ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

সরকারি অনুদানের সিনেমা নির্মাণ নিয়ে নয়-ছয়

সরকারি অনুদানের সিনেমা নির্মাণ নিয়ে নয়-ছয়

ছবি: সংগৃহীত

অনিন্দ্য মামুন

প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০২৪ | ১৭:১৪ | আপডেট: ২৩ আগস্ট ২০২৪ | ১৪:১২

দেশে রুচিশীল চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য অর্থাভাবে থাকা চলচ্চিত্র প্রযোজক ও নির্মাতাদের প্রেরণা দিতেই দেওয়া হয় সরকারি অনুদান। তথ্য বলে, ১৯৭৬ সাল থেকে প্রতি বছরই এই অনুদান দেওয়া হয়। শুরুর দিকে সরকারি অনুদানেই নির্মিত হয়েছিল ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ এবং ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহি- নী’র মতো কালজয়ী চলচ্চিত্র। তবে মাঝে কয়েক বছর বন্ধ থাকলেও ২০০৭-০৮ অর্থবছর থেকে আবারও তা নিয়মিত হয়। এই অনুদান দেওয়ার পদ্ধতিতে ফাঁকফোকড় রয়েছে অনেক। রয়েছে স্বজনপ্রীতি ও কমিশন দিয়ে অনুদান নেওয়ার অভিযোগও। ফলে প্রতি বছরই অনুদানের সিনেমার চূড়ান্ত ঘোষণার পর নানা প্রশ্ন আর বিতর্ক ওঠে। অভিযোগ ওঠে সিনেমা নির্মাণের জন্য এমন মানুষ অনুদান পান যাদের অর্থের অভাব নেই। আবার পরিচালনায় পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই এমন পরিচালকও পাচ্ছেন অনুদান।

কাদের, কী কারণে এবং কোন পদ্ধতিতে অনুদানের জন্য মনোনীত করা হয়, সেই প্রশ্নও আছে। এ অনুদানের বরাদ্দ অর্থ নিয়েও বছরের পর বছর ছবির কাজ শুরু করেননি অনেকে। আবার কেউ কেউ ফ্ল্যাট ও জমি কিনে ফেলেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরাদ্দ করা অর্থ নেওয়ার পর সময়মতো সিনেমার কাজ শেষ না করায় বেশ কয়েকজন প্রযোজক ও নির্মাতার বিরুদ্ধে মামলাও করেছে তথ্য মন্ত্রণালয়। অনেকে আবার নামমাত্র সিনেমা বানিয়ে দায়িত্ব শেষ করছেন। হলে মুক্তি দেওয়ার খবর থাকে না সেই ছবির।

২০২০ সাল থেকে অনুদানে বানানো সিনেমা প্রথমে কমপক্ষে ১০টি ও পরবর্তী সময়ে কমপক্ষে ২০টি হলে মুক্তি দেওয়া নীতিমালায় যুক্ত করা হয়েছে। সে সময় জানানো হয় আর্টফিল্মের চেয়ে বাণিজ্যিক সিনেমার প্রতি বেশি জোর দেওয়ার কথা। তখন অনুদানের পরিমাণ দ্বিগুণ করে আগের ১০ কোটিকে ২০ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। যে সিনেমার জন্য ৩০ লাখ, ৪০ লাখ টাকা দেওয়া হতো, সেটিকে ৭৫ লাখে উন্নীত করা হয়।

অনুদানের চেক পাওয়ার ৯ মাসের মধ্যে একটি সিনেমা তথ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে বলা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে কারও দেরি হলে তারা যুক্তিসংগত কারণ দেখালে মেয়াদ বাড়াতে পারে। এটিকে পুঁজি করে যুক্তিসংগত কারণ দেখিয়ে অযৌক্তিভাবে বছরের পর বছর ফেলে রাখা হয়েছে অনুদানের ছবি। ছবি বা টাকা কোনোটিই ফেরত দেওয়া হচ্ছে না তথ্য মন্ত্রণালয়কে। অনুদানের ছবি নিয়ে নয়-ছয়কারীদের বিরুদ্ধে বার বার ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলেও জোরালোভাবে কোনো উদ্যোগই চোখে পড়েনি।

