচ্ছেন। তিনি বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ের প্রভাষক পদে ১৯৯৩ সালে ঝালকাঠি সরকারি কলেজে যোগ দেন। সেখান থেকে নরসিংদী সরকারি কলেজ, ২০০১ সালে সহকারী অধ্যাপক পদে ভোলা সরকারি মহিলা কলেজে, টংগী সরকারি কলেজ এবং ২০০৯ সালে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পদে যোগ দেন। ২০১০ সালে তিনি সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান। ২০১৬ সালে একই বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব পান। ২০১৮ সালে তিনি অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। ২০১৯ সালে তিনি ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সচিব নিযুক্ত হন ও ২০২২ সালের ১৬ মে বর্তমান পদে যোগ দেন।
জানা গেছে, বরিশাল বিএম কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. আমিনুল হক গত ৭ মার্চ বরিশাল বিএম কলেজে যোগ দেন। এর আগে তিনি কুষ্টিয়া সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনিও ১৪তম বিসিএস কর্মকর্তা। তার বাড়ি পাবনায়, বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের বাড়ির সঙ্গে। আগামী ডিসেম্বরে তিনি পিআরএল এ যাবেন। বরিশালে তিনি যোগদান করেছেন বর্তমান মেয়র আবুল খায়ের আবদুল্লাহর আগ্রহে। তার ওপরে বাগেরহাটের এমপি শেখ হেলালের সমর্থন ও আশীর্বাদ আছে বলে প্রচার আছে।
ডিজি নিয়োগের ব্যাপারে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান সমকালকে বলেন, মাউশির ডিজি পদ একটি অত্যন্ত সম্মানজনক এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার নীতিনির্ধারণী পদ। এ পদে সরকার যোগ্য লোককেই নিয়োগ দেবে। সরকার শিগগিরই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।