ডিজিটাল লেনদেন জনপ্রিয় হচ্ছে

সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২২ | ২৩:১৩
নগদ টাকা বহনে বাড়তি ঝামেলা থাকে। আছে জাল নোটের ঝক্কি। আবার ছিনতাইয়ের ভয় তো আছেই। এ ছাড়া অপরাধমূলক নানা লেনদেনও হয়ে থাকে নগদে। এসব বিবেচনায় বেশ আগে থেকে সব লেনদেন ডিজিটাল করার চেষ্টা করছে সরকার। ২০২৬ সালের মধ্যে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্কের অন্তত একটি অ্যাকাউন্ট খোলার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। অনলাইন ব্যাংকিং, কার্ড, এমএফএসের মতো বিভিন্ন মাধ্যমে ডিজিটাল পরিশোধ আকর্ষণে নানা ছাড় এর সঙ্গে যুক্ত। এসব নিয়ে লিখেছেন ওবায়দুল্লাহ রনি
জাতিসংঘের নেতৃত্বে 'বেটার দ্যান ক্যাশ অ্যালায়েন্স' জোট এবং বাংলাদেশ সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ ফ্ল্যাগশিপ প্রোগ্রাম এটুআইর এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, প্রচলিত সব লেনদেনে ডিজিটাল পরিশোধ নিশ্চিত করতে পারলে দেশের বার্ষিক মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ১ দশমিক ৭ শতাংশ বাড়বে। টাকার অঙ্কে যা ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। আশার কথা, নানা সীমাবদ্ধতা থাকলেও ডিজিটাল লেনদেন বাড়ছে। ব্যাংকিং ভীতির কারণে সিন্দুক, বাঁশের চালা, আলমারি কিংবা বালিশের নিচে টাকা রাখার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসছেন অনেকে। মানুষ ব্যাংকমুখী হচ্ছে। অন্যদিকে, মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, অ্যাপ, কার্ড, অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মতো ডিজিটাল মাধ্যম জনপ্রিয় হচ্ছে।
ডিজিটাল লেনদেনে উৎসাহ দিতে নানা ফিচার যুক্ত করেছে সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। অবশ্য সবাইকে কবে নাগাদ ডিজিটাল ইকো সিস্টেমে আনা যাবে, তা বলা মুশকিল। কেননা একদিকে সুযোগের ঘাটতি আছে, অনেকে এতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেননি। এর বাইরে একটি পক্ষ আছে, যারা ইচ্ছা করেই ডিজিটাল লেনদেন এড়িয়ে চলেন। বিশেষ করে যারা রাজস্ব ফাঁকি দিতে চান। আবার ঘুষ-দুর্নীতি, সন্ত্রাস বা জঙ্গি অর্থায়নের মতো লেনদেনের তথ্য লুকাতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নগদে পরিশোধ হয়।
বিশ্বের অনেক দেশ এখন 'ক্যাশলেস সোসাইটি'তে পরিণত হয়েছে। এর মানে, সব পর্যায়ে ডিজিটাল পরিশোধ বাধ্যতামূলক। কোনো কোনো দেশ নগদ লেনদেন নূ্যনতম পর্যায়ে এনেছে যা 'লেস ক্যাশ' হিসেবে বিবেচিত। তবে এসব দেশে গ্রাহক বা মার্চেন্ট চাইলে সব ধরনের পরিশোধ ডিজিটাল মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে পারেন। এসব দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডিজিটাল পরিশোধ বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশও চাচ্ছে লেস ক্যাশের দিকে যেতে। এ ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে দিয়েছে করোনার সংক্রমণ।