ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

বিস্ময়কর

যেভাবে পথ চেনে প্রাণী

যেভাবে পথ চেনে প্রাণী

পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে প্রাণীদের চলাচলের সুবিধার জন্য এ ধরনের ব্রিজ তৈরি করা হচ্ছে ছবি: মাদারশিপ ডট কম

শাহিনা নদী

প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২২ | ১২:০০

শীতের আগমনী সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতি বছরের অক্টোবর থেকে মার্চের শুরু পর্যন্ত বাংলাদেশের বনজঙ্গল আর জলাভূমিগুলো বাসভূমিতে পরিণত হয় আগত অতিথি পাখিদের। কারণ বাংলাদেশের আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। তাই সে সময় হিমালয়, সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, তিব্বতীয় ও মালভূমি থেকে প্রায় ৩০০ প্রজাতির অতিথি পাখির আগমন ঘটে। ঠিক অতিথি পাখির মতো পৃথিবীজুড়ে ঘটে চলছে অন্য পশুপাখিদের স্থানান্তরিত হওয়ার ঘটনাও। ছোট কীটপতঙ্গ থেকে শুরু করে বিশাল নীল তিমি সবাই কোনো না কোনো সময় স্থানান্তরিত হচ্ছে খাদ্য, বাসস্থান ও বংশবৃদ্ধিসহ নানা কারণে। পৃথিবীর প্রায় সব প্রাণী প্রধানত বসবাসের উপযুক্ত আবহাওয়া আর খাদ্যের প্রাচুর্য আছে এমন জায়গার খোঁজেই স্থানান্তরিত হয়। আর্কটিক টার্ন প্রজাতির পাখিরা প্রায় সারা বছরই পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে উড়ে বেড়ায় শুধু উষ্ণ অঞ্চলের খোঁজে। ধারণা করা হয়, এক বছরে প্রায় ২৫ হাজার মাইল পথজুড়ে তারা স্থানান্তরিত হয়। পাখিরা যে পথ অনুসরণ করে উড়ে চলে তাকে বলা হয় ফ্লাইওয়ে। এরা কীভাবে এই ফ্লাইওয়ে অনুসরণ করে সারা বছর দিক নির্ধারণ করে, তা বিজ্ঞানীদের কাছে এখনও সুস্পষ্ট নয়। ধারণা করা হয়, এদের অভ্যন্তরীণ জিপিএস (Global Positioning Szstem) রয়েছে, যা প্রতিবার গতিপথে একই প্যাটার্ন মেনে চলতে সহায়তা করে। এ ক্ষেত্রে সূর্যকে তারা অনুসরণ করে থাকে। পাখিরা ওড়ার পথে ভূমিতে বিদ্যমান বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যও চিনতে পারে বলে অনেকে ধারণা করেন। পাখিদের অসাধারণ দিক নির্ধারণ ক্ষমতার ক্ষেত্রে চোখ এবং মস্তিস্কের এক বিশেষ অংশের সাহায্যে উত্তর দিক নির্ধারণ করতে পারে এবং এরা পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র ব্যবহার করে দিক নির্ধারণ করতে পারে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে, পাখিরা তাদের ঠোঁটে থাকা স্নায়ু ব্যবহার করে পৃথিবীর সঙ্গে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের তৈরি হওয়া কোণ নির্ণয় করে যে কোনো স্থানে নিজেদের অবস্থান ঠিক করতে পারে। মনার্ক প্রজাতির প্রজাপতি তিন প্রজন্ম ধরে প্রায় ৫ মাসে মেক্সিকো থেকে কানাডাতে যায়। চতুর্থ প্রজন্ম আবার মেক্সিকোতে ফিরে আসে। এভাবে চার প্রজন্মব্যাপী একটি স্থানান্তর চক্র সম্পন্ন করে। এ ছাড়া প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখ ওয়াইল্ডেবিস্ট ও ২ লাখ জেব্রা তানজানিয়া এবং কেনিয়ার মধ্য দিয়ে প্রায় ৩০০ মাইল পথের চক্র অনুসরণ করে; যার মধ্যে কিছু বিপজ্জনক অঞ্চলও রয়েছে। দিক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে পশুপাখিদের যেহেতু দিক নির্ণায়ক কম্পাস, মানচিত্র, রাস্তাচিহ্ন অথবা জিপিএস নেই, সে জন্য তাদের কিছু ভিন্ন বৈচিত্র্যময় পন্থা অবলম্বন করতে হয়। কোনো কোনো প্রাণী জিনগতভাবে তাদের পূর্ব প্রজন্ম থেকে, কোনোটি আবার ভূমিতে বিভিন্ন নদী, নালা, পাহাড় ইত্যাদি মনে রেখে পথ খুঁজে বের করতে পারে। স্থানান্তরের ক্ষেত্রে দিক নির্ণয়ের বিষয়টি কোনো কোনো প্রজাতিতে সহজাতভাবেই থাকে। এ ছাড়া চন্দ্র-সূর্য, নক্ষত্রের অবস্থান দেখেও এরা দিক নির্ণয় করে থাকে। পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র প্রাণীদের দিক নির্ধারণে বিশেষ ভূমিকা রাখে। অনেক প্রাণী ঘ্রাণ ব্যবহার করে দিক নির্ধারণ করে। ধ্রুবতারাসহ উজ্জ্বল তারাগুলো কোনো কোনো পশুপাখি চিনতে পারে। জলচর প্রাণীরা স্রোতের দিক অনুসরণ করে বিভিন্ন জায়গায় যায়। প্রাণীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যমেও দিক নির্ণয়ে সহায়তা করে। স্থানান্তরের ক্ষেত্রে দেহের সারকাডিয়ান ছন্দও (Circardian rhythm) বিশেষ ভূমিকা রাখে। এর মাধমে তারা বুঝতে পারে কখন স্থানান্তর হতে হবে। প্রাণীর স্থানান্তরের পথে বিভিন্ন বাধার সৃষ্টি করছে মানুষ। এদের স্থানান্তরের পথে রাস্তা, আবাদি জমি নির্মাণ বা খাদ্যের জোগান ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করে তা কমিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে প্রাণীদের চলাচলের সুবিধার জন্য এ ধরনের ব্রিজ তৈরি করা হচ্ছে। যার মাধ্যমে রাস্তা পারাপারের সময় দুর্ঘটনায় পশুর মৃত্যুহার আগের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে। পশুপাখি জগতের স্থানান্তরের ঘটনাগুলো পৃথিবীতে প্রাণের বৈচিত্র্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। তাই মানুষের সঙ্গে অন্যান্য প্রাণীর সুষ্ঠু সহাবস্থানের জন্য আমাদের অনেক যত্নবান ও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন।

আরও পড়ুন

×