ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

প্রচ্ছদ

জীবনের কথকতা

জীবনের কথকতা

শাহেরীন আরাফাত

প্রকাশ: ১৫ জুন ২০২৩ | ১৮:০০

‘আত্মজীবনী’ শব্দটি প্রথম ইংরেজি সাময়িকী দ্য মান্থলি রিভিউতে ব্যবহার করেন ব্রিটিশ লেখক উইলিয়াম টেলর। সেটি ১৭৯৭ সালের কথা। তিনি শব্দটিকে ‘হাইব্রিড’ অর্থে ব্যবহার করেন। আবার ‘নীতিবাগীশী’ অর্থে নিন্দাও করেন। এরপর ১৮০৯ সালে ব্রিটিশ কবি রবার্ট সাউদি শব্দটির বর্তমান অর্থে ব্যবহার করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ‘আত্মজীবনী’ শব্দটির নামকরণ হলেও প্রথম আত্মজীবনীমূলক লেখার ইতিহাস অনেক পুরোনো। জার্মান সাহিত্যের ইংরেজ অধ্যাপক রয় প্যাসক্যাল আত্মজীবনীকে জার্নাল বা ডায়েরি লেখা থেকে আলাদাভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তাঁর মতে, ‘আত্মজীবনী হলো, কোনো নির্দিষ্ট মুহূর্ত থেকে জীবনের একটি পর্যালোচনা। অপরদিকে ডায়েরি হলো, কিছু পর্যায়ক্রমিক মুহূর্তের ঘটনাপ্রবাহ। জীবনীকাররা সাধারণত বিভিন্ন নথি ও দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে। তবে আত্মজীবনী সম্পূর্ণরূপে লেখকের স্মৃতির ওপর ভিত্তি করে লেখা হয়। আত্মজীবনীতে জীবনের একটা পর্যায় বা রচনার মুহূর্ত পর্যন্ত ব্যক্তির জীবনের উপলব্ধি উঠে আসে। স্মৃতিকথা ও আত্মজীবনী প্রায় একই রকমের হলেও প্যাসক্যালের মতে, সেখানে আত্মজীবনীকারের নিজের জীবনের পর্যালোচনার সময় নিজের দিকে কম এবং অন্যের দিকে বেশি ফোকাস করার প্রবণতা থাকে। সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের মতে, আত্মজীবনী লেখককে ইতিহাস পুনর্নির্মাণের ক্ষমতা প্রদান করে।
আত্মজীবনী বিভিন্ন রকমের হতে পারে। আধ্যাত্মিক আত্মজীবনী হলো, একজন লেখকের সংগ্রাম বা পরম সত্তার দিকে যাত্রার একটি বিবরণ। যেখানে লেখক সেই পরম সত্তার সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার মাধ্যমে ঐশ্বরিক অভিপ্রায়ে জীবনকে নতুন করে সাজিয়েছেন। আধ্যাত্মিক আত্মজীবনীর প্রথম উদাহরণ হলো সেইন্ট অগাস্টিনের (৩৫৪-৪৩০) ‘কনফেশনস’। যদিও ঐতিহ্যটি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর অ্যান অটোবায়োগ্রাফি ও জন জি নেইহার্টের ব্ল্যাক এলক স্পিকসের মতো গ্রন্থগুলোয় অন্যান্য ধর্মীয় ঐতিহ্যকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রসারিত হয়েছে। আধ্যাত্মিক আত্মজীবনী প্রায়ই লেখকের ধর্মীয় অবস্থানের অনুমোদন হিসেবে কাজ করে।
স্মৃতিকথা
