চিত্রশিল্পী নীলিমার গল্প

সানজিদা আহমেদ
প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২২ | ১২:০০
'তুই হবি ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার; চিত্রশিল্পী কোনো পেশা নাকি!' আমাদের অনেকের অভিভাবকের কাছ থেকে এ ধরনের কথা প্রায়ই শুনি। চিত্রশিল্পকেই যদি পেশা হিসেবে কেউ নিজের জীবনের জন্য বেছে নেয়, তাহলে এটি হয়ে ওঠে এক বিশাল চ্যালেঞ্জ, যা নিয়েছেন চিত্রশিল্পী নীলিমা সরকার। গত বছর আগস্ট মাসে তার ফলও পেয়েছেন। বাংলাদেশের প্রথম নারী শিল্পী হিসেবে অর্জন করেছেন জার্মানি থেকে প্রদত্ত 'গ্যালারি অনিল পুরস্কার'। ইউরোপের মাটিতে এটিই প্রথম কোনো বাঙালি নারী চিত্রশিল্পীর পুরস্কার অর্জন। ২০২১ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ১০০ জন শিল্পী ওই প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। প্রতিযোগিতার নিয়ম অনুযায়ী, সেরা ১০ জন প্রতিযোগীকে বাছাই করা হয়। তার মধ্য থেকে চূড়ান্ত বাছাইয়ে একজনকে নির্বাচিত করা হয়।
বাংলাদেশের সমাজ কাঠোমোতে একজন নারীর চিত্রশিল্পী হয়ে ওঠার গল্পটা অনেকটা সিনেমার মতোই। প্রতিনিয়ত বাধার সম্মুখীন হন নারীরা। হতে পারে সেটি পরিবার অথবা সহ-চিত্রশিল্পীর কাছ থেকে। নীলিমার গল্পটিও এর ব্যতিক্রম নয়। নীলিমা ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকতে ভালোবাসতেন। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় পত্রিকায় দেখে গেণ্ডারিয়া কচিকাঁচার মেলায় নিজের আঁকা তিনটি ছবি পাঠান, যা পরবর্তী সময়ে বিদেশের মাটিতে প্রদর্শনীর জন্য নির্বাচিত হয়। এর পর থেকে তিনি আরও বেশি উৎসাহ অনুভব করেন। তিনি বিজ্ঞানের ছাত্রী ছিলেন। পরিবারের সদস্যরা হয়তো ভেবেছিলেন, তিনি মেডিকেলে পড়বেন। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিকের পর তিনি নিজেই সিদ্ধান্ত নেন চারুকলায় ভর্তি হওয়ার। তবে পরিবার থেকে নীলিমা এ বিষয়ে সম্পূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছেন।
নীলিমা বলেন, 'মন দিয়ে সততার সঙ্গে কাজ করলে তার ফল আসবেই। সেটি ১০ বা ২০ বছর পরে হলেও আসে।' বিশ্ব জলবায়ু সংকট, পরিবেশদূষণ মূলত এসব বিষয়ে চিত্রকর্মের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করতে চান বলে জানান তিনি।
নীলিমার বাড়ি নেত্রকোনায়। বাংলার লোকজ সংস্কৃতির এক বিশাল ভান্ডার দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল। ভাটির মানুষের লোকজ সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-দিগন্তজোড়া সবুজ ফসলের মাঠ, বর্ষায় অথৈ জলরাশি, নৌকা ভাসিয়ে জারি-সারি আর পালাগানে উদার প্রকৃতির আহ্বান- এসবই ছিল নীলিমার বেড়ে ওঠার সঙ্গী; যা তাঁর জীবনে ফেলেছে এক বড় প্রভাব। নীলিমা বলেন, 'প্রকৃতির পাতায় পাতায় ভালোবাসার ছাপ। প্রকৃতিকে ভালো না বাসলে মানুষ বা তার সৃষ্টি তথা সমাজকে ভালোবাসা যায় না। দায়িত্বশীল অবস্থান থেকেই প্রকৃতিকে ভালোবাসার তাগিদ অনুভব করি। আর সেই শিল্পীত ভাবনার মধ্য দিয়ে সমাজের মলিনতা দূর করতে চাই।'
নীলিমা কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন জলরং দিয়ে। আর পছন্দের থিম হলো 'প্রকৃতি'। প্রকৃতি থিমটি বেছে নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমি প্রকৃতি খুব ভালোবাসি। এই শহরে আমার ব্যস্ত জীবন থেকে যতবারই ছবি আঁকতে গিয়েছি, আমার মন প্রকৃতিকে বিষয় হিসেবে আবিস্কার করেছে। একসময় প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বন্ধুত্ব ছিল। মানুষ প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল ছিল। আজ প্রকৃতি মানুষের ওপর নির্ভরশীল। বিশ্ব জলবায়ু সংকট এবং পরিবেশদূষণের মুখে প্রকৃতি। মানুষ চাইলে প্রকৃতিকে রক্ষা করতে পারে আবার মানুষ চাইলে প্রকৃতিকে ধ্বংস করতে পারে। পরিবেশের ভালো-মন্দ আমাদের মানবিক কাজেরই ফল।'
প্রকৃতি ও শিল্পের নন্দনতত্ত্ব ও তাদের আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে নীলিমা বলেন, 'আমি মনে করি, প্রকৃতি ও শিল্পের নন্দনতত্ত্ব পরস্পরের পরিপূরক। শিল্পের স্বরূপ লক্ষণ হলো আনন্দ। প্রকৃতি থেকে শিল্প সৃষ্টিতে আনন্দ পাই। সহজভাবে বলা যায়, আনন্দজাত তৃপ্তিই হচ্ছে নান্দনিকতা। নান্দনিক কিংবা সৌন্দর্য ছাড়া শিল্প বিকশিত হয় না। মানুষের সবক্ষেত্রে নন্দনতত্ত্বের প্রয়োগ অপরিহার্য, যা মানুষকে সুন্দর করে। পৃথিবীর আদিম মানুষের চিন্তা ও মননের বিকাশ ঘটে চিত্রের মাধ্যমে। সাহিত্য, সংগীত, স্থাপত্য, বিজ্ঞান, দর্শন- এ সবকিছুরই বিকাশ ঘটাতে চিত্রকলা ও সৌন্দর্য-চেতনা কাজ করেছে। পৃথিবীর সৌন্দর্যের যে বিশাল রূপ, লাখো কোটি বছরের এই রূপকে অনুধাবন করা খুবই কঠিন।'
এখন তিনি 'পাতা সিরিজ' নিয়ে কাজ করছেন। তিনি এতে দেখাতে চেয়েছেন প্রকৃতির সঙ্গে মানুষ এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রেম। তিনি বলেন, 'প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে যে নিবিড় সম্পর্ক আছে, তা নিয়ে আমার কাজকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি।'
- বিষয় :
- চিত্রশিল্পী
- প্রেরণা