ধূসরতা জ্বলতার মিশেল

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২৪ | ০২:১৬
ছেলেবেলার ঈদের কথা বলতে গেলে আধা শতাব্দীরও এক দশক আগের কথা বলতে হয়। আরেকটা কালেরই যেন স্মৃতি জড়ানো সেসব কথা, যে কালটা আমাদের এই দৃশ্যমাধ্যমতাড়িত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শাসিত, পণ্যায়ন-দংশিত, বিচ্ছিন্নতায় পীড়িত চমকের সময়ের বিপ্রতীপ। আমার ছেলেবেলার সেই সময়টা ছিল চমকহীন, সাদাকালো–যখন বই ছিল আমার আর আমার বন্ধুদের কাছে প্রধান উপহার, যখন মাঠ ছিল, খেলাধুলা ছিল, বন্ধুসঙ্গ অনিবার্য এক জীবন শর্ত ছিল। মাদক ছিল না, সহিংসতা ছিল না, কিশোর গ্যাং ছিল না, চুলের বাহারি কাট আর কাপড় চোপড়ের আলগা ভাব ছিল না, ইঁচড়ে পাকামি ছিল না। না, এটি কোনো এ্যানশেন্ট মেরিনারের কল্পিত স্মৃতি নির্মাণ নয়, এটি ইতিহাস সমর্থিত এবং প্রমাণযোগ্য একটা সময়-চিত্র। মাত্র ষাট-পয়ষট্টি বছরে কত কিছুই না বদলে গেল!
তবে কিছু জিনিস বদলায় না–প্রতি যুগে মূল চরিত্রটা ধরে রেখে যুগের প্রসাধনটা শুধু গায়ে মাখে। যেমন ঈদ; যেমন মা’কে নিয়ে, মা’কে ঘিরে ঈদ। একসময় মানুষ বরগুনা থেকে তিন দিন ভ্রমণ করে সিলেট যেত মা’র সঙ্গে ঈদ করতে, এখন দশ-বারো ঘণ্টায় সেই ভ্রমণ সারে। একসময় মানুষ খুব নিকটজনকে চিঠিতে সেই আবেগঘন মুহূর্তগুলির বিবরণ লিখত, এখন ফেইসবুকে সেই আবেগের সচিত্র রূপ হাজারজনের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয় এক মুহূর্তে। এক সময় চিঠির জবাব দশ দিনে পেলে বর্তে যেত মানুষ, এখন মুহূর্তে তার ফেইসবুক পোস্টে পঞ্চাশটা লাইক না পড়লে তার দিনটাই মন-খারাপের বিরাণ ভূমি হয়ে ওঠে।
আমার ছেলেবেলাটা ছিল পুরুষশাসিত, যখন মা’রা ঘরের বাইরে যেতেন না, তারা ঘর সামলাতেন। ঈদের কেনাকাটা, এমনকি বাড়ির মেয়েদের শাড়ি, জামা-জুতা কিনতেন বাবারা। মা’দের দেখা যেত না, যদিও তারা আড়াল থেকে আতিথেয়তার ষোলো আনাই সারতেন। শপিংমল ছিল না, সুপারশপ ছিল না। ঈদের কেনাকাটা হতো বাজারে–বাজার মানে যেখানে কাপড় আর দর্জির দোকান থাকত পাশাপাশি, আশেপাশেই থাকত মনোহারি অথবা ভুসিমালের আড়ত, তেল-ডাল-চাল মসলার মহাজনি দোকান। শহরের, পাড়ার, পরিচিতজনের বৃত্তগুলিও ছিল ছোট। আমি শহরেই জন্মেছি–সিলেটে–থেকেছিও সারাজীবন শহরে। শৈশবের চার বছর কুমিল্লায়, আঠারো বছর বয়স থেকে নিয়ে ঢাকায়। গ্রামে থাকার অভিজ্ঞতা আমার নেই, যেটুকু আছে তা টুকটাক ভ্রমণের। কিন্তু ঈদের আনন্দ গ্রাম-শহরের ফারাক মানত না, এখনও মানে না।
আমার ছেলেবেলার প্রধান ঈদটা ছিল ঈদুল ফিতর। ঈদুল আজহাকে যদিও বলা হতো বড় ঈদ–খরচ আর কর্মব্যস্ততায় নিশ্চয় তা ছিল বড়, বিশেষ করে যেসব পরিবারের লোক হজে যেতেন এবং যারা কুরবানি দিতেন, তাদের জন্য–কিন্তু এক মাস রোজা রাখার পর যে ঈদটা আসত, তাকে যত অধীর আগ্রহে আমরা বরণ করে নিতাম, কুরবানির ঈদের জন্য দিনগোনার উপলক্ষ তৈরি হতো না।