চরিত্রগতভাবে স্মৃতিকথা আত্মজীবনী কিছুটা ভিন্ন। যদিও একটি আত্মজীবনী সাধারণত লেখকের জীবন ও সময়ের ওপর ফোকাস করে। স্মৃতিকথায় লেখকের স্মৃতি, অনুভূতি ও আবেগের ওপর একটি সংকীর্ণ, আরও ঘনিষ্ঠ ফোকাস থাকে। রাজনীতিবিদ বা সামরিক নেতারা তাঁদের জনসাধারণের শোষণের বিবরণ প্রকাশ করার উপায় হিসেবে প্রায়ই স্মৃতিকথা লিখেছেন। একটি প্রাথমিক উদাহরণ হলো, জুলিয়াস সিজারের কমেন্টারি ডি বেলো গ্যালিকো, যা গ্যালিক যুদ্ধের মন্তব্য হিসেবেও পরিচিত। সেখানে ৯ বছর ধরে যেসব যুদ্ধ হয়েছিল, তার বর্ণনা করেছেন। তিনি গ্যালিক যুদ্ধে স্থানীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করতে কাটিয়েছিলেন। তাঁর দ্বিতীয় স্মৃতিকথা কমেন্টারি ডি বেলো সিভিলি হলো জিনিয়াস পম্পেয়াস ও সেনেটের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধে ৪৯ থেকে ৪৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিবরণ।
লিওনর লোপেজ ডি কর্ডোবা (১৩৬২-১৪২০) লিখেছিলেন মেমোরিয়াস, যাকে স্প্যানিশ ভাষায় প্রথম আত্মজীবনী বলে মনে করা হয়। ইংরেজ গৃহযুদ্ধে (১৬৪২-১৬৫১) স্যার এডমন্ড লুডলো ও স্যার জন রেরেসবিসহ অনেকেই এমন ধারার বেশ কয়েকটি রচনা দেখা হয়। কাছাকাছি সময়ে ফরাসি ভাষায় কার্ডিনাল ডি রেটজ (১৬১৪-১৬৭৯) ও ডুক ডি সেন্ট-সিমনের (১৬৭৫-১৭৫৫) স্মৃতিকথা উল্লেখযোগ্য।
যুগে যুগে আত্মজীবনী
মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতা জহির উদ্দীন মোহাম্মদ বাবর (১৪৯৩-১৫২৯) একটি আত্মজীবনী ‘বাবরনামা’ লিখেছিলেন। সেখানে বাবরের চিঠি, উপলব্ধি ও মন্তব্য সংকলিত হয়। ওই আত্মজীবনীতে প্রকৃতি, সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রতি বাবরের আগ্রহের প্রতিফলন দেখা যায়। বিভিন্ন ঘটনার প্রাণবন্ত বিবরণ যে কেবল তাঁর নিজের জীবনই নয়, তিনি যে অঞ্চলে বাস করতেন সেখানকার ইতিহাস, ভূগোল এবং সেইসঙ্গে যাঁদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ঘটেছিল তাঁদের কথাও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বইটিতে জ্যোতির্বিদ্যা, ভূগোল, রাষ্ট্রীয় শিল্প, সামরিক বিষয়, অস্ত্র ও যুদ্ধ, গাছপালা, প্রাণী এবং পারিবারিক ইতিহাস যেমন উঠে এসেছে, তেমনি শিল্পকলা, কবিতা, সংগীত, চিত্রকলা, শরাবের আসর, ঐতিহাসিক ভ্রমণ স্মৃতি, মানব প্রকৃতির মতো বিচিত্র বিষয় রয়েছে। চাগতাই বা তুর্কি ভাষায় লেখা বাবরনামা সম্রাট আকবরের আমলে ১৫৮৯ সালে ফারসি ভাষায় অনুবাদ করা হয়। রেনেসাঁ যুগের এক অসামান্য আত্মজীবনীগুলোর মধ্যে একটি হলো ভাস্কর এবং স্বর্ণকার বেনভেনুটো সেলিনির (১৫০০-১৫৭১) ‘ভিটা’। তিনি শুরুতেই লিখেছেন, ‘সে যে ধরনের লোকই হোক না কেন, বড় অর্জনের পথে যাঁর কৃতিত্ব রয়েছে বলে মনে করেন এবং যদি সত্য ও মঙ্গলের প্রতি তাঁর আগ্রহ থাকে, তবে তাঁর নিজের জীবনের গল্প নিজের হাতেই লেখা উচিত। তবে চল্লিশ পেরোনোর আগে কারোরই এমন দুর্দান্ত উদ্যোগ নেওয়া উচিত নয়।’ আত্মজীবনীর এই মানদণ্ড সাধারণভাবে গত শতক পর্যন্ত বজায় ছিল বলে মনে করা হয়। অতিসম্প্রতি আত্মজীবনী লেখার ক্ষেত্রে বয়সের মানদণ্ড মানা হয় না।
