সাগরে লুকোনো ইতিহাস

টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ
রিফতি-আল-জাবেদ
প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর -০০০১ | ০০:০০
যে সমুদ্রে নৌ চলাচলের নজির আছে, সেখানে জাহাজের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে বলে অনুমান করা হয়। বিশ্বের মহাসাগরগুলোতে হাজার বছরের বাণিজ্য, যুদ্ধ এবং অনুসন্ধানের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এতে রয়েছে রুপাবোঝাই জলদস্যু জাহাজ, পণ্যবাহী জাহাজ, বিলাসবহুল রাজকীয় জাহাজ। আরও রয়েছে প্রাচীন মাছ ধরার জাহাজ, আধুনিক যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিন। ১৯ শতকের তিমি ধরার জাহাজ এবং টাইটানিকের মতো বিশাল যাত্রীবাহী জাহাজও রয়েছে সাগরের তলদেশে। লিখেছেন রিফতি-আল-জাবেদ
ইলিয়াস স্ট্যাডিয়াটিস যখন সাগরের নীল জলে নেমেছিলেন, তখন তাঁর দিনটি ছিল অন্য যে কোনো সাধারণ দিনের মতোই। অন্যান্য দিনের মতোই তিনি সেদিন পরিফেরা পর্বের বহুকোষী প্রাণী বা স্পঞ্জের অনুসন্ধান করতে নামেন। ডাইভিং স্যুট পরে স্ট্যাডিয়াটিস সমুদ্রের তলায় পৌঁছান। আবছা আলোয় তির্যকভাবে তাকিয়ে তিনি একটি ভুতুড়ে দৃশ্য আবিষ্কার করেন– চারদিকে মানুষের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অস্পষ্ট অবয়ব। বুদ্বুদের মধ্য থেকে উত্তেজিতভাবে তিনি উঠে আসেন। স্ট্যাডিয়াটিস যে জাহাজে করে অনুসন্ধানে এসেছিলেন তাঁর ক্যাপ্টেনকে জানান, তিনি পচা মৃতদেহের স্তূপ খুঁজে পেয়েছেন। এটি ছিল ১৯০০ সালের কথা। স্ট্যাডিয়াটিস ঘটনাক্রমে অ্যান্টিকিথেরা জাহাজের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেছিলেন। এটি একটি রোমান পণ্যবাহী জাহাজের অবশিষ্টাংশ, যা দুই হাজার বছরেরও আগে ডুবে গিয়েছিল। শিগগিরই স্পষ্ট হয়ে উঠল, এটি মৃতদেহের স্তূপ নয়, যেমনটি প্রথমে মনে হয়েছিল। তবে হাজার বছর ধরে জাহাজের ধ্বংসাবশেষ, মার্বেল ভাস্কর্য ও ব্রোঞ্জের মূর্তি এক নতুন শিল্পকর্মে রূপ নিয়েছে, যা এর শৈবাল, স্পঞ্জ ও বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও সামুদ্রিক প্রাণীর অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। সেই আবিষ্কারের শত বছরেরও বেশি সময় পর এজিয়ান সাগরের ধারে একটি গ্রিক দ্বীপের উপকূলে পাওয়া অ্যান্টিকিথেরার ধ্বংসাবশেষ আজও মানুষকে মুগ্ধ করে। আবিষ্কৃত হওয়ার অপেক্ষায় বিস্ময়কর বহু নিমজ্জিত ধ্বংসাবশেষ এখনও রয়েছে।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো সম্প্রতি অভিযান চালায় স্কেরকি চ্যানেলে। এটি একটি অগভীর রিফ, যা পূর্ব ও পশ্চিম ভূমধ্যসাগরকে একীভূত করেছে। কয়েক শতাব্দী ধরে সিসিলি ও তিউনিসিয়ার মধ্যবর্তী ভূমধ্যসাগরের এই অগভীর অঞ্চল ছিল ইউরোপের ব্যস্ততম সামুদ্রিক বাণিজ্য রুটগুলোর মধ্যে একটি– স্কেরকি চ্যানেল। সম্প্রতি ইউনেস্কো তিনটি নতুন ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কারের ঘোষণা করেছে। এগুলো হলো– খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী, দ্বিতীয় শতাব্দী এবং ১৯ বা ২০ শতকের জাহাজের ধ্বংসাবশেষ।
নেদারল্যান্ডসে একটি মোটরওয়ে তৈরির সময় ঘটনাক্রমে সমুদ্রতলে একটি প্রাচীন নৌকা পাওয়া যায়। ডোঙা নৌকাটি ১০ হাজার বছর আগের বলে ধারণা করা হয়। আবার প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে একদল শিকারি দীর্ঘ নৌপথ অতিক্রম করে নিউ সাউথ ওয়েলসের লেক মুঙ্গোতে এসে হাজির হয় বলে ধারণা করা হয়।