আর চাঁদ রাতের প্রশ্নতো ওঠেই না। তারপরও ঈদ মানে ঈদ। আনন্দ। উৎসাহ। নতুন কেনা একটা জামা বা এক জোড়া জুতা পরার তৃপ্তি।
যেসব সংসারে সন্তান আছে, মা-ও আছেন, সেসব পরিবারে ঈদগুলি সবসময়, মা-কেন্দ্রিক। আমার ছেলেবেলা বাবা ঈদের বাজার সেরে মা’কে সেসব বুঝিয়ে দিতেন। মা’র পরামর্শে, তাঁর লেখা ফর্দ মিলিয়ে সব বাজার হতো; কী রান্না হবে, কতটা হবে, এসব ছিল মা’র এখতিয়ারে। তবে কুরবানির ঈদে কী কুরবানি দেওয়া হবে, তা ঠিক করতেন বাবা। খুব কম মধ্যবিত্ত পরিবারই ছিল, যারা আস্ত একটা গরু নিজেরাই কুরবানি দিত, যদি না পরিবারটা হতো যৌথ। আমরা সিলেটে যে পাড়ায় থাকতাম, সেখানে শুধু চার-পাঁচ ঘর আমরা মুসলমান ছিলাম। বাকিরা ছিলেন মণিপুরি এবং হিন্দু পরিবারের। সেজন্য কয়েকজন বন্ধু বা সহকর্মীর সঙ্গে মিলে বাবা কুরবানির ব্যবস্থা করতেন ধারে কাছে কোথাও। তখন প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই উঠান ছিল, বাড়ির সামনে খোলা জায়গা ছিল। কুরবানি শেষে মাংস নিয়ে বাড়ি ফিরতাম হয় আমি, না হয় আমার মেজো ভাই। সেগুলি তুলে দিতাম মা’র হাতে। বাবার কোনো ভূমিকা আর থাকত না। কার বাড়িতে কতটা মাংস যাবে, সেটা মা-ই ঠিক করতেন। এই কঠিন বিতরণ কাজটি করতাম আমি, যদিও অনেক সময় সেটি সারতে সারতে বিকেলের খেলার সময় পার হয়ে যেত। তাতে মনটা খারাপ হতো, যদিও মা বলতেন, ঈদের দিনে কারো মন খারাপ করতে নেই। এজন্য মা’র রান্নার একটা অংশ তোলা থাকত অভাবী মানুষের জন্য, যাদের মন এমনিতেই খারাপ থাকত সারা বছর।
এই একটা জিনিস তখনও ছিল, এখনও আছে–অভাব। তবে আমার ছেলেবেলা সম্পদ আর টাকা দেখানোর জিনিস ছিল না বলে বৈষম্যটা এতটা পীড়াদায়ক ছিল না।
মা’র সঙ্গে ঈদের স্মৃতিতে উপহারের, মা’র অপার্থিব কিছু রান্নার এবং ঘড়ির কাঁটা থেকে মুক্তির প্রসঙ্গগুলি জড়িয়ে আছে। অপার্থিব রান্নাগুলি রোজার ঈদের আগের সেই চাঁদ রাতেই বেশি হতো। তবে এগুলি থেকে বড় ঈদেও আমরা বঞ্চিত হতাম না। কত যে সেসব রান্না–কোর্মা, কোপ্তা, কালিয়া, রোস্ট, পোলাও। এক ধরনের পরোটা মা বানাতেন, সেগুলি ঈদের নামাজ শেষে বাসায় ফিরে খেতাম, যার তুলনা এখনও কোথাও পাই না। আমরা ভাইবোনেরা এর নাম দিয়েছিলাম পরীস্তানি পরোটা। আমার এখনও অবাক লাগে, মা যেখানে রান্না করাটা খুবই অপছন্দ করতেন, নেহাৎ করতে হয় বলে মাঝে মাঝে করতেন, তিনি কিভাবে এত বড় আয়োজনের ঈদের রান্না এত নিখুঁতভাবে করতেন। মা সিলেটের সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় যোগ দেন আমার জন্মেরও কয়েক বছর আগে, সেই ১৯৪৫ সালে। তখন থেকেই মা ছিলেন ‘কর্মজীবী মহিলা’। সারাদিন তাঁর স্কুলে কাটত। স্কুল থেকে ফিরে অল্প কিছু খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়তেন