ঢাকা সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫

হামার কথা শুনহে তমরা

হামার কথা শুনহে তমরা

এ কে এস রোকন

প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২২ | ০১:৩৮ | আপডেট: ০৯ আগস্ট ২০২২ | ০১:৩৮

গম্ভীরা বাংলার লোকসংগীতের অন্যতম একটি ধারা। পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলা ও বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাতে গম্ভীরার প্রচলন রয়েছে। দলবদ্ধভাবে গাওয়া বর্ণনামূলক এক গানের নাম। মালদহে মুখোশ পরে গম্ভীরা গানের তালে গম্ভীরা নৃত্য পরিবেশন এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে নানা-নাতির চরিত্র খুবই জনপ্রিয়।

ধারণা করা হয়, গম্ভীরা উৎসবের প্রচলন হয়েছে শিবপূজাকে কেন্দ্র করে। মালদহে মূলত চৈত্রসংক্রান্তির শিবপূজা উপলক্ষে বিগত বছরের প্রধান-প্রধান ঘটনাবলি নৃত্য, গীত ও অভিনয়ের মাধ্যমে সমালোচিত হয় এমন অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ে ছোট, বড় তামাশা ও ফুলভাঙা অনুষ্ঠানের গম্ভীরা মুখোশ নৃত্য পরিবেশিত হয়। গম্ভীরা উৎসবের সঙ্গে এ সংগীতের ব্যবহারের পেছনে জাতিগত ও পরিবেশগত প্রভাব রয়েছে। মালদহের গম্ভীরার বিশেষত্ব হলো মুখোশের ব্যবহার। গাছের অংশবিশেষের কিংবা মাটির সাহায্যে মুখোশগুলো তৈরি করে হিন্দু পৌরাণিক চরিত্রের আদলে মুখোশ ব্যবহূত হতো। গম্ভীরা এবং অন্যটি পালা-গম্ভীরা- এ দুই ধরনের গম্ভীরার দেখা মেলে। দেবদেবীকে সম্বোধন করে মানুষ তার সুখ-দুঃখ পরিবেশন করলে তাকে আদ্যের গম্ভীরা এবং নানা-নাতির ভূমিকায় দু'জন ব্যক্তির অভিনয়ের মাধ্যমে কোনো সমস্যা তুলে ধরা হয় পালা-গম্ভীরায়। সামাজিক সুখ-দুঃখের পাশাপাশি সমাজের ভণ্ড নেতাদের ধিক্কার প্রকাশের মাধ্যমও ছিল গম্ভীরা। যেমন- 'হামার কথা শুনহে তমরা/ চাষী মানুষী ল্যাখা পড়া নাই শিখি/তমরা হল্যা শহর কলকাতাবাসী... আমরা হলাম চাষী মানসী/যেই বুলাইছ সেই বুল্যাছি- আইস্যাছে ভোটের পালা/খ্যায়ারা দিমু কাঁচাকলা।'

বাংলাদেশেও গম্ভীরা গানের আসরে শিবের অস্তিত্ব কল্পনা করা হতো। তবে এখন 'নানা-নাতি'র ভূমিকায় অভিনয়ই বেশি জনপ্রিয়। নানার মুখে পাকা দাড়ি, মাথায় মাথাল, পরনে লুঙ্গি; হাতে লাঠি। আর নাতির পোশাক ছেঁড়া গেঞ্জি, কোমরে গামছা ইত্যাদি। চাঁপাইনবাবগঞ্জের একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের গ্রামের ছবিই ফুটিয়ে তোলা হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষা দিয়ে। 'নানা-নাতি'র সংলাপ ও গানের মধ্য দিয়ে দ্বৈতভাবে গম্ভীরা গান পরিবেশিত হয়। এক সময় গম্ভীরা গান একতাল, ত্রিতাল, দাদরা, খেমটা, কাহারবা প্রভৃতি সুরে গাওয়া হতো। বর্তমানে সুরের পরিবর্তন ঘটেছে। এ ছাড়া লোকনাট্যের বহু বিষয়, চরিত্র ও সংলাপও গম্ভীরা গানে সংযুক্ত হয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক বিষয়ের প্রতিবাদে বিক্ষোভ গম্ভীরা এখন সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর। বর্তমানে সরকারি প্রকল্পগুলোর ভালো দিক তুলে ধরার পাশাপাশি সামাজিক প্রথাগুলোর বিরুদ্ধেও গম্ভীরা শিল্পীরা যথেষ্ট সরব ভূমিকা রাখছেন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের কুতুবুল আলম, রকিবউদ্দীন, বীরেন ঘোষ, মাহবুবুল আলম, মানি রহমান প্রমুখ গম্ভীরা গানের বিশিষ্ট শিল্পী। তারা নতুন নতুন সুর সৃষ্টির মাধ্যমে গম্ভীরা গানকে সারাদেশে জনপ্রিয় করে তুলেছেন। তবে বর্তমানে আরও অনেক নতুন নতুন শিল্পী এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। দলের সদস্য সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বছরের বিভিন্ন সময়ে মিলছে গম্ভীরা গানের বরাত। বেশি সংখ্যক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে একটি দল ভেঙে দুটি দল তৈরি করেছেন তাঁরা। প্রতিটি দলের ৮-১০ জন করে সদস্য রয়েছেন।

বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও আদিনা ফজলুল হক সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাজহারুল ইসলাম তরু জানান, গম্ভীরা একদিকে যেমন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, তেমনি যেনতেনভাবে গড়ে উঠছে গম্ভীরা দল। এতে করে ঐতিহ্যবাহী গম্ভীরার বিকৃতি ঘটছে। তা ছাড়া এর শিল্পীরা কোনো অনুদান বা তেমন একটা পারিশ্রমিক না পাওয়ায় শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।

উপদেষ্টা সুহৃদ সমাবেশ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ

আরও পড়ুন

×