পাঁচ বাধাতে কমছে বন্দরের গতি

সারোয়ার সুমন
প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর -০০০১ | ০০:০০
চট্টগ্রাম বন্দরকে বলা হয় দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর। অর্থনীতির চালিকাশক্তি ধরা হয় এই বন্দরকে। অথচ গুরুত্বপূর্ণ এ বন্দরে নেই কাঙ্ক্ষিত গতি। পাঁচটি বাধার কারণে বাড়ছে না বন্দরের গতি। বাড়ছে না সক্ষমতাও। এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন সমকাল চট্টগ্রামের রিজিওনাল এডিটর সারোয়ার সুমন
চট্টগ্রাম বন্দরের গতি বাড়াতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে পাঁচটি বিষয়। এর মধ্যে বন্দর ইয়ার্ডে পণ্য খালাসের সুযোগ রাখাটা সামনে আসছে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে। পৃথিবীর উন্নত কোনো বন্দরের ইয়ার্ডে এভাবে পণ্য খালাসের সুযোগ নেই। পার্শ্ববর্তী বিকল্প কোনো স্থাপনাতে আমদানি করা পণ্য খালাস করে উন্নত বন্দরগুলো। চট্টগ্রাম বন্দর এই সুযোগ রাখতে গিয়ে হারাচ্ছে তার গতি। প্রশ্নবিদ্ধ করছে নিরাপত্তা ব্যবস্থাকেও। আইএসপিএস কোড অনুযায়ী বন্দর পরিচালনা করতে হলে সংরক্ষিত এলাকাকে রাখতে হবে সুরক্ষিত। বাইরের অবাঞ্ছিত কোনো মানুষ প্রবেশ করতে পারবে না বন্দরে। পণ্য খালাসের সুযোগ থাকায় এখন প্রতিদিন সুরক্ষিত এলাকায় প্রবেশ করছে সাত থেকে আট হাজার গাড়ির চালক কিংবা সহকারী। ঘোষণা-বহির্ভূত পণ্য খালাস হয়ে যাচ্ছে। আসছে মাদকের মতো চালানও। পর্যাপ্ত স্ক্যানার ও দক্ষ জনবল না থাকায় পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। বেসরকারি আইসিডিগুলোও তাদের সক্ষমতা বাড়িয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।
অথচ বন্দরকে গতিশীল করতে আমদানি করা সব পণ্য অফডকে (বেসরকারি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো) খালাসের সুপারিশ করেছিল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চিঠি দিয়ে সব পণ্য অফডকে খালাসের এ সুপারিশ করা হয়। এনবিআর তাতে সাড়া দেয়নি এখনও। বর্তমানে ৩৮ ধরনের আমদানি করা পণ্য আইসিডিতে খালাস করা হচ্ছে। মোট আমদানি করা পণ্যের এটি মাত্র ২০ থেকে ২২ শতাংশ। বাকি পণ্য খালাস করতে ব্যবহার করা হচ্ছে বন্দরের ইয়ার্ড। এ কারণে তৈরি হচ্ছে জট। ঘটছে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড।
এনবিআরে আটকে রয়েছে বন্দরের চিঠি আমদানি করা সব পণ্য বেসরকারি আইসিডিতে খালাস করতে একাধিক চিঠি দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। সর্বশেষ চিঠি দেয় তারা ২০২২ সালে। এর আগে ২০২০ সালেও একই বিষয় নিয়ে এনবিআরে চিঠি পাঠায় বন্দর কর্তৃপক্ষ। সেই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বিশ্বের অনেক উন্নত বন্দরে সব এফসিএল কনটেইনারের পণ্য আমদানিকারকের চত্বরে বা অফডকে খালাস করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করা কনটেইনারের ২০-২২ শতাংশ অফডকে খালাস হয়, বাকিগুলো বন্দরের ভেতরে খুলে খালাস করা হয়। ফলে প্রতিদিন বন্দরের অভ্যন্তরে কয়েক হাজার ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান প্রবেশ করে। তাতে কনটেইনার জট, বন্দরের উৎপাদনশীলতা হ্রাস, রপ্তানি কার্যক্রমে ধীরগতিসহ সার্বিক নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হচ্ছে। এনবিআর থেকে ৩৭ ধরনের পণ্য অফডকে খালাসের অনুমতি রয়েছে। পর্যায়ক্রমে পণ্যের সংখ্যা বাড়িয়ে সরবরাহ কার্যক্রম আমদানিকারকের চত্বর বা অফডকে স্থানান্তর করা গেলে সমস্যার সমাধান হবে। বন্দরের গতিশীলতাও বাড়বে। কিন্তু এই চিঠির কোনো উত্তর আসেনি এখনও।