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, ডিজিটাল লেনদেন দিনে-দিনে বাড়ছে। বিশেষ করে করোনা আসার পর ডিজিটাল লেনদেনের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। গ্রাহক আকর্ষণে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন অফার দিচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকেও প্রণোদনামূলক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এমন করা যেতে পারে, যিনি ডিজিটালি কর কিংবা সরকারি সেবামূল্য পরিশোধ করবেন, তিনি ছাড় পাবেন। তিনি বলেন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ডিজিটাল লেনদেনের বিভিন্ন পণ্য এনেছে। ডিজিটালি ঋণ প্রক্রিয়াকরণের নানা উদ্যোগ চলমান আছে। তবে কার্ডভিত্তিক লেনদেন যত এগিয়েছে, ঋণের বিষয়টি তত এগোতে পারেনি। দ্রুততম সময়ে ব্যাংকগুলো সেদিকে এগোচ্ছে। এখন দরকার ব্যবহারকারীর অভ্যস্ততা।
সংশ্নিষ্টরা জানান, ডিজিটাল পরিশোধের জন্য পুরো ইকো সিস্টেমকে ডিজিটাইজড হতে হবে। ডিজিটাল পরিশোধে আগ্রহীরা রিকশা-বাস ভাড়া, মুদি দোকান ও রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে যে কোনো বিল ডিজিটালি পরিশোধ করতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে। শুরুতে এটি সুযোগ হিসেবে থাকলেও আস্তে আস্তে সবার জন্য বাধ্যতামূলক করতে হবে। তবে বাংলাদেশ এখনও অনেকে পেছনে। হাতেগোনা কিছু বড় শপিংমল, ব্র্যান্ডশপ বা চেইন শপে গিয়ে ডিজিটাল পরিশোধ করতে পারেন গ্রাহক। বড় কিছু হাসপাতাল, হোটেল-রেস্তোরাঁয় ডিজিটাল পরিশোধের ব্যবস্থা থাকলেও দেশের বড় অংশই রয়েছে এর বাইরে। ঢাকা শহরেও বেশিরভাগ ভাড়াটিয়া চাইলেও বাড়ি ভাড়া ডিজিটালি পরিশোধ করতে পারেন না। তবে বড় পরিবর্তন এসেছে সরকারি বিভিন্ন ইউটিলিটি বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে। এখন গ্রাম থেকে শহরে বড় একটি অংশই এমএফএস, ব্যাংক বা ই-ওয়ালেট থেকে বিল পরিশোধ করছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে শুধু এমএফএসের মাধ্যমে এক কোটি ১০ লাখের বেশি ইউটিলিটি বিল পরিশোধ হয়েছে। যেখানে অর্থের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৫ কোটি টাকা। করোনা শুরুর আগে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৩৭ লাখের কম হিসাব থেকে ৪৪১ কোটি টাকা এ মাধ্যমে পরিশোধ হয়েছিল।
অগ্রগতির পরিসংখ্যান :ব্যক্তি পর্যায়ে ডিজিটাল পরিশোধের সবচেয়ে বড় মাধ্যম এখন মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস)। গত ফেব্রুয়ারি মাসে এ মাধ্যমে ৬৮ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যেখানে লেনদেন ছিল ৪১ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। বর্তমানে ১১ কোটির বেশি এমএফএস হিসাব রয়েছে। যেখানে সক্রিয় হিসাব প্রায় ৪ কোটি। ডিজিটাল পরিশোধের আরেক অনুষঙ্গ ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের গ্রাহক রয়েছে ৪৭ লাখের মতো। ইন্টারনেট ব্যাংকিং থেকে প্রতি মাসে ২০ হাজার কোটি টাকার মতো লেনদেন হচ্ছে। করোনা শুরুর আগে গ্রাহক ছিল ২৬ লাখের মতো। যেখানে প্রতি মাসে ৬ হাজার কোটি টাকার মতো লেনদেন হতো। সারাদেশে এখন ১৩ হাজারের মতো এটিএম বুথ, ৯৩ হাজার পয়েন্ট অব সেলস, ১৭শর মতো ক্যাশ ডিপোজিট মেশিন এবং ১৩শর মতো ক্যাশ রিসাইক্লিং মেশিন রয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংকগুলো সব মিলিয়ে ২ কোটি ৯২ লাখের বেশি কার্ড ইস্যু করেছে। কার্ড ব্যবহার করে গত ফেব্রুয়ারিতে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে যেখানে ২ কোটি ১৬ লাখ কার্ড ছিল। তখন লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া নিজ ব্যাংক থেকে তো অনলাইনে বিভিন্ন পরিশোধ হচ্ছেই। আবার আন্তঃব্যাংক এটিএম বুথ, পয়েন্ট অব সেলস এবং ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ে লেনদেন অনেক বেড়েছে। গত মার্চ মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে শুধু আন্তঃব্যাংকেই ৭ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। করোনা শুরুর আগের মাসে যেখানে ২ হাজার ১০ কোটি টাকা লেনদেন হয়।