ভারতীয় ভাষায় রচিত প্রথম আত্মজীবনীগুলোর মধ্যে একটি ‘অর্ধকথানক’। জৈন ব্যবসায়ী ও কবি বেনারসিদাসের (১৫৮৬-১৬৪৩) এ গ্রন্থে মোগল আমলের অস্থির রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কথা ও সামাজিক অবস্থার বর্ণনা লিপিবদ্ধ করা আছে। আত্মজীবনীটি ব্রজ ভাষায় রচিত হয়েছিল। ব্রজ মূলত হিন্দির একটি প্রাথমিক উপভাষা, মথুরার আশপাশের লোকজন এ ভাষায় কথা বলতেন। বেনারসিদাসের আত্মজীবনীতে তিনি এক অশান্ত যুবক থেকে ধর্মানুভূতিতে রূপান্তর বর্ণনা করেছেন। প্রসঙ্গত, বেনারসিদাস মোগল সম্রাট আকবর, জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের আমলের মানুষ। তিনি ছিলেন মোগল রাজ দরবারে দাবা খেলায় আমন্ত্রিতদের একজন।
ইংরেজিতে লেখা প্রাচীনতম আত্মজীবনী হলো ‘বুক অব মার্জারি কেম্পে’। ১৪৩৮ সালে লেখা এ গ্রন্থে খ্রিষ্টান ধর্মগুরু মার্জারি কেম্পে ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমি ও রোমে তীর্থযাত্রা এবং তাঁর ধর্মীয় অভিজ্ঞতার বর্ণনা রয়েছে। গ্রন্থটির সংক্ষিপ্তসার ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে প্রকাশিত হয়েছিল। পুরো লেখাটি প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৬ সালে। তবে সম্ভবত ইংরেজিতে লেখা প্রথম সর্বজনীনভাবে উপলব্ধ আত্মজীবনী হলো ১৬৩০ সালে প্রকাশিত ক্যাপ্টেন জন স্মিথের আত্মজীবনী।
জ্যাঁ-জ্যাক রুশো ১৮ শতকে কনফেশনস শিরোনামে রোমান্টিক যুগের স্বীকারোক্তিমূলক এক আত্মজীবনী লিখেছেন। এর মধ্য দিয়ে কখনও কখনও জাতিগত ও অত্যন্ত স্বসমালোচনামূলক আত্মজীবনীর ধারা শুরু হয়েছিল। এটি রোমান্টিসিজমের প্রবণতা অনুসরণ করে, যা ব্যক্তির ভূমিকা ও প্রকৃতিকে ব্যাপকভাবে জোর দিয়েছিল। ১৮৩০-এর দশকে স্টেন্ডহালের আত্মজীবনীমূলক লেখা ‘দ্য লাইফ অব হেনরি ব্রুলার্ড’ এবং ‘মেমোয়ার্স অব অ্যান ইগোটিস্ট’ স্পষ্টভাবেই রুশো দ্বারা প্রভাবিত। একটি ইংরেজি উদাহরণ হলো, উইলিয়াম হ্যাজলিটের ‘লিবার অ্যামোরিস’ (১৮২৩), লেখকের প্রেম-জীবনের এক বেদনাদায়ক বাস্তবতা এখানে উঠে আসে।
উনিশ শতকে শিক্ষার উত্থান, সস্তা সংবাদপত্র, সস্তা মুদ্রণ এবং খ্যাতি ও সেলিব্রিটির আধুনিক ধারণাগুলো গড়ে উঠতে শুরু করে। এটি ব্যতিক্রমের পরিবর্তে প্রত্যাশা হয়ে ওঠে যে, জনসাধারণের চোখে তাঁরা নিজেদের সম্পর্কে লিখবেন– শুধু চার্লস ডিকেন্স ও অ্যান্থনি ট্রলোপের মতো লেখকরাই নন, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, আধ্যাত্মিক গুরু এবং বিনোদনকারীরা আত্মজীবনী লেখায় এগিয়ে আসেন। বিংশ শতকে এসে আত্মজীবনী একটি জনপ্রিয় এবং ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য ধারা হয়ে উঠেছে। বিশ্বের অন্যান্য সাহিত্যের মতো বাংলা সাহিত্যেও আত্মজীবনী এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। উনিশ শতকের আগে বাংলা ভাষায় কোনো আত্মজীবনী খোঁজ সেভাবে জানা যায় না। প্রাচীন ও মধ্যযুগের গীতিকবিতায় ভণিতার মাধ্যমে আত্মপরিচয় তুলে ধরার একটা প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে কাহিনিকাব্যে আত্মপরিচয় অনেকটা বিস্তৃত আকারে লেখা হয়েছে। তবে সাহিত্য হিসেবে আত্মজীবনীর যথার্থ প্রকাশ ঘটে উনিশ শতকের গোড়ার দিকে।
