ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

এক পৃথিবী বিস্ময়

এক পৃথিবী বিস্ময়

মোহাম্মদ ইউনুস

প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২৪ | ০২:১৫

মা মানে অন্য এক পৃথিবী, মা মানে স্বাধীনতা। মা আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তিত্ত্ব। তিনি প্রয়াত হয়েছেন ২০১৩ সালে, ঘরে বাহিরে তিনি ছিলেন অত্যন্ত নরম প্রকৃতির, বুদ্ধিদীপ্ত, ঠান্ডা মেজাজের এবং বন্ধুসুলভ একজন মানুষ। ছোটবেলা থেকেই ডানপিটে থাকলেও তাঁর ছায়াতলে আমি বেড়ে উঠেছি অত্যন্ত আদর সোহাগের সাথে। তাছাড়া বড় ছেলে হিসেবে সকল ক্ষেত্রেই বাড়তি স্নেহ, মায়া, মমতা ও ভালোবাসার পাত্র তো ছিলামই। ছোটবেলা থেকেই মায়ের সাথে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। মায়ের সুমধুর কণ্ঠে কোরআন তেলাওয়াত আজও কানে ভাসে। ভোর বেলায় ঘুম থেকে তুলে দিয়ে আমাদের ছয় ভাইবোনকে পাঠিয়ে দিতেন প্রাতঃভ্রমণে। তাঁর কথায় শরীর ঠিক থাকলে মন ভালো থাকে। 
তাঁর হাতের রান্না ভোলার নয়, বিশেষ করে কোরবানির ঈদের ঝুরা মাংস, গরুর কালিয়া, আর মগজ ভাজির সাথে হাতে বানানো চালের আটার রুটি এখনও জিভে লেগে আছে। আমরা ভাইবোনেরা না খাওয়া পর্যন্ত তিনি কখনও মুখে খাবার নিতেন না। পড়াশোনার ব্যাপারে কখনও চাপ প্রয়োগ করতেন না। স্কুল ছুটি হলেই বায়না ধরতাম মা কখন নানাবাড়িতে নিয়ে যাবে। নানাবাড়ি মানেই অজস্র স্বাধীনতা। ছোটবেলায় দুষ্টুমি করলে বাবার বকাঝকা খেতাম, তবে মা আদর করে পুষিয়ে দিতেন। তাছাড়া মায়ের আদর ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম। ঈদের জামা নিয়ে আমার বায়না ছিল বিশেষ রকম। দুই ঈদেই আমাদের জামা কেনা হতো। তখন সবার চেয়ে সুন্দর জামা না পেলে আমি রাগ করতাম। সেই রাগ ভাঙাতে আমাকে আবার জামা কিনে দিতে হতো। এভাবে আমার জামা হয়ে যেত দুটো। প্রয়োজনে শাসন করলেও এরকম কিছু বিষয়ে মায়ের বিশেষ আদর আমার শিশুমনের পক্ষে যেত। কোরবানির প্রসঙ্গ এলে মনে পড়ে, আমার দাবি ছিল, কিনতে হবে লাল গরু। সেই গরু কেনার পর মায়ের মনে আরেক উৎকণ্ঠা যুক্ত হতো আমাকে ঘিরে। মা নিষেধ করতেন, গরুর কাছে যেও না। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর শঙ্কা ছিল আমার কোনো আঘাত পাওয়ার। সেদিকে কি আর লক্ষ্য আছে আমার? গরুর কাছে যাওয়া তো সামান্যই। আমি গরুর পিঠে উঠে বসে থাকতাম। মা ছুটে এসে আমাকে নিয়ে যেতেন। 
আমাদের বাসার প্রায় সকল সদস্যই ছিল শিল্পমনা। বাবাকে সেই ছোটবেলা থেকেই দেখছি স্কেচবুকে আঁকিবুকি করতে। আর মা, বোনেরা বুনন শিল্পে ছিলেন অসাধারণ। চটের পটভূমিতে উল দিয়ে বোনা জায়নামাজের জন্য মা একবার মেলায় বস্ত্রশিল্পে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়েছিলেন, তাছাড়া কাপড়ে মাছের আঁশের ফুলতোলা, কাপড়ে রঙিন সুতোর সেলাইয়ে নৈসর্গ অঙ্কনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত পারদর্শী। আমার শিল্পী হওয়ার পেছনে এসবই ছিল অনুপ্রেরণা। মায়ের কাছে ছিল আমার যত আবদার, তেমনি দুষ্টুমিও যে করিনি তা নয়। মা উল দিয়ে সোয়েটার বুনছিলেন আর আমি উলের গুটি নিয়ে গাছের উঁচু ডালে বেঁধে রেখেছিলাম। মা গল্পের বই, কবিতার বই পড়তে ভালোবাসতেন ও আমাদের ভাইবোনদেরও গল্প, কবিতার বই পড়তে অনুপ্রেরণা জোগাতেন আর তাই বুঝি আমি ও আমার এক বোন এখনও কবিতা লিখি। মাকে লেখা আমার একটি কবিতা এখানে তুলে ধরলাম। 
এখন সেই মায়ের শূন্যস্থান পূরণ করেছে আমার সন্তানের মা। ভিন্নতা আছে তবে সব মা-ই যেন তাদের সন্তানদের কাছে অনুপ্রেরণার। সন্তানের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা যেমন আছে, তেমনি সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে সবসময় তারা চিন্তিত থাকেন এবং সেটিই স্বাভাবিক।
‘মা মানে প্রাণ সঞ্চারিণী এক স্বাধীনতা’ 
মা মানে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের কোনো 
এক কোনে লুকিয়ে থাকা এক পৃথিবী।
মা মানে নাড়ির বন্ধনে অন্ধকার এক গভীর সমুদ্রে
তিলে তিলে গড়ে ওঠা রঙিন আরেকটি পৃথিবীর জন্ম দেয়া।
মা মানে ভয়ংকর এক প্রসব বেদনার মাঝেও
ভুবন ভোলানো মা ডাক শোনার অপেক্ষা,
মা মানে চাঁদনী রাতের জ্যোৎস্নার সাথে
হীরকের আলো আঁধারের লুকোচুরি এক খেলা।
মা মানে প্রচণ্ড ঝড়-ঝঞ্ঝায়ও 
বুকে আগলে রাখা বিশাল ঝর্ণাধারা, 
মা মানে পাহাড়ের গায়ে জমে থাকা 
বরফ গলা এক বহমান নদী।
মা মানে শত অভাবের মাঝেও 
ইচ্ছে পূরণ করা, 
মা মানে চরম অবিশ্বাসের মাঝেও 
তুলনাহীন ধৈর্য ধরা।
মা মানে তপ্ত মরুভূমির মাঝে 
সবুজ গাছের শ্যামল ছায়া, 
মা মানে অতল গভীরের শান্ত এক সমুদ্র।
মা মানে সূর্যের অস্বাভাবিক বিকিরণের মাঝে 
অক্লান্ত হেঁটে পথচলা,
মা মানে বিশাল আকাশে মেঘের ছায়ার 
তুলতুলে নরম বিছানা, 
মা মানে চরম রুদ্রতায়ও এক বরিষধারা।
মা মানে শত অভাবে প্রদীপ শিখার মত 
বিকশিত জ্ঞানের আলো, 
মা মানে হোঁচটের পর হোঁচট খেলেও সীমাহীন অনুপ্রেরণা।
মা মানে চাতক পাখির মত পথ চেয়ে থাকা, 
মা মানে প্রাণ সঞ্চরিণী এক স্বাধীনতা ।
‘মা’ মানে শুধুই মা....
 

আরও পড়ুন

×