ব্যক্তি পর্যায়ের এসব ডিজিটাল লেনদেনের বাইরে ব্যবসায়িক পরিশোধের উল্লেখযোগ্য অংশ এখন অনলাইনে হচ্ছে। আন্তঃব্যাংক লেনদেন নিষ্পত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকে স্থাপিত ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচের বাইরে তিন ধরনের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে প্রতি মাসে ৬ লাখ কোটি টাকার মতো লেনদেন হচ্ছে। অবশ্য এসব লেনদেন নিষ্পত্তিতে এখনও সশরীরে শাখায় গিয়ে চেক বা ইনস্ট্রুমেন্ট জমার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যে কারণে এটিকে ডিজিটাল লেনদেন বলা হয় না। বর্তমানে অনলাইন লেনদেনের সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম রিয়েলটাইম গ্রস সেটেলমেন্ট (আরটিজিএস)। গত মার্চে এ মাধ্যমে ৩ লাখ ৭৯ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। বাংলাদেশ অটোমেটেড চেক প্রসেসিং সিস্টেমে বর্তমানে গড়ে দেড় লাখ কোটি টাকা এবং অটোমেটেড ক্লিয়ারিং হাউসের মাধ্যমে ৫০ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে।
একজন ফুটপাতের দোকানিও যেন এমএফএসের মাধ্যমে পরিশোধ নিতে পারেন, সেজন্য বেশ আগে শুধু এনআইডির কপি দিয়ে ব্যবসায়িক হিসাব খোলার সুযোগ দেওয়া হয়। এখন নতুন করে ব্যক্তি হিসাবেও যতবার খুশি লেনদেন করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ফলে ফুটপাতের একজন দোকানি চাইলে দিনে ৩০ হাজার টাকা এবং মাসে ২ লাখ টাকা ব্যক্তি হিসাব ব্যবহার করে নিতে পারবেন। আবার আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক প্রত্যেককে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ জন্য ২০২৬ সালের মধ্যে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে প্রত্যেকের অন্তত একটি অ্যাকাউন্ট খোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। শুধু যে ব্যাংকে এই অ্যাকাউন্ট থাকবে তেমন নয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বীমা, এমএফএস কিংবা সমবায় যে কোনো প্রতিষ্ঠানে অ্যাকাউন্ট খোলা হবে। এ সিদ্ধান্ত কার্যকরের জন্য আর্থিক শিক্ষার প্রসার ও সেবা সহজ করতে কাজ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। জাতীয় আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কৌশল (এনএফআইএস) বাস্তবায়নের জন্য এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সম্ভাবনা ব্যাপক :এটুআই পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ডিজিটাল পেমেন্ট নিশ্চিত করা হলে মোট ডিজিপিতে যে মূল্য সংযোজন হবে, তার ৫৩ শতাংশ আসবে ক্ষুদ্র পর্যায়ে মাইক্রো-মার্চেন্ট লেনদেন থেকে। ৪৫ শতাংশ কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে। বাকি ২ শতাংশ আসবে তৈরি পোশাকের (আরএমজি) অনানুষ্ঠানিক খাতে ডিজিটালি মজুরি দেওয়ার মাধ্যমে। নানা সীমাবদ্ধতা থাকলেও এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প অর্জনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির সঙ্গে ডিজিটাল লেনদেন গত পাঁচ বছরে প্রায় চার গুণ বেড়ে ২০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যার ফলে ডিজিটালভাবে সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা, মজুরি এবং করোনার প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থ নাগরিক ও শিল্পের সঙ্গে সংশ্নিষ্টদের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।