গল্পের বই নিয়ে। বিমল মিত্র, আশাপূর্ণা দেবী, না হয় অন্য কারো। গল্প-উপন্যাস পড়া ছিল তাঁর প্যাশন। আমার ছেলেবেলায় রান্নাঘরের কর্তৃত্ব ছিল ‘বুয়া’র হাতে, যাকে মান্য করাটা ছিল আমাদের কর্তব্য। কিন্তু মাঝে মাঝে বুয়া না থাকলে রান্নার কাজটা মা’কেই করতে হতো। কোনো কোনো দিন দেখতাম মা এক হাতে গল্পের বই ধরে অন্যহাতে খুন্তি চালাচ্ছেন। অথচ রান্না শেষ হলে কারো বলার সাধ্য ছিল না এসব নিতান্ত দায়িত্ববোধ থেকে করা কেজো রান্না। সেসব রান্নার স্বাদ ছিল অপূর্ব।
মা চাকরি করতেন, এবং তাঁর উপার্জনের মালিক ছিলেন তিনিই। বাবা যেহেতু ছিলেন পরিবার প্রধান, তাঁর বেতনেই সংসার চলত, তবে আমার ছেলেবেলায় শুরুর দশ বছর পর বাবাকে তেমন পাইনি। তাঁর ছিল বদলির চাকরি। ময়মনসিংহ-খুলনা-ঢাকাতে ছিল তাঁর পোস্টিং। তাতে বাবার প্রয়োজন হতো আলাদা খরচের। সেজন্য মা’র বেতনের একটা অংশও যেত সংসারের পেছনে। সেই খরচের কিছু যেত আমাদের বই এবং কাপড়-জামার পেছনে। আমার ছেলেবেলা প্রতি ঈদে আমার ও আমাদের বন্ধুদের ভাগ্যে নতুন জামা জুটত না। পুরোনো জামা ইস্তিরি করে কয়েক ঈদ আমার কেটেছে। এ নিয়ে অবশ্য কারো খেদ ছিল না। অনেক পরে বুঝেছি, কৃচ্ছ্রসাধনটা যতটা অর্থনীতির কারণে হতো, তার থেকে বেশি হতো সংস্কৃতির কারণে। তখন সংস্কৃতিটাই ছিল সাধাসিধা জীবনযাপনের। আমার শিক্ষকেরা, আমার বাবা (যিনি অবসরে যাওয়ার আগের শেষ চার বছর ছিলেন সিলেট সরকারি পাইলট বালক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক) একটা আপ্তবাক্যে বিশ্বাস করতেন, ‘প্লেইন লিভিং, হাই থিংকিং,’ অর্থাৎ সাদামাটা জীবনযাপন, উন্নত চিন্তা। আমার মনে আছে, এ নিয়ে নবম শ্রেণিতে আমাকে ইংরেজিতে রচনা লিখতে হয়েছে।
ঈদের সময় এলে আমরা বুঝতাম প্লেইন লিভিং-টিভিং যাই হোক, কোনো পরিবার রান্নায় ব্যয় সংকোচনের কথা ভাবতেন না; যতটা সাধ্যে কুলায়, উপহার কিনতেন। কিছু না হলেও আমি পেতাম বই। রান্না মানে শুধু নিজেদের জন্য না–আত্মীয়-পড়শি, এমনকি অবেলায় এসে পড়া অনাহূত কেউ–সবার জন্য ছিল এর স্বাদ গ্রহণের আমন্ত্রণ। ঈদের দিনটা ছিল সবাইকে নিয়ে উদযাপনের। এবং মা থাকতেন এসবের পেছনে। সব মা-ই।
পেছন ফিরে তাকালে বুঝি, একটা সময় চলে যায়, কিন্তু কিছু দাগ রেখে যায়। সময়টা ফেরে না, তবে তার প্রকৃতিটা, তার স্পিরিটটা মুছে যায় না, সেটি সেই দাগ। স্মৃতির ঘরে তা চিরস্থায়ী থেকে যায়–হয়তো আচরণে, অভ্যাসেও। কে জানে।
বাবা চলে গেলেন আমি যখন বিদেশে ছিলাম, সেই ১৯৭৭ সালে। মাও চলে গেলেন কুড়ি বছর আগে, আমার জন্মদিনে। এজন্য জন্মদিন আমার কাছে পালনের দিন নয়, বিষাদের এক দিন। কিন্তু তাদের স্মৃতিমাখা শৈশব-কৈশোরের ঈদগুলি রয়ে গেছে আমার অস্তিত্ব জুড়ে, ধূসরতা-উজ্জ্বলতার মিশেলে।
সবাইকে ঈদের (ইদের নয়, ঈদের) শুভেচ্ছা!