নিবন্ধ
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জগৎ

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ [১৫ আগস্ট ১৯২২-১০ অক্টোবর ১৯৭১]
লুৎফর রহমান
প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০২২ | ১২:০০
সংখ্যাল্প হলেও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কিছু কবিতার, দুটি গল্পগ্রন্থের, চারটি উপন্যাসের, তিনটি নাটকের ও বেশ কিছু চিত্র সমালোচনার রচয়িতা। তার মূল্যায়ন রচনা সংখ্যার বিচারে নয়, বরং রচনার গুণগত মানের মাপকাঠিতে। তিনি প্রতিটি রচনায় নিজ প্রতিভার অনন্য স্বাক্ষর রেখেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও তিনি ছবির ব্যাকরণ আত্মস্থ করেছিলেন স্বভাববশত, আত্মপ্রচেষ্টায়- শখের বশে ছবি আঁকতেন। নিজ রচনার প্রচ্ছদও এঁকেছেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রজ্ঞাবান ও মৌলিক চিন্তার অধিকারী স্রষ্টাদের অন্যতম। সমালোচকরা তাকে খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক জগদীশ গুপ্তের (১৮৮৬-১৯৫৭) উত্তরাধিকারী বলার পক্ষপাতী। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগ-পূর্ব রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি মুসলিম লীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। 'সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর গল্পলেখক হিসেবে উত্থান এমন এক সময়ে, যখন বাংলা ছোটগল্প পরিণত পর্যায়ে পৌঁছেছে। রবীন্দ্রনাথ-প্রভাতকুমার-শরৎচন্দ্র-প্রমথ চৌধুরী হয়ে বিশের ত্রিশের দশকের গল্পকারদের হাতে বাংলা ছোটগল্প দশ আয়তনবান হয়ে উঠেছে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সমগ্রভাবে তাদের উত্তরাধিকারী। প্রধানত মনোজগতের রূপকার তিনি। সেই হিসেবে অব্যবহিত-অগ্রজ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৯০৮-১৯৫৬) [...] উত্তরাধিকারী।' ওয়ালীউল্লাহ মুসলমান গদ্য লেখকগণের মধ্যে সর্বাগ্র গণ্য এ জন্য যে, আধুনিক পাশ্চাত্য শিল্পান্দোলনের অন্যতম প্রধান মতবাদ অস্তিত্ববাদ, চেতনাপ্রবাহ পদ্ধতি, মনোবিকলনতত্ত্ব তার রচনায়ই সার্থক রূপ পরিগ্রহ করেছে। ওয়ালীউল্লাহ গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেন- 'প্রথমে ছোটগল্প, তারপর উপন্যাস, তারপর নাটক- এই ক্রমে মাধ্যমগুলিতে অগ্রসর হয়েছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। কিন্তু তার সমস্ত রচনায় এক অখণ্ড ও অবিভাজ্য ওয়ালীউল্লাহই প্রকাশিত। সব মিলিয়ে ওয়ালীউল্লাহ নিবিড় একজন গদ্যশিল্পী; একটি-দুটি কবিতা লিখলেও বা তার গদ্যরচনায় কবিতার সংক্রামক থাকলেও ওয়ালীউল্লাহ কিছুতেই কবি নন, নিছকই গদ্যশিল্পী, কিন্তু গদ্যশিল্পী হিসেবে তিনি গহন পথের যাত্রিক। আবার, গল্প ও নাটক লিখলেও, ওয়ালীউল্লাহকে মূলত ঔপন্যাসিক বলেই