গ্র্যামির পথে প্রথম বাংলাদেশি
-samakal-6382ecb107b64.jpg)
রোমাঞ্চ তালুকদার
প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০২২ | ২২:৫১
গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডসের ৬৫তম আসরে মনোনয়ন পেয়েছে বার্কলে ইন্ডিয়ান অনসাম্বলের প্রথম অ্যালবাম 'শুরুয়াত'। এই অ্যালবামে রয়েছে বাংলাদেশের তরুণ কণ্ঠশিল্পী আরমীন মুসার গাওয়া এবং তাঁর মা প্রখ্যাত নজরুল সংগীতশিল্পী নাশিদ কামালের লেখা গান 'জাগো পিয়া'। এই মনোনয়নের মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো সংগীতবিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদার আসরে বাংলাদেশকে পৌঁছে দিলেন তাঁরা। 'শুরুয়াত' মনোনয়ন পেয়েছে 'বেস্ট গ্লোবাল মিউজিক অ্যালবাম' ক্যাটাগরিতে, যেখানে সেরা পুরস্কারের জন্য লড়বে আরও চারটি অ্যালবাম। লস অ্যাঞ্জেলেসের ক্রিপটো অ্যারেনায় গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডসের ৬৫তম আসর বসবে আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি।
জাগো পিয়া, শুরুয়াত ও বাঙালি সংস্কৃতি
জাগো পিয়া গানটির কথা এমন-
গতকালের কথাগুলো পেছন ফেলে চলো/ রবির কিরণ চোখে মাখিয়ে নতুন আগুনে জ্বলো/ সামনে আসে/ নতুন দিনের আগমনী বলো/ জাগো পিয়া আর ঘুমাইও না হৃদয়ে সুর তোলো...।
২০১৬ সালের এপ্রিলে আরমীনের কণ্ঠে প্রকাশিত হয় 'জাগো পিয়া' গানটি। পরে আয়োজকরা এ বছরে প্রকাশিত 'শুরুয়াত' অ্যালবামে তা যুক্ত করেন। এই অ্যালবামে ওস্তাদ জাকির হোসেন, শ্রেয়া ঘোষাল, শঙ্কর মহাদেবন, বিজয় প্রকাশের মতো নামি সুরকার-শিল্পীদের ১০টি গান রয়েছে। আরমীনের সঙ্গে বিশ্বের ১৭ দেশের শিল্পী, যন্ত্রশিল্পী ও কলাকুশলী 'জাগো পিয়া' গানে কাজ করেছেন। গানের ভিডিওতে, কথা ও সুরের সঙ্গে শিল্পী, যন্ত্রশিল্পীদের পোশাকে বাঙালি সংস্কৃতিকে তুলে ধরা হয়েছে। কাঁধে গামছা ঝুলিয়ে জর্ডানের ভায়োলিন বাদক লাইথ সাদিককে ভায়োলিনে বুঁদ হয়ে থাকতে দেখা গেছে; চেন্নাইয়ের সাঞ্জানা রাজা থেকে সুইজারল্যান্ডের রাইদিয়া রেনোল্ড, মালয়েশিয়ার জোনাথন লি থেকে ইসরায়েলের জোগেব গাবি- সবাই নিজেকে সাজিয়েছেন বাঙালির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠা গামছায়। হয়তো এ জন্যই গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডসের মনোনয়নের তালিকায় 'শুরুয়াত'-এর নাম আসার পর অ্যালবামের বাকি গান ছাপিয়ে 'জাগো পিয়া' নিয়েই আলোচনা চলছে সবচেয়ে বেশি!