জাতিসংঘের নেতৃত্বে 'বেটার দ্যান ক্যাশ অ্যালায়েন্স' জোট এবং বাংলাদেশ সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ ফ্ল্যাগশিপ প্রোগ্রাম এটুআইর এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, প্রচলিত সব লেনদেনে ডিজিটাল পরিশোধ নিশ্চিত করতে পারলে দেশের বার্ষিক মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ১ দশমিক ৭ শতাংশ বাড়বে। টাকার অঙ্কে যা ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। আশার কথা, নানা সীমাবদ্ধতা থাকলেও ডিজিটাল লেনদেন বাড়ছে। ব্যাংকিং ভীতির কারণে সিন্দুক, বাঁশের চালা, আলমারি কিংবা বালিশের নিচে টাকা রাখার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসছেন অনেকে। মানুষ ব্যাংকমুখী হচ্ছে। অন্যদিকে, মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, অ্যাপ, কার্ড, অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মতো ডিজিটাল মাধ্যম জনপ্রিয় হচ্ছে।
ডিজিটাল লেনদেনে উৎসাহ দিতে নানা ফিচার যুক্ত করেছে সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। অবশ্য সবাইকে কবে নাগাদ ডিজিটাল ইকো সিস্টেমে আনা যাবে, তা বলা মুশকিল। কেননা একদিকে সুযোগের ঘাটতি আছে, অনেকে এতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেননি। এর বাইরে একটি পক্ষ আছে, যারা ইচ্ছা করেই ডিজিটাল লেনদেন এড়িয়ে চলেন। বিশেষ করে যারা রাজস্ব ফাঁকি দিতে চান। আবার ঘুষ-দুর্নীতি, সন্ত্রাস বা জঙ্গি অর্থায়নের মতো লেনদেনের তথ্য লুকাতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নগদে পরিশোধ হয়।
বিশ্বের অনেক দেশ এখন 'ক্যাশলেস সোসাইটি'তে পরিণত হয়েছে। এর মানে, সব পর্যায়ে ডিজিটাল পরিশোধ বাধ্যতামূলক। কোনো কোনো দেশ নগদ লেনদেন নূ্যনতম পর্যায়ে এনেছে যা 'লেস ক্যাশ' হিসেবে বিবেচিত। তবে এসব দেশে গ্রাহক বা মার্চেন্ট চাইলে সব ধরনের পরিশোধ ডিজিটাল মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে পারেন। এসব দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডিজিটাল পরিশোধ বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশও চাচ্ছে লেস ক্যাশের দিকে যেতে। এ ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে দিয়েছে করোনার সংক্রমণ।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, ডিজিটাল লেনদেন দিনে-দিনে বাড়ছে। বিশেষ করে করোনা আসার পর ডিজিটাল লেনদেনের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। গ্রাহক আকর্ষণে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন অফার দিচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকেও প্রণোদনামূলক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এমন করা যেতে পারে, যিনি ডিজিটালি কর কিংবা সরকারি সেবামূল্য পরিশোধ করবেন, তিনি ছাড় পাবেন। তিনি বলেন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ডিজিটাল লেনদেনের বিভিন্ন পণ্য এনেছে। ডিজিটালি ঋণ প্রক্রিয়াকরণের নানা উদ্যোগ চলমান আছে। তবে কার্ডভিত্তিক লেনদেন যত এগিয়েছে, ঋণের বিষয়টি তত এগোতে পারেনি। দ্রুততম সময়ে ব্যাংকগুলো সেদিকে এগোচ্ছে। এখন দরকার ব্যবহারকারীর অভ্যস্ততা।