মনে হয়।' [উয়ালীউল্লাহ, আবদুল মান্নান সৈয়দ] অনেকের অনেক কিছুই মনে হতে পারে কিন্তু এ কথা অতীব সত্য যে, নাটক রচনায় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর চেয়েও কম প্রতিভাধর, কম পারদর্শী ও কম সার্থক নাট্যকারের সংখ্যা বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে মোটেই দুর্লভ নয়। নাট্যকার পরিচয়ে অত্যন্ত সগৌরবেই তারা আমাদের সাহিত্যের ইতিহাস অলংকৃৃত করে আছেন। বরং বলা যায়, গল্প-উপন্যাস-নাটক সাহিত্যের এই তিন মাধ্যমেই তিনি সমান দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। স্বকালে বহু পণ্ডিত, কবি, সাহিত্যিক সৃজনশীল প্রতিভার অধিকারী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সৃষ্টিকর্মের বহুমাত্রিক আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর প্রতিভার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে মুনীর চৌধুরীর বক্তব্য নিম্নরূপ-
এক- 'বাংলা সাহিত্যের গদ্যরীতি রূপায়ণের এক বিশিষ্ট দিক হলো আঞ্চলিক উপভাষার বিচিত্র উপকরণের কলামণ্ডিত প্রয়োগ। এই প্রয়াস কত সূক্ষ্ণ, গূঢ় ও পরিশীলিত হতে পারে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর গদ্য তার একপ্রকার দৃষ্টান্ত।' দুই- 'সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কী কাহিনি গ্রন্থনে, চরিত্র সৃজনে, জীবনের প্রতি দৃষ্টিপাতে কিংবা জীবনোপলব্ধির ভাষাগত রূপায়ণে কখনোই বাস্তবতার অন্ধ অনুকারী নন। তার সংলাপও অঞ্চলবিশেষের মুখের ভাষার প্রতিফলন নয়। তার দৃষ্টিভঙ্গি বঙ্কিম, উপলব্ধি জটিলতাপূর্ণ। তার ভাষা তার চেতনার মতোই বহুমাত্রিক। বর্ণনাগুণে তার গল্পের অতিচেনা স্থূল পরিবেশ সূক্ষ্ণ সরসতা প্রাপ্ত, সত্য হয়েও কল্পলোকের প্রান্তসীমা স্পর্শ করে; পূর্ব বাংলার গ্রাম, তার মানুষ, তাদের অনুভূতি এক বৃহত্তর দুর্জ্ঞেয় জীবনরহস্যের প্রতীকে পরিণত হয়। ওয়ালীউল্লাহর ভাষা এই ভাবেরই বাহন। আঞ্চলিক বুলিকে তিনি সরাসরি গ্রহণ করেন না। তাকে ইচ্ছানুযায়ী ভাঙেন, ইচ্ছানুযায়ী গড়ে দেন।' [পৃষ্ঠা ৩৪, বাংলা গদ্যরীতি, মুনীর চৌধুরী]।
আমাদের বিবেচনায় সমসাময়িক মুনীর চৌধুরীর উদ্ধৃত বক্তব্য ওয়ালীউল্লাহ সম্বন্ধে শেষকথা। বাংলা ভাষায় গদ্যরীতির বিশিষ্টতা যাদের রচনায় সুপরিস্টম্ফুট, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাদের অন্যতম। তার প্রত্যক্ষণের স্বাতন্ত্র্য প্রকাশকালে ছিল স্বতন্ত্র ভাষারীতির দাবিদার। ওয়ালীউল্লাহ জীবনের গভীর তলে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সমাজের অভ্যন্তরীণ নিগূঢ় সত্য, জীবনের অতলস্থ জীবন অর্থাৎ অস্তিত্বের মৌল সংকট এবং আধুনিক জীবনে সর্বত্রগামী মানবচেতনার অভাবনীয় প্রভাব কতটা কার্যকর তা আবিস্কার প্রয়াসী। এর মধ্য দিয়ে তার রচনা বিশ্বসাহিত্যের সমকালীন