নাটকের জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন জ্যোতি সিনহা

জ্যোতি সিনহা
মীর সামী
প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৪ | ২০:৪৯ | আপডেট: ৩১ মে ২০২৪ | ২০:৫০
জ্যোতি সিনহা। মঞ্চ অভিনেত্রী ও নির্দেশক। ‘কহে বীরাঙ্গনা’ নাটকটি জ্যোতি সিনহাকে নিয়ে গেছে নতুন এক উচ্চতায়। একই নাটকে মহাভারতের চার চরিত্র [শকুন্তলা, দ্রৌপদী, দুঃশলা আর জনা] ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি অনবদ্য শৈল্পিক অভিনয়ে। আজ রাজধানীর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তনে সন্ধ্যা ৭টায় নাটকটির শততম মঞ্চায়ন হবে। কথা হলো তাঁর সঙ্গে–
আজ আপনার অভিনীত একক নাটক ‘কহে বীরাঙ্গনা’র শততম মঞ্চায়ন। কেমন লাগছে…
এক কথায় অসাধারণ। সেই সঙ্গে কিছুটা স্নায়ুচাপের মধ্যেও আছি। এ নাটকটির জন্য জীবনে অনেক মানুষের ভালোবাসা, মায়া-মমতা অর্জন করেছি। অনেক সম্মান পেয়েছি। এ নাটকে আমরা ১০ জনের টিম শো শেষ করে দেখতাম, মানুষ একটা তৃপ্তি নিয়ে বের হয়ে যেত, যদিও আমি বেদনায় ভারাক্রান্ত থাকতাম, এখনও তা-ই হয়। একটা সময় আমাদের এ নাটকে অনেকেই কাজ করেছেন। এই সময়ে তারা জীবন, সংসার, সময়ের তাগিদে সরে গেছেন, অনেক নতুন শিল্পী যুক্ত হয়েছেন। মনে পড়ছে সহশিল্পী শুক্লা, ভাগ্যলক্ষ্মী, স্মৃতি, সুনন্দা, অরুণাসহ অনেককেই। ৯৯ প্রদর্শনী পর্যন্ত যারা এ নাটকে কাজ করেছেন, তাদের সবাইকে ভালোবাসা। তারা না থাকলে হয়তো নাটকটির এত শো হতো না।
নাটকটির প্রথম মঞ্চায়নের কথা মনে পড়ে…
হ্যাঁ, আজও সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। প্রথম প্রদর্শনী হয় ২০১০ সালের ২৪ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ঘোড়ামারা গ্রামের মণিপুরি থিয়েটারের নিজস্ব থিয়েটার স্টুডিও মিলনায়তেন। এ নাটকটি দিয়েই আমাদের ‘স্টুডিও থিয়েটার নটমণ্ডপ’ উদ্বোধন হয়েছিল। সেদিন গ্রামের কাঁচা রাস্তা ধরে বিভিন্ন বয়সের মানুষ নাটক দেখতে এসেছিলেন। দুই দিনে বিকেল ও রাত মিলিয়ে চারটি শো করেছিলাম। টিকিটের দাম ছিল মাটিতে ২০ টাকা, চেয়ারে ৫০ টাকা। মাটিতে খড় বিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল, শিশুরা ১০ টাকা দিয়ে নাটক দেখতে এসেছিল। নাটকটির জন্য আমরা অনেকদিন মহড়া করেছি।
কহে বীরাঙ্গনা নাটকের মূল উপজীব্য বিষয় কী?