সংশ্নিষ্টরা জানান, ডিজিটাল পরিশোধের জন্য পুরো ইকো সিস্টেমকে ডিজিটাইজড হতে হবে। ডিজিটাল পরিশোধে আগ্রহীরা রিকশা-বাস ভাড়া, মুদি দোকান ও রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে যে কোনো বিল ডিজিটালি পরিশোধ করতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে। শুরুতে এটি সুযোগ হিসেবে থাকলেও আস্তে আস্তে সবার জন্য বাধ্যতামূলক করতে হবে। তবে বাংলাদেশ এখনও অনেকে পেছনে। হাতেগোনা কিছু বড় শপিংমল, ব্র্যান্ডশপ বা চেইন শপে গিয়ে ডিজিটাল পরিশোধ করতে পারেন গ্রাহক। বড় কিছু হাসপাতাল, হোটেল-রেস্তোরাঁয় ডিজিটাল পরিশোধের ব্যবস্থা থাকলেও দেশের বড় অংশই রয়েছে এর বাইরে। ঢাকা শহরেও বেশিরভাগ ভাড়াটিয়া চাইলেও বাড়ি ভাড়া ডিজিটালি পরিশোধ করতে পারেন না। তবে বড় পরিবর্তন এসেছে সরকারি বিভিন্ন ইউটিলিটি বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে। এখন গ্রাম থেকে শহরে বড় একটি অংশই এমএফএস, ব্যাংক বা ই-ওয়ালেট থেকে বিল পরিশোধ করছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে শুধু এমএফএসের মাধ্যমে এক কোটি ১০ লাখের বেশি ইউটিলিটি বিল পরিশোধ হয়েছে। যেখানে অর্থের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৫ কোটি টাকা। করোনা শুরুর আগে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৩৭ লাখের কম হিসাব থেকে ৪৪১ কোটি টাকা এ মাধ্যমে পরিশোধ হয়েছিল।
অগ্রগতির পরিসংখ্যান :ব্যক্তি পর্যায়ে ডিজিটাল পরিশোধের সবচেয়ে বড় মাধ্যম এখন মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস)। গত ফেব্রুয়ারি মাসে এ মাধ্যমে ৬৮ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যেখানে লেনদেন ছিল ৪১ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। বর্তমানে ১১ কোটির বেশি এমএফএস হিসাব রয়েছে। যেখানে সক্রিয় হিসাব প্রায় ৪ কোটি। ডিজিটাল পরিশোধের আরেক অনুষঙ্গ ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের গ্রাহক রয়েছে ৪৭ লাখের মতো। ইন্টারনেট ব্যাংকিং থেকে প্রতি মাসে ২০ হাজার কোটি টাকার মতো লেনদেন হচ্ছে। করোনা শুরুর আগে গ্রাহক ছিল ২৬ লাখের মতো। যেখানে প্রতি মাসে ৬ হাজার কোটি টাকার মতো লেনদেন হতো। সারাদেশে এখন ১৩ হাজারের মতো এটিএম বুথ, ৯৩ হাজার পয়েন্ট অব সেলস, ১৭শর মতো ক্যাশ ডিপোজিট মেশিন এবং ১৩শর মতো ক্যাশ রিসাইক্লিং মেশিন রয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংকগুলো সব মিলিয়ে ২ কোটি ৯২ লাখের বেশি কার্ড ইস্যু করেছে। কার্ড ব্যবহার করে গত ফেব্রুয়ারিতে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে যেখানে ২ কোটি ১৬ লাখ কার্ড ছিল। তখন লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া নিজ ব্যাংক থেকে তো অনলাইনে বিভিন্ন পরিশোধ হচ্ছেই। আবার আন্তঃব্যাংক এটিএম বুথ, পয়েন্ট অব সেলস এবং ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ে লেনদেন অনেক বেড়েছে। গত মার্চ মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে শুধু আন্তঃব্যাংকেই ৭ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। করোনা শুরুর আগের মাসে যেখানে ২ হাজার ১০ কোটি টাকা লেনদেন হয়।