ধারায় সংস্থাপিত হয়। যুগোত্তীর্ণ, কালোত্তীর্ণ অপরাপর শিল্পীর মতো ওয়ালীউল্লাহর শক্তি তার উপলব্ধির নিজস্বতা ও গভীরতা, প্রকাশরীতির বিশিষ্টতা এবং ভাষা ব্যবহারে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও পরিমিতিবোধ, গভীর তলমুখী ভাষা। বস্তুতান্ত্রিক জীবন এবং প্রতিদিনের সামাজিক জীবনের দ্বান্দ্বিকতা তার রচনার প্রধান উপজীব্য কিন্তু তা দার্শনিক জীবনজিজ্ঞাসা জারিত গভীর ভাবোদ্দীপকও বটে।
ওয়ালীউল্লাহ আধুনিক যুগ পরিবেশে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকামী বাঙালি মুসলমান তরুণ হিসেবে লেখক জীবন শুরু করেন- ১৯৪২ সাল থেকে দেশের খ্যাতনামা পত্রিকার তিনি নিয়মিত লেখক। এক সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিসম্পন্ন সংঘাতপূর্ণ, দাঙ্গা অব্যবহিত অস্বাস্থ্যকর সামাজিক পরিবেশের তিনি উত্তরাধিকার। সমগ্র উপমহাদেশে তখন নিখিল ভারত জাতীয় কংগ্রেস, নিখিল ভারত মুসলিম লীগ- এই দুই রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় মিলিত হয়ে ঔপনিবেশিক ক্ষমতার নাগপাশমুক্ত স্বাধীন ভারতবর্ষ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অব্যাহত। তার যৌবনে অর্থাৎ গল্প রচনাকালে (১৯৪২) বাংলায় স্বরাজ প্রতিষ্ঠিত (১৯৩৭-১৯৪৩), পাকিস্তান আন্দোলন নতুন গতি পেয়েছে, ভয়াবহ রূপ পেয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। মুসলিম লীগের সক্রিয় কর্মী ওয়ালীউল্লাহ তার রচনায় অনগ্রসর দুর্দশাগ্রস্ত, দরিদ্র মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির সমস্যাবলিকে উদার মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করে যাচ্ছেন গল্পের জমিনে। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির ঊর্ধ্বে উঠে সাধারণ শ্রমজীবী নিম্নমধ্যবিত্ত ও বিত্তহীন মানুষের জীবন সংগ্রামকে উপজীব্য করা সেকালে ছিল অসম্ভব। ওয়ালীউল্লাহর চরিত্ররা ধর্মবিশ্বাসে মুসলমান কিন্তু তাদের মানবিক সত্তা এবং তাতে নিহিত মানবিক অধিকার, বৃত্তাবদ্ধা থেকে মুক্ত হওয়ার যে প্রচেষ্টা সেটাই ছিল লেখক ওয়ালীউল্লাহর আরাধ্য কর্ম। সেজন্যই তার চরিত্রগুলো ধর্ম বিশ্বাসে মুসলমান কিন্তু ধর্ম সেখানে এক বিশেষ পার্থিব ক্ষমতা। সামাজিক নেতৃত্ব ও প্রভুত্ব অর্জনের পুঁজি। ধর্মকে ছাপিয়ে মনুষ্যত্ব তার রচনায় সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে গরিমাপূর্ণ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত। ওয়ালীউল্লাহ অস্তিত্ববাদ ও ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্বকে সাহিত্যচর্চার বাহন করেছিলেন। অর্থাৎ এ দুটি ছিল তার দার্শনিক ভিত্তি। প্রথমোক্তটি ছিল তার সমাজমানুষের বিদ্যমান সামাজিক অস্তিত্বের সংকট, দ্বন্দ্ব ও আকাঙ্ক্ষা প্রকাশের মাধ্যম; অপরটি মনোজাগতিক বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কীরূপে অভিব্যক্তি পায় তার মাধ্যম।