একটু পেছনে ফিরে
অ্যালবামটি চলতি বছর প্রকাশিত হলেও আরমীনের গানটি প্রকাশিত হয় প্রায় ছয় বছর আগে। আরমীন তখন বার্কলে কলেজ অব মিউজিক থেকে মাত্র পড়াশোনা শেষ করেছেন। সিলেবাসের অংশ হিসেবেই একটি মৌলিক গান করতে বলা হয় আরমীনকে। নিজের ভাষাকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে বাংলায় গানটি করার পরিকল্পনা করেন আরমীন। গানটি তৈরি হওয়ার পেছনেও আছে এক মজার গল্প। আরমীন গানটির সুর তুলে মা নাশিদ কামালের কাছে একটি গান লিখে দিতে বলেন। নাশিদ কামাল তখন সিনেমা দেখছিলেন। সুর শুনেই মায়ের ভাবনায় এলো- 'জাগো জাগো'। মেয়েকে উৎসাহ দিতে গানের কথার মধ্যে বললেন, 'গতকালের কথাগুলো ফেলে রাখো'। এরপর মাত্র আড়াই মিনিটেই গীতিকথা নতুন করে সাজিয়ে দেন মা নাশিদ কামাল। আর সেই আড়াই মিনিটের গানই বাংলাদেশকে নিয়ে গেল গ্র্যামির মঞ্চে! গানটিতে মূলত মানুষের এগিয়ে যাওয়ার বার্তা দিতে চেয়েছেন এর গীতিকবি।
শিকড়ের সন্ধানে
লোকগীতির কিংবদন্তি শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদকে কে না চেনে! সেই কিংবদন্তির নাতনি নাশিদ কামাল। আলোচিত এই নজরুল সংগীতশিল্পী জনসংখ্যাতত্ত্বের অধ্যাপক হলেও গান নিয়েই তাঁর ওঠাবসা। তিনি একাধারে কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার এবং সুরকারও। চার দশকের বেশি সময় ধরে তিনি যুক্ত সংগীতের সঙ্গে। তাঁর মেয়ে আরমীন মুসা সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী এবং বার্কলে কলেজ অব মিউজিকের বাংলাদেশি ছাত্রী ও ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে বিশ্বভারতীর প্রশিক্ষণার্থী। 'ভ্রমর কইও গিয়া', 'লোনা দেয়াল'সহ বেশ কয়েকটি গানের জন্য সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি। আরমীন গান করেন, গান লেখেন এবং সংগীত পরিচালনা করেন।
অনুপ্রেরণার নাম মা
গীতিকার ও শিল্পী আরমীন মুসা ২০০৮ সালে তাঁর প্রথম অ্যালবাম 'আয় ঘুম ভাঙাই' দিয়ে সংগীত যাত্রা শুরু করেন। নিজেকে পরিশ্রমী ও আত্মবিশ্বাসী ভাবা এই শিল্পীর ভাষায়, 'আমি কিছু একটা খুঁজে চলেছি যেটা এখনও খুঁজে পাইনি।' তবে তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা মনে করেন মাকে। তাঁর ভাষায়, 'আমি আসলে মাপাগল একটা মেয়ে। মা আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। মায়ের কাছে জীবন মানেই গান। তাঁর যাপিত জীবনের পুরোটাই কেবল গান নিয়ে। আমার শিল্পীজীবনকেও প্রভাবিত করেছেন মা। মাকে আমি সব সময় সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা মানুষ হিসেবেই দেখে আসছি। তাই বলি, আমার অনুপ্রেরণার পুরোটা জুড়েই আমার মা।'
আরমীন ইন দ্য গ্রাস হপার ও ঘাসফড়িং কয়্যার
গানে বেড়ে ওঠা আরমীন সেই এইটুকুন বয়সে বন্ধুদের নিয়ে 'আরমীন ইন দ্য গ্রাস হপার' নামে ব্যান্ড দল গড়ে তুলেছিলেন। এই সময়ে এসেও ভুলতে পারেননি ব্যান্ডের সেই নাম। তাই তো নতুন মোড়কে তাঁর গানের দলের নাম দেন 'ঘাসফড়িং কয়্যার'।
ব্যস্ততা ও আগামীর স্বপ্ন
ব্যস্ততা যেন তাড়া করে বেড়ায় আরমীনকে। তাই তো ডুবে থাকেন রাজ্যের কাজে। চলতি বছরের ২৪ জুলাই প্রকাশ হয় তাঁর অ্যালবাম 'লাইভ ফ্রম স্পেস'। সেই অ্যালবাম থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে একটি করে নতুন গান প্রকাশ করেছেন আরমীন। সামনেও এমন কাজ চালিয়ে যেতে চান তিনি। সেই সঙ্গে কবিতা লিখছেন এবং নিয়মিত আবৃত্তি চর্চাও চালিয়ে যাচ্ছেন। আর গানের দল ঘাসফড়িং কয়্যার নিয়ে অ্যালবামের কথাও ভাবছেন। আরমীন আপাদমস্তক গানের মানুষ। তাই গান নিয়েই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। ভবিষ্যতে শ্রেতাদের আরও ভালো গান উপহার দিতে চান তিনি। তবে কভিড-পরবর্তী সময়ে তাঁর মনের জগতে এক বিশাল পরিবর্তন আসে এবং এ নিয়েই কবিতা লেখা শুরু করেন। আগামীতে কবিতা নিয়েও কাজ করতে চান এই স্বপ্নবাজ!
- বিষয় :
- গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডস
- আরমীন মুসা