বেসরকারি আইসিডিগুলোর দক্ষতা নিয়ে এনবিআরের সন্দেহ থাকায় সব আমদানি পণ্য সেখানে খালাসের অনুমতি দিচ্ছে না তারা। আবার আইসিডিগুলোর সক্ষমতা বাড়াতেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না এনবিআর। ফলে বিষয়টি বছরের পর বছর ঝুলে থাকছে। অন্যদিকে বন্দরের গতিশীলতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। বিদেশেও ক্ষুণ্ন হচ্ছে দেশের সুনাম।
সাময়িক উদ্যোগে আসছে না সুফল কনটেইনার জট ব্যাপক আকার ধারণ করলে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে এনবিআর সাময়িকভাবে বন্দরের সব ধরনের পণ্য অফডকে সংরক্ষণ, স্থানান্তর ও খালাসের অনুমতি দেয়। ২০২০ সালে এভাবে বন্দরের জট কমাতে ভূমিকা রাখে ১৯টি আইসিডি। আবার ব্যবসায়ীরা আইসিডি থেকে পণ্য খালাস না করে বন্দর ইয়ার্ড থেকে পণ্য খালাসে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এ কারণে ওই উদ্যোগ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কিন্তু বন্দরের অপারেশনাল কাজ মসৃণ করতে আমদানি করা সব পণ্য আইসিডিতে পাঠানোর কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছেন দায়িত্বশীলরা।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলম বলেন, ‘বিশ্বের অন্য কোনো উন্নত বন্দরের ইয়ার্ডে পণ্য খালাসের সুযোগ রাখা হয়নি। অবকাঠামোগত বিকল্প সুবিধা গড়ে না ওঠায় চট্টগ্রাম বন্দরকে এটি করতে হচ্ছে। বেসরকারি আইসিডিগুলোর সক্ষমতা ও দক্ষতা আরও বাড়িয়ে এ সমস্যার সমাধান করতে পারে এনবিআর। সে ক্ষেত্রে আইসিডিগুলোর পরিচালনাগত পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনতে হবে। পণ্য সেখানে খালাস করতে গিয়ে যদি খরচ বেড়ে যায় তাহলে সেটি ভোক্তার কাঁধে যাবে শেষ পর্যন্ত। এসব বিষয় আমলে নিয়ে এখন থেকেই বিকল্প ভাবতে হবে নীতিনির্ধারকদের।’
সক্ষমতা বাড়াতে হবে আইসিডির বর্তমানে ১৯টি আইসিডির মধ্যে ১৮টি সচল। ওইসব আইসিডিতে বিভিন্ন ধরনের ৩৮টি আমদানি পণ্য খালাস হয়। তার মধ্যে আছে কাঁচা তুলা, ওয়েস্ট পেপার, ছোলা, সাদা মটর, খেজুর, পশুখাদ্য, পশুখাদ্যের কাঁচামাল, সোডা অ্যাশ, পেঁয়াজ। নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে চায় বেসরকারি ১৯ আইসিডি কর্তৃপক্ষও। নতুন আরও আমদানি পণ্য খালাসে সক্ষমতা রয়েছে বলেও দাবি করছে তারা। নতুন পণ্য পেলে তাদের লোকসানও কমবে বলে মনে করছেন এ খাতের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা। এখন ৩৮ ধরনের আমদানি পণ্য ও শতভাগ রপ্তানি পণ্য খালাস হয় আইসিডিতে। চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি পণ্য কমে যাওয়ায় এখন তাঁরা লোকসান গুণছেন। সর্বশেষ অর্থবছরে তাদের ২০০ কোটি টাকার বেশি লোকসান হয়েছে বলে দাবি করছেন তাঁরা।
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান বলেন, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ২২ হাজার ৭৬৬ টিইইউএস, অক্টোবরে ২৩ হাজার ১৯৩ টিইইউএস ও নভেম্বরে ১৯ হাজার ৭৩৭ টিইইউএস পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ২০ হাজার ৬৭৩ টিইইউএস, অক্টোবরে ২০ হাজার ২৩০ টিইইউএস ও নভেম্বরে ২০ হাজার ৩৮৪ টিইইউএস পণ্য রপ্তানি করেন তাঁরা। ঋণাত্মক এ ধারা অব্যাহত ছিল চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেও।
এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ডলার সংকটের কারণে আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করা আছে। আবার পণ্য উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিও কমে গেছে। সেই সঙ্গে কমে গেছে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের উৎপাদন। এসব কারণে আমদানি ও রপ্তানি ক্রমশ কমছে।
প্রসঙ্গত, বেসরকারি ডিপোগুলোর মাধ্যমে যেসব পণ্য রপ্তানি হয় তার অধিকাংশই পোশাকজাতীয় পণ্য। বর্তমানে পর্যাপ্ত কার্যাদেশ না থাকায় পোশাক কারখানাগুলোও সংকটময় সময় পার করছে। পোশাক পণ্যের রপ্তানি কমে যাওয়ার কারণেও ডিপোগুলোতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তাই বেশি পরিমাণ আমদানি পণ্য খালাসের অনুমতি পেলে তাদের এ লোকসান আরও কমবে বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আইসিডি মালিকরা ব্যবসা সম্প্রসারণে আগ্রহী হলেও দক্ষতা বাড়াতে মনোযোগী নন। পর্যাপ্ত আধুনিক যন্ত্রপাতি ও দক্ষ জনবল নেই বেশিরভাগ আইসিডিতে। পণ্য খালাসের ভাড়াও সেখানে বেশি। তাই আইসিডিতে পণ্য খালাস না করে বন্দর থেকে পণ্য খালাস করতেই আগ্রহী তারা।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বেশিরভাগ আইসিডিতে দক্ষ জনবল নেই। নেই অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিও। এখন রপ্তানি পণ্যের শতভাগ সেখানে খালাস হচ্ছে। এর সঙ্গে শতভাগ আমদানি পণ্য যুক্ত হলে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে না তারা। তাই তাদের সক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়াতে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বন্দর ও এনবিআরের।
খরচ বেশি আইসিডিতে বিজিএমইএ বলছে, বন্দরে একটি ২০ ফুট কনটেইনারের আমদানি পণ্য খালাসে সর্বমোট খরচ (লিফট অন/অফ চার্জ, রিভার ডিউজ, লেবার চার্জ এবং অ্যাপ্রেইজিং লেবার চার্জ) হয় ৪ হাজার ৬১ টাকা। অন্যদিকে আইসিডিতে পণ্য খালাসে প্যাকেজ ডেলিভারি চার্জ ৭ হাজার ৯৩০ টাকা। তার সঙ্গে যুক্ত হয় লিফট অন/অফ চার্জ ১ হাজার টাকা, রিভার ডিউজ ৪০৮ টাকা, এক্সট্রা মুভমেন্ট চার্জ প্রায় ৫২ ডলারসহ সর্বমোট ১৩ হাজার ৭৫৫ টাকা। অন্যদিকে ৪০ ফুট কনটেইনারের ক্ষেত্রে বন্দরে সর্বমোট খরচ হয় ৫ হাজার ৬৯৯ টাকা। অফডকে সর্বমোট খরচ হয় ১৮ হাজার ৯২ টাকা। অর্থাৎ বন্দরের চার্জের দ্বিগুণের বেশি টাকা খরচ করে আইসিডিগুলো থেকে আমদানিকারকদের পণ্য খালাস করতে হচ্ছে। তাই তারা আইসিডির চেয়ে পণ্য খালাসে বন্দরকেই বেশি পছন্দ করেন।
কনটেইনার জটে বিঘ্নিত হচ্ছে নিরাপত্তা
বেসরকারি আইসিডিতে খরচ বেশি– এটিকে প্রধান কারণ মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। এ জন্য সেখান থেকে পণ্য খালাসে অনীহা প্রকাশ করছেন তারা। আবার বন্দর ইয়ার্ডে পণ্য খালাস করায় গতি কমে যাচ্ছে বন্দরের। বিঘ্নিত হচ্ছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পণ্য আনতে গিয়ে প্রতিদিন বন্দরে প্রবেশ করছে সাত থেকে আট হাজার বাইরের মানুষ। পণ্য সরবরাহের সময় এখন ইয়ার্ডে জট তৈরি হয়। এটিকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে অপব্যবহার করছে অপরাধীরা। তারা মিথ্যা ঘোষণায় একের পর এক চালান আনছে। আবার অস্ত্র ও মাদক আসার মতো ঘটনাও ঘটছে চট্টগ্রাম বন্দরে। পর্যাপ্ত স্ক্যানার ও দক্ষ জনবল না থাকায় এখন পরিস্থিতি সামালও দিতে পারছে না বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
- বিষয় :
- চট্টগ্রাম বন্দর
- বন্দরের গতি