ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

টাউন হলে নির্যাতনের স্মৃতি

টাউন হলে নির্যাতনের স্মৃতি

বীরাঙ্গনা মনছুরা বেগম

মেরিনা লাভলী, রংপুর

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২২ | ০০:৩০

রংপুর নগরীর বাহার কাছনা তকেয়ারপাড় সোনালীপাড়া গ্রাম। এ গ্রামেই থাকেন বীরাঙ্গনা মনছুরা বেগম (৭০)। ২০১৫ সালে তিনি পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। নিয়মিত ভাতা পাচ্ছেন। ২০১৮ সালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে পেয়েছেন পাকা বাড়ি। সেই বাড়িতেই ছেলে, নাতি-নাতনিদের নিয়ে বাস করছেন মনছুরা। বার্ধক্যে নুয়ে পড়েছেন। ২০২০ সালে স্ট্রোক করেছেন। তাই স্পষ্টভাবে তেমন কথা বলতে পারেন না তিনি। একাত্তরের স্মৃতিচারণের কথা বলতেই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। একাত্তরে টাউন হলে নারী-পুরুষদের ওপর নির্যাতনের স্মৃতি মনে পড়লে আজও আঁতকে ওঠেন মনছুরা।

মনছুরা জানান, ১৯৭১ সালে ২০ বছর বয়সী ছিলেন। চারদিকে তখন আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠা। এলাকার যুবকদের ধরে নিয়ে হত্যা করছে পাকিস্তানি বাহিনী। এমন খবরে বিচলিত ছিলেন সদ্য বিবাহিত তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা মনছুরা। এরই মধ্যে তার স্বামী গোলাম মোস্তফা সিদ্ধান্ত নেন যুদ্ধে যাবেন। মনছুরার বাধা সত্ত্বেও গোলাম মোস্তফা ভারতে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে চলে যান। এরপর শঙ্কায় দিন কাটে বাড়িতে থাকা বৃদ্ধ শ্বশুর ও মনছুরার। ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি সময়ে এক সকালে হঠাৎ বাইরে গুলির শব্দ। কিছু বোঝার আগেই ১০/১২ জন পাকিস্তানি হানাদার উঠানে এসে দাঁড়ায়।

ছেলে যুদ্ধ যাওয়ার অপরাধে রাইফেলের বাঁট আর বুট দিয়ে তার শ্বশুরকে পেটানো শুরু করে। এ দৃশ্য দেখে ঘর থেকে পালিয়ে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেন মনছুরা। এতেও শেষ রক্ষা হয়নি তার। তাকে ও শ্বশুরকে গাড়িতে তুলে টাউন হলের টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েকদিন পর শ্বশুরকে ছাড়লেও তাকে আটকে রাখে। সেখানে প্রতি রাতে মনছুরার ওপর পাশবিক নির্যাতন চলত। পাশবিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে প্রায় রাতেই জ্ঞান হারাতেন মনছুরা। মনে হতো আজই বুঝি তার জীবনের শেষ রাত। পাশবিক নির্যাতনের কারণে গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে যায়। ছেড়ে দেওয়ার জন্য আকুতি জানালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মনছুরার পিঠের মধ্যে গরম ছ্যাঁকা দিয়ে নির্যাতন করত।

মনছুরা জানান, টাউন হলের দুই কক্ষে প্রায় ২০ জন তরুণীকে আটকে রাখা হয়েছিল। কাউকে একে অপরের সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হতো না। সেখানে আলবদর ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পাহারা দিয়ে রাখত। রাতে ক্যান্টনমেন্ট থেকে গাড়িতে করে আর্মি অফিসাররা এসে আটক মেয়েদের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে গিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করত। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও আলবদররা প্রতি রাতেই অনেক পুরুষ ও নারীকে উলঙ্গ করে ঝুলিয়ে চাকু দিয়ে শরীরে ক্ষত-বিক্ষত করত। কাপড় পেঁচানো লাঠি অ্যাসিডের মধ্যে ভিজিয়ে কাটা জায়গা, নাকে, মুখে, চোখে দিয়ে নির্যাতন চালাত।

টাউন হলে আটক থাকা অবস্থায় জানালা দিয়ে এসব নির্মম দৃশ্য দেখেন মনছুরা। মরে গেলে নির্যাতিতদের লাশ টাউন হলের পাশে কূপে ও ঝোপে ফেলে দেওয়া হতো। ১৯ দিন পর টাউন হল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় মনছুরাকে। প্রাণে বেঁচে চলে আসেন বাড়ির পাশে এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সেখানেই গোপনে চলে তার চিকিৎসা। স্বামী বাড়ি ফিরে এলে সব শুনে বেঁকে বসেন। স্থানীয় মুরব্বি ও স্বজনদের কথায় মেনে নেন মনছুরাকে। এরপর শুরু হয় মনছুরার জীবনযুদ্ধ। বীরাঙ্গনার সংসারে ৬ সন্তান সেতারা বেগম, জয়তুন নেছা, দিল জাহান, গোল জাহান, দীন মোহাম্মদ ও মনসুর আলীর জন্ম হয়। তারা কৃষি কাজসহ নানা পেশায় জড়িত রয়েছেন। তবে ছোট ছেলে মনসুর আলীকে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী উল্লেখ করে মনছুরা বলেন, 'আমার ছেলেটার ভাতার ব্যবস্থা হলে মনে শান্তি পেতাম। সরকার যেন ওরে ভাতার ব্যবস্থা করে দেয়। আমার নাতি-নাতনিরা যদি কোনো সরকারি চাকরি পাইত, তাহলে ভালো লাগত। সরকারের পক্ষ থেকে ঘর পেয়েছি, ভাতা পাচ্ছি। আমার আর চাওয়ার কিছু নেই।' া

আরও পড়ুন

×