শকুন্তলা, দ্রৌপদী, দুঃশলা ও জনা–এই চার পৌরাণিক নারীর বিরহ, ঈর্ষা, শান্তি ও বিদ্রোহ তুলে ধরা হয়েছে নাটকটিতে; যার মূল কথা উঠে আসে–হিংসা নয়, প্রেমেই মানুষের মুক্তি। মহাভারতের এই চার নারীর স্বামীকে লেখা চিঠিই নাটকের মূল উপজীব্য। মাইকেল মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্য থেকে নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন শুভাশিস সিনহা। নাটকটির ভাষা বাংলা। তবে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মণিপুরি বাদ্য, তাল ও নৃত্যভঙ্গি।
প্রতিটি প্রদর্শনীর আগে আপনার প্রস্তুতি কেমন থাকে…
মঞ্চের প্রতিটি প্রদর্শনীই নতুন এবং জীবন্ত। এ নাটকে আমি একক অভিনেত্রী। এক ঘণ্টার মধ্যে চারটি চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে হয় আমাকে। এ চারটি চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে সাধনার মধ্যে থাকতে হয় সব সময়। নাটকটির পুরোটিই ছন্দে নির্মিত। আমাকে ছন্দের ভেতরে থেকে কাজ করতে হয়। নাটকটির প্রতিটি প্রদর্শনীতে নিজের আগের পারফরম্যান্স ভেঙে আরও একধাপ বেশি মার্জিতভাবে পারফর্ম করতে চেয়েছি আমি। পেরেছি কিনা, তা দর্শকই ভালো বলতে পারবেন।
নাটকটিতে সময় দিতে গিয়ে আপনাকে চাকরিও ছাড়তে হয়েছিল…
সেটি ২০১০ সালের ঘটনা। তখন সবেমাত্র আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে একটি এনজিওতে যোগ দিই। সংসারের দায়িত্ব আমার কাঁধে চাপে। মা-বোনের দেখাশোনা করতে হতো। নাটকে মনোযোগী হব নাকি চাকরি করব–বিষয়গুলো নিয়ে দোটানায় ছিলাম। তখনও আমার সরকারি চাকরি পাবার বয়স ছিল। তাই ভাবলাম চাকরি পরেও জুটিয়ে নেওয়া যাবে, কিন্তু নাটকটি করার সুযোগ হয়তো আর আসবে না। ফলে চাকরি ছেড়ে দিলাম। এরপর টানা তিন বছর চাকরি করিনি।
এরই মধ্যে নাটকটির ৯৯টি শো হয়েছে। কোন শোতে আপনি সবচেয়ে ভালো পারফর্ম করেছেন?
৫০তম শোতে। ঢাকায় আমরা ৪৯ ও ৫০তম শো একসঙ্গে করেছিলাম। ৪৯তম শোতে আমার পারফরম্যান্স ভালো হয়নি। তখন নির্দেশক বললেন, ‘তোমাকে দিয়ে মনে হয় আর হবে না। তুমি বরং এটি করা বন্ধ করে দাও।’ জেদ চেপে গেল মাথায়। এরপর আমি আরও ভালোভাবে প্রস্তুতি নিলাম। প্রতিটি সংলাপ আলাদাভাবে উচ্চারণ করলাম। মহড়াই হয়ে গেল আমার ধ্যানজ্ঞান। ৫০তম শো হলো। সেই শোতে যারা উপস্থিত ছিলেন তারা আমার অভিনয়ের প্রশংসা করলেন। প্রতি মুহূর্তে নিজেকে নতুন করে চেনারও শুরু হলো তখন থেকে।
আপনার শিল্পী জীবনে শুভাশিস সিনহার ভূমিকা কেমন…
তাঁর দলেই প্রথম কাজ। এখনও কাজ করছি। জীবনাদর্শ, জীবনের দার্শনিক ভিত্তি পেয়েছি শুভাশিস সিনহার কাছ থেকে। তিনিই আমার শিক্ষাগুরু। তাঁর অনুপ্রেরণায় আমি মঞ্চনাটকের নির্দেশনা দিয়েছি ২০১৪ সালে।
মঞ্চে নতুন কিছু আনছেন কী?
হ্যাঁ, মঞ্চে নতুন একটা কাজের জন্য প্রস্তুতি শুরু করেছি। শুভাশিস সিনহার নির্দেশনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রক্তকরবী নিয়ে কাজ করছি। এছাড়াও আমার নির্দেশনায় ড্যান্সড্রামা ‘চিত্রাঙ্গদা’ করছি। আশা করছি চলতি বছরেই কাজটি শেষ করতে পারব।
- বিষয় :
- জ্যোতি সিনহা