তালিকা করলে অনুদানের সিনেমার নয়-ছয়ের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে ১৯৮২-৮৩ অর্থবছরে নায়ক আশরাফ উদ্দিন আহমেদ উজ্জ্বলের ‘উদয় তারা’। সিনেমাটির জন্য ১ লাখ টাকা অনুদান পেলেও ছবি জমা দেননি, টাকাও ফেরত দেননি। এ জন্য তাঁর নামে মামলা হয়েছে। মারুফ হাসান আরমান ‘নেকড়ে অরণ্য’-এর জন্য ২০১১-১২ অর্থবছরে ৩৫ লাখ টাকা পান। ছবি নির্মাণ না করায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ‘কাঁটা’ সিনেমার জন্য অনুদান পান কবি ও নির্মাতা টোকন ঠাকুর। সময়মতো ছবি নির্মাণ করতে না পারায় মন্ত্রণালয়ের মামলায় গ্রেপ্তারও হন তিনি। এতো গেল কয়েকটি ছবির খবর; এমন আরও ডজনখানেক ছবি রয়েছে যেগুলোর খবর জানেন না কেউ। এ অনুদান কমিটিতে ২০২১-২২ অর্থবছরের একজন সদস্য নির্মাতা মতিন রহমান। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাজ হলো অনুদানের নীতিমালা অনুসরণ করে গল্প দেখা। গল্পে অসামঞ্জস্য কোনো কিছু থাকলে, তা সংশোধন করতে বলতাম। এরপর আর কাজ নেই। বাকি কাজটা করত মন্ত্রণালয়।’

সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জের ধরে হাসিনা সরকারের পতন হয়। দেশ এখন চলছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে। যে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হচ্ছেন মুহাম্মদ ইউনূস। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা হিসেবে আছেন নাহিদ ইসলাম; যিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সমন্বয়ক। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা তাঁর উদ্যোগেই সেন্সর বোর্ড ও অনুদানের সব নিয়মনীতি নতুন করে সংস্কার করা হবে। নতুন করে এ অনুদানের প্রক্রিয়াটা কেমন দেখতে চান? প্রশ্ন রাখলে মতিন রহমান বলেন, ‘প্রথমেই আমি অনুদান কমিটির স্বচ্ছতার বিষয়টি চাইবো। সরকারের এই অনুদানের টাকা কিন্তু জনগণেরই টাকা। সেই টাকা যেন যোগ্য লোকের কাছে পৌঁছায়। যারা ভালো গল্প বানাতে পারেন। দর্শকদের চাহিদা অনুসারে ছবি বানাতে পারেন। আমি মনে করি স্বচ্ছতা ও জবাবাদিহিতার বিষয়টি জোরালোভাবে থাকলে অনুদানের টাকার নয়-ছয় হওয়ার আশঙ্কা একেবারেই কমে আসবে।

বর্তমান অনুদান কমিটির অন্যতম সদস্য পরিচালক অমিতাভ রেজা চৌধুরী। তিনি এতে যুক্ত হওয়ার পর থেকে চলচ্চিত্র অনুদান প্রক্রিয়ায় কিছুটা পরিবর্তনের কথা জানালেন। তিনি বলেন, এই প্রক্রিয়ায় প্রস্তাবকদের সবার সামনে পিচিং করতে হবে। সেখানে অনুদান কমিটির সদস্য, মন্ত্রণালয়ের লোকজন থাকবেন, এমনকি সাংবাদিকেরাও থাকবেন। একজন প্রযোজক বা পরিচালক কেন সিনেমা বানাতে চান, কীভাবে কাজ করবেন, সিনেমাটি নিয়ে তাঁর লক্ষ্য কী ইত্যাদি সবাই জানাবেন। এর মধ্য থেকে সেরা প্রকল্প বাছাই করা হবে। এ প্রক্রিয়ায় নিয়মিত এগোলে আশা করি অনুদানের সিনেমা নিয়ে আর প্রশ্ন থাকবে না।
এদিকে অনুদানের টাকা দিয়ে বিস্তার অভিযোগ ও ক্ষোভের কথা জানালেন চিত্রনায়ক সোহেল রানা। তাঁর মতে, কোনো প্রকার বাছবিচার না করেই এতদিন অনুদান দিয়ে আসা হচ্ছে। অনুদান কমিটির লোকেরা তো আমার মতো লোকদের দেখবে না। এমন সব মানুষেরা অনুদান পায় যাদের চলচ্চিত্রে কোনোদিন নামও শুনিনি। তবে দুই একজন পায়, তারা ভালো নির্মাতা ও সিনেমার লোক। কিন্তু বাকি ১০-১৫টি সিনেমা যারা পান তাদের কাউকে আমরাও চিনি না। এবং তারা ছবি বানাচ্ছেন কিনা তা কেউ জানতেও পারছেন না। ছবি না বানানোর কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে না। তাই আমি বলব আগে অনুদান কমিটি ঠিকঠাক করুন।  স্বচ্ছতা আনুন। যোগ্য ও মেধাবীদের অনুদান দিন। 

