হাইকোর্টের রায়
নারীর অভিভাবকত্বের মর্যাদা

শাহেরীন আরাফাত
প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০২৩ | ০৫:০৬
সোনিয়ার (ছদ্মনাম) যখন এক বছর বয়স, তখন তার মা ফারজানা ও বাবা সালামের বিচ্ছেদ হয়। মায়ের সঙ্গেই বড় হয় সে। স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় প্রথম সমস্যার মুখে পড়তে হয় তাকে। অভিভাবক হিসেবে বাবার জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি লাগবে। যে মানুষটি সন্তানের কোনো খোঁজ পর্যন্ত নেননি পাঁচ বছর ধরে, তিনিই হলেন সোনিয়ার অভিভাবক। বাধ্য হয়ে সোনিয়ার মা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এনআইডির কপি দেওয়ার জন্য রাজি করাতে বেশ কিছুটা সময় চলে গেল। কিন্তু এর মধ্যেই স্কুলে ভর্তির সময় শেষ। স্কুলে ভর্তি হওয়া এক বছর পিছিয়ে গেল সোনিয়ার।
ফারজানা বলেন, সোনিয়ার বাবা আমার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর থেকে আমাদের কোনো খোঁজ নেয়নি। সে নতুন সংসার করেছে। এ নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথাও নেই। জন্ম থেকে সোনিয়ার সব দায়িত্ব আমি পালন করেছি। অথচ আমি অভিভাবক হতে পারি না। এ রায় আগে হলে স্কুলে সোনিয়ার একটা বছর নষ্ট হতো না।
পারভীনের (ছদ্মনাম) তখন ২৬ বছর বয়স, একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজ করতেন। সম্পর্ক গড়ে ওঠে এক সহকর্মীর সঙ্গে। এক পর্যায়ে ওই ছেলে বিদেশে চলে যায়। কিছুদিন পর পারভীন জানতে পারেন- তিনি অন্তঃসত্ত্বা। ডাক্তার জানান, গর্ভপাতের সুযোগ নেই; এতে পারভীনের প্রাণশঙ্কা রয়েছে। পারভীনের বড় ভাই তাঁকে সিলেটে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানেই সন্তানের জন্ম হয়। সমাজের উঁচু শ্রেণিতে বাস করেও পারভীন একক মা হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন না। শেষ পর্যন্ত সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এক নিঃসন্তান দম্পতির হাতে তুলে দেন নিজের সন্তানকে।
শায়লার (৫০) বিচ্ছেদ হয় প্রায় ২০ বছর আগে। আর বিয়ে করেননি। দুই ছেলেকে অনেক সংগ্রাম করে লেখাপড়া করিয়েছেন। কোথাও বাবার নাম দিয়েছেন, আবার কোথাও এড়িয়ে গেছেন। দুই ছেলেই এখন ভালো চাকরি করছেন।
যুগের পর যুগ শিক্ষার ক্ষেত্রে পিতৃপরিচয় বাধ্যতামূলক ছিল। সবখানেই ছেলেমেয়ের বাবার নাম চাওয়া হয়। এ ঘটনাগুলো সবার সামনেই ঘটেছে। মেনে নিতে হয়েছে। কারণ, এখানে শুধু সামাজিক রীতি ছিল না; এটি ছিল আইনি কাঠামোর অংশ। এবার সেই আইনটাই বদলে গেল আদালতের এক রায়ে। এর প্রভাব তো সমাজে পড়বেই। শায়লা বলেন, 'সমাজে বাবা যা করেন, মায়ের দায়দায়িত্ব কোনো অংশে কম না; বরং মা অনেক ক্ষেত্রে বেশি দায়িত্ব পালন করেন। উচ্চ আদালতের এ রায় আমাদের জন্য যুগান্তকারী।'
ব্লাস্ট ২০২১ সালের ৬ জুন আবেদনকারীদের পক্ষে মামলা সম্পর্কিত তথ্য আদালতে পেশ করে। শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে বাবার নাম বাধ্যতামূলকভাবে উল্লেখ করার বিধানকে সংবিধানের ১৫(ক) (মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা), ২৮(৪) (ধর্ম, প্রভৃতি কারণে বৈষম্য), ৩১ (আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার), ৩২ (জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার রক্ষা) ও ৪০ (পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতা) অনুচ্ছেদের পরিপন্থি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। উল্লেখ্য, শিক্ষা ক্ষেত্রে ফরম পূরণে বাবার নাম বাধ্যতামূলকভাবে উল্লেখের সুনির্দিষ্ট আইনগত কোনো বিধান না থাকা সত্ত্বেও এতকাল ধরে তা বাধ্যতামূলকভাবে উল্লেখ করতে হতো।
