ঢাকা সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫

ভবে মানুষ-গুরু নিষ্ঠা যার

ভবে মানুষ-গুরু নিষ্ঠা যার

আবু তালহা

প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২২ | ০১:২৪ | আপডেট: ০৯ আগস্ট ২০২২ | ০১:২৪

বাংলাদেশের লোকসাহিত্যের অন্যতম একটি ধারা লোকসংগীত। মানুষের জীবনের কথা, সুখ-দুঃখের কথা ফুটে ওঠে এই সংগীতে। আবহমানকাল ধরে চলে আসা বাংলার জনজীবনের গান, মরমি ভক্তিগীতি, কীর্তন, বাউল এবং লালন ফকির, রাধারমন দত্ত, হাছন রাজা, শাহ আবদুল করিম ও অন্যান্য সাধকের গান আজ আমাদের সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।

কুষ্টিয়ায় বাউল গানের মধ্য দিয়ে লোকসংগীতে সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে ব্যাপকভাবে। বাউলসম্রাট লালন শাহ এ ধারাকে নিয়ে গিয়েছেন এক অনন্য উচ্চতায়। বাউল মূলত বাউল সম্প্রদায়ের গান বাংলা লোকসাহিত্যের একটি বিশেষ অংশ। জীবন দর্শন ও মত বাউল গানের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত। লালন সাঁইয়ের গানের মাধ্যমে উনিশ শতক থেকে বাউল গান ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। কিন্তু লালন সাঁইয়ের নামটি উচ্চারিত হলেই বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার ছেঁউড়িয়া গ্রামের নামটি সবাই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। বাংলাদেশের সাধকশ্রেষ্ঠ লালন সাঁই গ্রামীণ জীবনের ঐতিহ্যিক ভাবধারার মিশ্রণে এমন এক জীবনবিধান ও দর্শন তাঁর রচিত গানের মাধ্যমে রেখে গেছেন, যা অদ্যাবধি প্রবহমান। তবে তাঁর জীবনাচার ও সংগীতের ধারা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বাঙ্গনে অনুসরণীয় ও গবেষণার বিষয়ে পরিণত হয়েছে; বহু দেশে চর্চিত হচ্ছে লালন সাঁইয়ের সংগীতের ঐতিহ্য।

সুফি, দেহ, সৃষ্টি, আত্মা, মন, পরমাত্মা, রূপ-স্বরূপ ইত্যাদি বহু তত্ত্বকথা ও কথার তাঁর গানের শক্তিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। শুধু সুরের-ছন্দের গুণেই লালন কালের সীমা অতিক্রম করছেন তা নয়, তার জীবন-সমাজ জিজ্ঞাসা আজও প্রাসঙ্গিক। সমাজে ভেদাভেদ, গর্ব-অহংকার, বর্ণ-বৈষম্য, হীনমন্যতা, অমানবিক আচরণ লালন মানসে দারুণ ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল। আর সেসব তিনি প্রকাশ করেছেন কথা ও সুরে। সেদিন মানব চরিত্রের যেসব অসঙ্গতির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিলেন, তা আজও বিদ্যমান। ধর্মের নামে ভণ্ডামির দিকে আঙুল তুলে লালন বলছেন, 'ভিতরে লালসার থলি/ উপরে জল ঢালাঢালি/ লালন কয় মন-মুসল্লি/ আসল তোর হয় না মনে।' তিনি আরও বলেছেন, 'এসব দেখি কানার হাটবাজার/বেদ বিধির পর শাস্ত্র কানা/ আরেক কানা মন আমার... সাধু কানা অনবিচারে/মোড়ল কানা চুগলখোরে/ আন্দাজী এক খুঁটি গেড়ে/ চেনে না সীমানা কার।' বোঝাই যায়, ধর্ম-ব্যবসায়ী, বিদ্যা-ব্যবসায়ী এবং সমাজপতিদের কী প্রবল ঘৃণায় তিনি আক্রমণ করেছেন এ গানে।

প্রত্যক্ষ শ্রেণি-শোষণের ইঙ্গিতও তাঁর গানে পাওয়া যায়- 'রাজ্যেশ্বর রাজা যিনি/চোরেরও সে শিরোমণি,/ নালিশ করিব আমি/কোন খানে কার নিকটে।/গেল গেল ধন, মালও নামায়,/খালি ঘর দেখি জমায়...।

মনুষ্যত্বের শাশ্বত বাণী তুলে ধরে এক কবি বলেছিলেন, শুনহ মানুষ ভাই/ সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।'

সেই বাণীর প্রতিধ্বনি তুলে লালন বলছেন, 'এই মানুষে আছে রে মন/ যারে বলে মানুষ রতন কিংবা মানুষ-তত্ত্ব সত্য হয় যার মনে/সে কি অন্য তত্ত্ব মানে।'

আর তাই লালনের সিদ্ধান্ত :মানুষের সাধনাই আসল সাধনা- 'ভবে মানুষ-গুরু নিষ্ঠা যার/ সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার' কিংবা 'ভজ মানুষের চরণ দুটি/ নিত্য বস্তু পাবে খাঁটি...' এই সাধনার মাধ্যমেই পাওয়া যাবে খাঁটি মানুষ- 'সহজ মানুষ ভজে দেখনা রে মন দিব্য-জ্ঞানে/ পাবি রে অমূল্য-নিধি বর্তমানে।'

লোকসংগীতের মৌল ধর্ম আঞ্চলিক পরিভাষাকে সামনে রেখে লালনের সব সৃষ্টির মধ্যেই কুষ্টিয়া জেলার আঞ্চলিক ভাষার বিশেষ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। অনেক বাউল সাধকই গান রচনা করলেও লালনের নামই সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। লালনের কবিত্ব, ভক্তি এবং অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের জন্যই তিনি বস্তুত বাউল সমাজে মুকুটহীন সম্রাটের মর্যাদা লাভ করে থাকেন। লালন শাহের সংগীতের আদলে সৃষ্ট বাউল গান বাংলাদেশ ও ভারতের সীমানা অতিক্রম করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বিশ্বাসীর কাছে লালনসংগীতের বাণী মাহাত্ম্য লোক সুরের ঐন্দ্রজালিক আবেগ সুমধুর কণ্ঠের আবেগময় পরিবেশনার মাধ্যমে হৃদয়গ্রাহী হয়ে ওঠে।

আহ্বায়ক সুহৃদ সমাবেশ, কুষ্টিয়া

আরও পড়ুন

×