বিশ্বে জাহাজডুবির বেশ কয়েকটি ডাটাবেজ রয়েছে। এগুলোয় মোট সংখ্যার কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। এ নিয়ে অনলাইনভিত্তিক তথ্যসেবা কেন্দ্র রেক সাইটের তথ্য অনুযায়ী, ২ লাখ ৯ হাজার ৬৪০টি জাহাজ সাগরে ডুবে গেছে; যার মধ্যে ১ লাখ ৭৯ হাজার ১১০টি পরিচিত অবস্থান রয়েছে। অন্যদিকে গ্লোবাল মেরিটাইম রেক্স টাবেজ অনুযায়ী, ২ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি ডুবে যাওয়া জাহাজের রেকর্ড রয়েছে, যদিও এর মধ্যে বেশকিছু এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে মনে করা হয়, নথিভুক্ত করা এসব তালিকা অসম্পূর্ণ। জাহাজডুবির একটি ছোট অংশ মাত্র নথিভুক্ত করা আছে। ইউনেস্কোর এক বিশ্লেষণ অনুসারে, বিশ্বের মহাসাগরগুলোয় ৩০ লাখেরও বেশি জাহাজ নিমজ্জিত, যার ধ্বংসাবশেষের সন্ধান পাওয়া যায়নি। একটি পরিসংখ্যান অনুসারে, শুধু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রায় ১৫ হাজার জাহাজ ডুবেছিল। এই অজানা ধ্বংসাবশেষ সমানভাবে বিস্তৃত নয়। তবে কোনো কোনো জায়গায় বেশ কয়েকটি ধ্বংসাবশেষের হটস্পট রয়েছে। এগুলো অতীতের ব্যস্ততম নৌরুট বরাবর, সামুদ্রিক কবরস্থানের মতো। এর মধ্যে রয়েছে স্কেরকি চ্যানেল; সেই সঙ্গে ফোরনি দ্বীপপুঞ্জ। এ ছাড়াও ভূমধ্যসাগর একটি বড় হটস্পট, যেখানে এখন পর্যন্ত ৫৮টি জাহাজ আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৫ সালে মাত্র ২২ দিনে ২৩টি জাহাজ আবিষ্কৃত হয়।
১৭০৮ সালের ৮ জুন। সন্ধ্যা ৭টার দিকে কলম্বিয়ার উপকূলে ক্যারিবীয় সাগরজুড়ে একটি শক্তিশালী বিস্ফোরণ হয়। এটি ছিল সান হোসের শেষ যুদ্ধ কান্না। সান হোসে একটি গ্যালিয়ন যুদ্ধজাহাজ, যা দুই বছর আগে স্পেন থেকে যাত্রা করেছিল। গ্যালিয়ন ছিল স্পেনের বড়, বহু সাজানো পালতোলা যুদ্ধজাহাজ। এটি স্প্যানিশ ট্রেজার ফ্লিটের অংশ ছিল– নৌকার একটি কাফেলা, যা স্পেন ও আমেরিকার অঞ্চলগুলোর মধ্যে চিনি, মসলা, মূল্যবান ধাতু এবং অন্যান্য পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে ব্যবহার করা হতো।
ফ্ল্যাগশিপ হিসেবে সান হোসে এক বিশাল সম্পত্তির উৎস বহন করছিল। সেখানে ছিল রুপা, পান্না এবং প্রচুর পরিমাণে স্বর্ণমুদ্রা। একটি ব্রিটিশ জাহাজের সঙ্গে এর সংঘর্ষ হয়। কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। একপর্যায়ে গানপাউডার রাখার স্থানে একটি গোলার আঘাতে সঙ্গে সঙ্গে ৬০০ ক্রু সদস্যসহ এটি সমুদ্রে তলিয়ে যায়।
এখন মহাসাগরের গভীর সমুদ্রতলের একটি ছবি তৈরি করা সম্ভব সাগরে না নেমেই। স্বর্ণের প্রযুক্তি ও জিপিএস ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে বিশাল সমুদ্রে ডুবে থাকা জাহাজের ধ্বংসাবশেষই শুধু তুলে আনা হচ্ছে না; বরং উঠে আসছে সেসব ইতিহাস। তবে সাগরে এখনও অনাবিষ্কৃত ধ্বংসাবশেষের মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত কিছু জাহাজ। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ওয়ারাতাহর কথা। এটি একটি বিশাল যাত্রীবাহী জাহাজ, যাকে প্রায়ই টাইটানিকের সঙ্গে তুলনা করা হয়। জাহাজটি ২১১ জন যাত্রী নিয়ে ১৯০৯ সালের ২৬ জুলাই ডারবান থেকে কেপটাউনের উদ্দেশে যাত্রা করেছিল। তারপর অদৃশ্য হয়ে যায়। আজ পর্যন্ত কেউ জানে না কী ঘটেছিল বা ঠিক কোথায় ডুবে যায় জাহাজটি। ওয়ারাতাহর ধ্বংসাবশেষ সন্ধানের জন্য অন্তত ৯টি অভিযান চালানো হয়। তা সত্ত্বেও সফলতা আসেনি। সামনে কী হবে তা অনিশ্চিত। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত, আমরা হয়তো শিগগিরই ওয়ারাতাহ এবং এমন অনেক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ ও ইতিহাস আবিষ্কার করব।
বিবিসি অবলম্বনে