বাংলা সাহিত্যে ওয়ালীউল্লাহর গল্পগুলো তীক্ষষ্ট ও তির্যক ভঙ্গির। ব্যক্তি এখানে স্বাধীনতার জন্য এবং বিধিবিধানের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন সংগ্রাম করে, তা নয়। যে মহাজন কেরায়া দেবে বলে অঙ্গীকার করেছিল সে তা বিস্মৃত হয়েছে। অন্যদিকে তিন দিন যাবৎ তিনজন মানুষ তার প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাস করে অনাহারে মৃতপ্রায়। বাড়িতে তাদের পরিজনরাও তার হঠকারিতার দ্বারা পীড়িত। তারাও রয়েছে অনাহারে। ধনবান বা বুর্জোয়ার চেতনায় এই মানবিকতাটুকু অনুপস্থিত যে, আমার সুখের জন্য অন্যকে অন্যায়ভাবে, বিনা অপরাধে পীড়ন করার অধিকার আমার নেই। গল্পে এমন নানা প্রসঙ্গ এসেছে, যা শ্রমজীবীর অস্তিত্বের নানান সংকটের অভিব্যক্তি। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ শিল্পীর চেতনালোক ভারতবর্ষীয় মুক্তির সংগ্রামে একদা ইসলামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ না হলেও মুসলিম লীগের রাজনৈতিক চেতনা দ্বারা আলোড়িত হয়। তিনি মুসলিম লীগের রাজনীতির সমর্থক ছিলেন। ফলে সমগ্র বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের আলোকে তার প্রতিভার মূল্যায়ন যেমন হয়, তেমনি মুসলমান সাহিত্যিকদের সাহিত্য সাধনার পরিপ্রেক্ষিতেও ওয়ালীউল্লাহর সাহিত্যকর্মের মূল্য বিচার করার একটি প্রবণতা লক্ষণীয়। গল্পলেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সম্বন্ধে গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দের অনুরূপ একটি মূল্যায়ন নিল্ফেম্ন উদ্ধৃত হলো-
'বাঙালি-মুসলমানদের মধ্যে প্রথম প্রকৃত গদ্যশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান, আবু রুশদ আমাদের ছোটগল্পের প্রথম অগ্রদূত; তারাই প্রথম অন্তর্জগৎ-বহির্জগৎস্পর্শী গল্প লিখেছেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর এই সাফল্যের বাইরের কারণ : একদিকে পেশাঘটিত আভিজাতিক-আন্তর্জাতিক মানস-সংযোগ, অন্যদিকে নবোত্থিত মুসলিম সৃষ্টিশীল ও বুদ্ধিজীবীদের সংস্পর্শ-সংযোগ। তৎকালীন বাংলা সাহিত্যের কেন্দ্রীয় রাজধানী কলকাতায় অবস্থান, পূর্বাশা-চতুরঙ্গ একদিকে- অন্যদিকে সওগাত-মোহাম্মদীর সঙ্গে যোগ, দেশি- বিদেশি শিল্প-সাহিত্যের অধ্যয়ন, অনুশীলন ওয়ালীউল্লাহর সৃজ্যমান মানসকে 'দেশজ' ও 'দেশোত্তর' লক্ষণসমূহে সমৃদ্ধ করে তুলেছিল' [ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, ২০০১, ১৬]।