মামলা পরিচালনাকারী জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, 'লিঙ্গ বৈষম্যমূলক প্রথা দূরীকরণের ক্ষেত্রে আজকের এই রায়টি যুগান্তকারী। প্রত্যেক ব্যক্তির পরিচয় প্রকাশের অধিকার এবং শিক্ষা লাভের অধিকার নিশ্চিতে এ রায় অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। লিঙ্গভিত্তিক সব বৈষম্য দূরীকরণের সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি পূরণে এবং লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন নিশ্চিতকরণে আজকের এই রায়ের যথাযথ বাস্তবায়ন প্রয়োজন।'
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাশগুপ্ত বলেছেন, 'অনেক সন্তান আছে, যাদের ক্ষেত্রে শুধু পিতার নাম লেখা সম্ভব না। যেমন কেউ যদি রেপ ভিকটিমের সন্তান হয়; আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়েও তো এমন ঘটনা ঘটেছিল। এখন থেকে অভিভাবক হিসেবে যাঁর নাম লিখতে চাইবেন, তাঁর নামই লেখা যাবে। সেটা পিতার নাম হতে পারে, মাতার নাম হতে পারে অথবা আইনগত অভিভাবকের নামও হতে পারে।'
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, 'শিক্ষা ক্ষেত্রে ফরম পূরণে বাবার নাম বাধ্যতামূলকভাবে উল্লেখের সুনির্দিষ্ট আইনগত কোনো বিধান না থাকা সত্ত্বেও এতকাল ধরে মা-বাবার পরিচয়বিহীন শিশুরা শিক্ষা লাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছিল। আশা করা যাচ্ছে, এ যুগান্তকারী রায়ের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সব শিশুর শিক্ষা গ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে এবং আশা করা যাচ্ছে- অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে বৈষম্য নিরসন হবে।'
নারীপক্ষের সদস্য শিরীন হক বলেন, 'এ রায়টি যুগান্তকারী তো বটেই, সেই সঙ্গে সমাজকে ধাক্কা দেওয়ার মতো একটি রায়।
এ রায়ের মানে এ নয় যে, নারীরা এখন থেকে সব ক্ষেত্রে সন্তানের অভিভাবকত্ব পেয়ে গেল। এ রায়ে সরকারি সনদ বা ফরম পূরণের ক্ষেত্রে অভিভাবকত্বের জায়গাটা পেয়েছে নারী। তবে মায়েরা যেন সন্তানের পূর্ণাঙ্গ অভিভাবক হতে পারে, তা অর্জনের পথে এটি একটি বড় পদক্ষেপ। আমাদের আইনে আছে, সন্তানের স্বাভাবিক অভিভাবক পুরুষ। মাকে কিন্তু সেই স্বীকৃতিটা দেওয়া নেই আইনে। তবে এটি সেই স্বীকৃতি আদায়ের পথ সহজতর করবে বলে মনে করি। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে যেভাবে আলোচনা হচ্ছে, সেটি কিন্তু এ রায়ের গুরুত্বকেই তুলে ধরে। সমাজে এর প্রতিফলন কেমন হবে, তা রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর অনেকটা নির্ভর করে। এ রায় যদি শিক্ষা ক্ষেত্রেও কার্যকর করা সম্ভব হয়, এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিবর্তনকে নির্দেশ করবে। আর তা সমাজকে নিশ্চিতভাবেই প্রভাবিত করবে।'