এদিকে সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য চলচ্চিত্রে সরকারি অনুদান প্রাপ্তদের নাম ঘোষণায় জানা যায় পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে ২০ জনকে ১৪ কোটি টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২০টি চলচ্চিত্রের মধ্যে ১৬টির প্রতিটি অনুদান হিসেবে পাচ্ছে ৭৫ লাখ টাকা করে, আর বাকি ৪টি চলচ্চিত্রকে দেওয়া হয়েছে ৫০ লাখ টাকা করে। এ চারটির মধ্যে দুটি শিশুতোষ এবং দুটি প্রামাণ্যচিত্র শাখা।

আটকে থাকা সিনেমাগুলো

৪৮ বছরে সরকার অনুদান দিয়েছে প্রায় দুইশ’ সিনেমাকে। নির্মাণ শেষ করতে পারেনি অর্ধশতাধিক সিনেমা। আলোর মুখ না দেখা অনুদানপ্রাপ্ত ছবিগুলো হচ্ছে...আশরাফ উদ্দিন আহমেদ উজ্জ্বলের ‘উদয় তারা’, মারুফ হাসান আরমানের ‘নেকড়ে অরণ্য’, সোহানুর রহমান সোহানের (মৃত) ‘প্রিয় জন্মভূমি’, ফারুক হোসেনের ‘কাকতাড়ুয়া’, তারেক মাসুদের ‘কাগজের ফুল’, টোকন ঠাকুরের‘কাঁটা’, জাঁ নেসার ওসমানের ‘পঞ্চসঙ্গী’, ড্যানি সিডাকের ‘কাঁসার থালায় রুপালি চাঁদ’। তবে শুটিং শেষ করলেও এনামুল করিম নির্ঝরের ‘নমুনা’ সিনেমাটি সেন্সর বোর্ডে আটকে রয়েছে।  তবে সেন্সর হওয়ার পরও সিনেমা হলে মুক্তি পায়িনি ‘সাবিত্রী’ ও ‘শিকলবাহা’ ছবি দুটি। কিন্তু দুটি সিনেমায় দেশ বিদেশের বিভিন্ন উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে।

শবনম ফেরদৌসীর ‘আজব সুন্দর’ ছবির কাজ হলেও মুক্তি পায়নি। ‘প্রিয় জন্মভূমি’ সিনেমা সময়মতো কাজ শুরু করতে না পারায় নির্মাতা সোহানুর রহমান সোহানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। জসিম উদ্দিন প্রযোজিত কমল সরকার পরিচালিত ‘দায়মুক্তি’ ছবিটিও মুক্তি পায়নি। সারাহ বেগম কবরীর ‘এই তুমি সেই তুমি’ ছবিটিও রয়েছে অনিশ্চয়তায়। কবরীর মৃত্যুর পর ছবিটির দায়িত্ব নিয়েছেন অভিনেত্রীর ছেলে। তিনিও ছবিটি নিয়ে কোনো সুখবর জানাতে পারেননি। হোসেন মোবারক রুমীর ‘অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া’ এবং শমী কায়সারের ‘স্বপ্ন মৃত্যু ভালোবাসা’ রয়েছে আটকে। তবে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে সময় বাড়িয়ে নিয়েছেন প্রযোজক শমী কায়সার। ফেরদৌস আলম সিদ্দিকীর ‘একজন মরিয়ম’, শবনম ফেরদৌসীর ‘আজব কারখানা’, মানিক মানবিকের ‘আজব ছেলে’, আবিদ হোসেন খানের ‘অবলম্বন’।

এ ছাড়াও ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে ২২ জনকে ১২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে; যার কোনো ছবিই এখনও মুক্তি পায়নি। অনেক ছবির শুটিংও শুরু করা হয়নি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকারি অনুদান পেয়েছে ২০টি ছবি। এর মধ্যে ১৬টি ছবির প্রযোজকরা পাবেন ৭৫ লাখ টাকা করে। বাকি ৪টি সিনেমার প্রযোজকরা পাচ্ছেন ৫০ লাখ করে। এই ছবির একটিরও এখনও শুটিংই শুরু করা হয়নি। ফলে মুক্তির বিষয়ে এখনও পরিকল্পনাতেই নেই।

আরও পড়ুন

×