সাম্প্রদায়িকতার আলোয় নয়, বরং মুক্তচিন্তার দ্বারা মান্নান সৈয়দ প্রমাণ করেছেন- গল্পলেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর প্রগতিশীল শিল্পচিন্তার ও সৃষ্টির অনন্যতার কারণ বহুমাত্রিক। তন্মধ্যে সংস্কারমুক্ত চেতনা অন্যতম। বিশ্বসাহিত্যের পঠন-পাঠন, অনুশীলন তার প্রত্যক্ষণের ধরনটি গড়ে দিয়েছিল। বাংলাদেশের নোয়াখালী অঞ্চলের অধিবাসী ওয়ালীউল্লাহর গভীরতর অবলোকনে ছিল তার অঞ্চলের জনজীবনে প্রচলিত ধর্মীয় গোঁড়ামি। কিন্তু নিজে ছিলেন তার উল্টো অবস্থানে। ধর্মীয় গোঁড়ামিমুক্ত, সংস্কারমুক্ত মানবতাবাদে আস্থাবান ছিলেন বলেই তিনি অস্তিত্ব সম্বন্ধেও সচেতন। প্রতিটি প্রাণীর বাঁচার অধিকার সমান, মানুষেরও- কিন্তু স্বার্থবাদী মানুষ, ক্ষমতাবান রাষ্ট্রযন্ত্র, বুর্জোয়ার সম্পদের সীমাহীন লিপ্সা সে অধিকার হরণ করতে বদ্ধপরিকর। সেই আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধেই অধিকারবঞ্চিতের অস্তিত্বের সংগ্রাম। কথাশিল্পী ওয়ালীউল্লাহ মানুষের সেই অস্তিত্বের সংগ্রামকেই উপস্থাপন করেছেন, বিচক্ষণ পর্যবেক্ষণে সর্বপ্রকার প্রবণতাসহ অস্তিত্বের সংগ্রামে আত্মনিয়োগকৃত সেই মানুষগুলোকেই তুলে আনেন লোকগোচরে। ওয়ালীউল্লাহর শিল্পীচৈতন্য দুটি ধারায় সৃজন সম্পন্ন করেছে- এক. চেতনা প্রবাহ পদ্ধতি (Stream of Consciousness), দুই. অস্তিত্ববাদ (Existentialism)। চেতনাপ্রবাহ (Stream of Consciousness) : আধুনিক জীবনব্যবস্থার সামগ্রিক পরিবর্তন ইউরোপীয় জীবনে যে তরঙ্গাভিঘাত সৃষ্টি করে উনিশ শতকের শেষার্ধে তার প্রত্যক্ষ ফল ঐ সময়কার বিভিন্ন শিল্পান্দোলনে গোচরীভূত হয়। জীবন যখন যাপনের বিধিবিধান, উপকরণ ও ব্যবহার্য সামগ্রীর সঙ্গে অভাবনীয় বৈপরীত্যমূলক অবস্থানে উপনীত হয়, তখন সৃষ্ট বা উপস্থিত অসংগতির কারণে সামাজিক চেতনার সঙ্গে ব্যক্তিচেতনার প্রবল দ্বন্দ্ব বাধে। সেই দ্বন্দ্ব দৈনন্দিন জীবনে ঘটমান বর্তমানের অংশ বিধায় তা কষ্ট, যন্ত্রণা, সহ্যাতীত পীড়নমূলক, অন্যায়ের বহুমাত্রিক পেষণে পিষ্ট হওয়ায় তা কতকটা নিয়তিজ্ঞানেই মেনে নেয় সাধারণ মানুষ। শিল্পী-সাহিত্যিকগণ সমাজের সাধারণ নাগরিকগণের মতো কেবল পরিস্থিতির অংশ নয়, তারা একই সঙ্গে সেই পরিস্থিতির পর্যবেক্ষকও। সকল পরিস্থিতিকেই তারা কার্যকারণসূত্রে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। পরিবর্তমান সমাজের বহির্বাস্তবতা ও অন্তর্বাস্তবতার সমকালীন ও সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ রূপটি বিশ্নেষণপূর্বক, তারই অভিব্যক্তি নিজস্ব সৃষ্টির মধ্যে বিধৃত করেন। যুগে যুগে শিল্পী-সাহিত্যিকগণের সেই আত্মপ্রকাশ মাধ্যম আঙ্গিকগত বিবেচনায় পৃথক মতবাদে চিহ্নিত হয়ে আসছে ১৮৫০ সালের পরবর্তী সময় থেকেই। দুই মহাযুদ্ধের অভিজ্ঞতাপ্রসূত জীবন ও সমাজ বাস্তবতা যে শিল্পমতবাদকে মানবচেতনার গভীরতর স্তরে প্রতিষ্ঠিত করেছে তা চেতনাপ্রবাহ পদ্ধতি (Stream of Consciousness)। অপর মতবাদটি অস্তিত্ববাদ (Existentialism)।
- বিষয় :
- নিবন্ধ
- লুৎফর রহমান
- সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