ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

প্রতিকারের আগে দরকার প্রতিবাদ

প্রতিকারের আগে দরকার প্রতিবাদ

ইমরান হোসেন

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০২ জুলাই ২০২২ | ২২:৪৮

নারীর প্রতি সহিংসতা এবং নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে চলেছে। তা স্থান-কাল-পাত্রভেদে নয়, বরং সর্বব্যাপী রূপ ধারণ করেছে। নারী যেমন ঘরে নির্যাতিত হচ্ছেন, তেমনি বাইরে নির্যাতিত হচ্ছেন। ঘরে যেমন সহিংসতার শিকার হচ্ছেন, তেমনি বাইরে বা কর্মক্ষেত্রেও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এ অবস্থায় প্রতিকার জরুরি, তবে আগে দরকার প্রতিবাদ। প্রতিকার হচ্ছে কোনো কিছু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পর সেটি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার প্রচেষ্টা, অন্যদিকে প্রতিবাদ হচ্ছে প্রত্যক্ষ কোনো ঘটনার ওপর আপত্তি অথবা সেটির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমরা এসব ঘটনায় প্রতিকারের চিন্তায় এতটাই মগ্ন, প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। বিশেষত করোনাকালে নারীর প্রতি সহিংসতা সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছায়। ধর্ষণও থেমে থাকেনি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে সারাদেশে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ১ হাজার ৩২১ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৭ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৯ জন। ২০২০ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন মোট ১ হাজার ৬২৭ নারী এবং ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪১৩ জন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের দেওয়া তথ্যমতে, শুধু ২০২০ সালে দেশে ১৩৪৬ কন্যাশিশু ও নারী ধর্ষণের ঘটনাসহ মোট ৩৪৪০টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।

পুরুষতন্ত্রের শিকড় আমাদের সমাজে এতটাই বিস্তৃত, নির্যাতনের শিকার নারীরা তাঁদের প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে আইনি সহায়তা প্রদানের বেলায়ও আমরা প্রশাসনের গড়িমসি দেখছি। পুরুষের পাশাপাশি সমান অংশগ্রহণ এবং অধিকারের ক্ষেত্রে নারীকে এখনও উপেক্ষিত এবং অবদমিত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়েছে। ঘরে যেমন নারীকে পিতা, ভাই বা স্বামীর আজ্ঞাবহ থাকতে হয়, তেমনি কর্মক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নারীর অংশগ্রহণ সীমিত। গ্রামাঞ্চলে এই প্রতিবাদের ভাষা এতটাই সংকীর্ণ, অনেক ক্ষেত্রে নারীকেই দোষারোপ করে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়।

বাসে, ট্রেনে, লঞ্চসহ বিভিন্ন যানবাহনে কিছু বিকৃত মস্তিস্ক দ্বারা প্রতিনিয়তই নারী যৌন সহিংসতার শিকার হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলেই নারী-পুরুষ উভয়ের সোচ্চার অবস্থান জরুরি। ঘর বা কর্মক্ষেত্রেও নারীকে নিশ্চুপ অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসে সরাসরি অন্যায়ের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সোমা দে বলেন, 'আমাদের সমাজে নারীকে সবসময় চুপ থাকতে বলা হয়। নারীর প্রতি সংঘটিত হওয়া যে কোনো ধরনের সহিংসতাকে ব্যক্তিগত পরিসরে ভাবা হয় এবং প্রতিবাদ ছাড়া চেপে যাওয়ার কথা বলা হয়।

প্রতিবাদ করার কথা চিন্তা করলে তাঁদের সম্মানহানির ভয় দেখানো হয়। পিতৃতান্ত্রিক এই সমাজে অনেক সময় নিপীড়নকারী কাছের লোক হলেও নারীকে চুপ থাকতে হবে- এই সংস্কৃতির চর্চা করা হয়। কিন্তু এ ধরনের সহিংসতা এবং নির্যাতন বন্ধে তাৎক্ষণিকভাবে নারী-পুরুষ উভয়কেই প্রতিবাদ জানাতে হবে। ঘরে, কর্মক্ষেত্রে, পরিবহনে প্রতিটি জায়গায় নারী সহিংসতার শিকার হন। বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের নারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে সহিংসতার প্রতিবাদ করছেন, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ আমরা দেখেছি মি-টু আন্দোলনে।

বাসে নারীর প্রতি সহিংস যৌন নির্যাতন আটকে দিতে চালক, হেলপারদের এই অপরাধের শাস্তি সম্পর্কে অবগত করা এবং জেন্ডার সচেতন চালক, কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া উচিত বলে মনে করেন এই সমাজ বিশ্নেষক।

নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে। তাই নিয়মিত এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং সোচ্চার অবস্থান ব্যক্ত করতে পারলে সর্বস্তরের মানুষের কাছে এক ধরনের সামাজিক সচেতনতা তৈরি হবে, যা নারীর প্রতি সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখবে। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে প্রতিকার জরুরি। তবে অন্যায়, নির্যাতনের শুরুতেই সমাজের সব স্তর থেকে প্রতিবাদ হতে হবে সবার আগে, যা ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের ক্ষেত্র তৈুরি করবে।

আরও পড়ুন

×