ব্যক্তি পর্যায়ের এসব ডিজিটাল লেনদেনের বাইরে ব্যবসায়িক পরিশোধের উল্লেখযোগ্য অংশ এখন অনলাইনে হচ্ছে। আন্তঃব্যাংক লেনদেন নিষ্পত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকে স্থাপিত ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচের বাইরে তিন ধরনের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে প্রতি মাসে ৬ লাখ কোটি টাকার মতো লেনদেন হচ্ছে। অবশ্য এসব লেনদেন নিষ্পত্তিতে এখনও সশরীরে শাখায় গিয়ে চেক বা ইনস্ট্রুমেন্ট জমার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যে কারণে এটিকে ডিজিটাল লেনদেন বলা হয় না। বর্তমানে অনলাইন লেনদেনের সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম রিয়েলটাইম গ্রস সেটেলমেন্ট (আরটিজিএস)। গত মার্চে এ মাধ্যমে ৩ লাখ ৭৯ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। বাংলাদেশ অটোমেটেড চেক প্রসেসিং সিস্টেমে বর্তমানে গড়ে দেড় লাখ কোটি টাকা এবং অটোমেটেড ক্লিয়ারিং হাউসের মাধ্যমে ৫০ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে।
একজন ফুটপাতের দোকানিও যেন এমএফএসের মাধ্যমে পরিশোধ নিতে পারেন, সেজন্য বেশ আগে শুধু এনআইডির কপি দিয়ে ব্যবসায়িক হিসাব খোলার সুযোগ দেওয়া হয়। এখন নতুন করে ব্যক্তি হিসাবেও যতবার খুশি লেনদেন করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ফলে ফুটপাতের একজন দোকানি চাইলে দিনে ৩০ হাজার টাকা এবং মাসে ২ লাখ টাকা ব্যক্তি হিসাব ব্যবহার করে নিতে পারবেন। আবার আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক প্রত্যেককে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ জন্য ২০২৬ সালের মধ্যে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে প্রত্যেকের অন্তত একটি অ্যাকাউন্ট খোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। শুধু যে ব্যাংকে এই অ্যাকাউন্ট থাকবে তেমন নয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বীমা, এমএফএস কিংবা সমবায় যে কোনো প্রতিষ্ঠানে অ্যাকাউন্ট খোলা হবে। এ সিদ্ধান্ত কার্যকরের জন্য আর্থিক শিক্ষার প্রসার ও সেবা সহজ করতে কাজ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। জাতীয় আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কৌশল (এনএফআইএস) বাস্তবায়নের জন্য এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সম্ভাবনা ব্যাপক :এটুআই পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ডিজিটাল পেমেন্ট নিশ্চিত করা হলে মোট ডিজিপিতে যে মূল্য সংযোজন হবে, তার ৫৩ শতাংশ আসবে ক্ষুদ্র পর্যায়ে মাইক্রো-মার্চেন্ট লেনদেন থেকে। ৪৫ শতাংশ কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে। বাকি ২ শতাংশ আসবে তৈরি পোশাকের (আরএমজি) অনানুষ্ঠানিক খাতে ডিজিটালি মজুরি দেওয়ার মাধ্যমে। নানা সীমাবদ্ধতা থাকলেও এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প অর্জনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির সঙ্গে ডিজিটাল লেনদেন গত পাঁচ বছরে প্রায় চার গুণ বেড়ে ২০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যার ফলে ডিজিটালভাবে সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা, মজুরি এবং করোনার প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থ নাগরিক ও শিল্পের সঙ্গে সংশ্নিষ্টদের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।