রাসসুন্দরী দেবী বাংলায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী লেখক। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নারী লেখকদের একজন। রাসসুন্দরী ১৮০৯ সালে ফরিদপুর জেলার পাতাজিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রথম ভারতীয় নারী ও প্রথম বাঙালি হিসেবে একটি আত্মজীবনী লেখেন। ‘আমার জীবন’ গ্রন্থটি ১৮৬৮ সালে প্রকাশিত হয়।
দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায় (১৮২০-১৮৮৫) আরেকজন প্রথম দিককার আত্মজীবনীকার। উনিশ শতকের মধ্যভাগে তাঁর ‘আত্ম-জীবন চরিত’ গ্রন্থে সেসময়কার সমাজবাস্তবতা উঠে আসে। দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায় গীতিকার, উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পী, গ্রন্থকার। তাঁর জন্ম নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে। প্রথমে ফারসি, পরে ইংরেজি শিক্ষা লাভ করে তিনি কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে গৃহশিক্ষক ও সংগীতগুরু নিযুক্ত হন। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের (১৭১০-১৭৮২) অধস্তন নদীয়ারাজ শ্রীশচন্দ্রের (১৮১৯-১৮৫৭) আমলে রাজবংশের সেক্রেটারি ও পরে মহারাজার বিশ্বাসভাজন হলে ‘দেওয়ান’ বা প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তার পদ লাভ করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা স্মৃতিকথামূলক একটি গ্রন্থ হলো ‘জীবনস্মৃতি’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কখনোই জীবনের ইতিহাস লেখার উদ্দেশ্যে ‘জীবনস্মৃতি’ রচনা করেননি। তিনি বলতে চেয়েছেন এটি তথ্যসমৃদ্ধ ইতিহাস গ্রন্থের মতো নয়; বরং এটি তাঁর স্মৃতি রোমান্থন। আত্মজীবনীর প্রথাগত মূল ধরনটা এমনই। ‘জীবনস্মৃতি’ ১৯১২ সালে (১৩১৯ বঙ্গাব্দ) গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। তার আগে এটি রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত প্রবাসী পত্রিকায় ভাদ্র, ১৩১৮ বঙ্গাব্দ থেকে শ্রাবণ, ১৩১৯ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।
উপমহাদেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতাদের মধ্যে আত্মজীবনী লেখার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, জহরলাল নেহরুসহ অনেকে আত্মজীবনী লিখেছেন। বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, বদরুদ্দীন উমরের ‘আমার জীবন’, রাশেদ খান মেননের ‘এক জীবন’, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর ‘নিন্দিত নন্দন’ বিভিন্ন পটপরিবর্তনের স্বাক্ষী হিসেবে আমাদের সামনে তাঁর অবস্থান তুলে ধরে। যেখানে ইতিহাসের পাদদেশে সমাজ, রাজনীতি, মানুষ, পরিবেশ, প্রতিবেশ ও সময়ের এক মিশ্র বাস্তবতা ফুটে ওঠে।

আরও পড়ুন

×