ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

নাটক

ডাকঘর: আত্মার মুক্তি

ডাকঘর: আত্মার মুক্তি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

লুৎফর রহমান

প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০২৩ | ১৮:০০

‘ডাকঘর’ নাটকে রুগ্‌ণ বালক অমলের অসুস্থতা ঘিরে জাগতিক বৃত্তাবদ্ধতা, আত্মার মুক্তি এবং মহাজাগতিক প্রবহমান সৌন্দর্যের প্রতি বা বিশ্বাত্মার প্রতি মানবাত্মার অমোঘ আকর্ষণের মধ্য যে দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা নাট্যবোদ্ধা রসিক সমালোচক পাঠকের চেতনায় অমলের মৃত্যুকেই প্রধান বিবেচ্য করে তোলে। স্বীকার করতে দোষ নেই, নাটকে শিশু অমলের মৃত্যুর সত্যিকার পটভূমি রচিত হয়েছে এবং কবিরাজের নিষেধ অগ্রাহ্য করে রাজকবিরাজ ঘরের সমস্ত বন্ধ দরজা, জানালা খুলে দিয়ে বাইরের সঙ্গে অন্দরের মহামিলন ঘটিয়ে দিয়েছে। এতে নাটকে যে, রহস্যগ্রন্থি রচিত হয়েছে তা ট্র্যাজিক রসের উদ্গাতা এবং সে রস পাঠকের চিত্তভূমি প্লাবিত করে। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় অমলের মৃত্যু সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়াই তো যায়। কিন্তু তা কতটা যৌক্তিক এবং কাব্যসত্যের বিচারে সঠিক তাও অবশ্য বিচার্য।

 ১৯১১/১২ খ্রিষ্টাব্দে শান্তিনিকেতনে মাত্র তিন দিনের শ্রমে-ঘামে ডাকঘরের সৃষ্টি। ‘ডাকঘর’ রচনাকালে তিনি পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় প্রাজ্ঞ একজন খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব। এরই মধ্যে তিনি রক্ত সম্পর্কের ও প্রাণের সম্পর্কের যেসব পারিবারিক সদস্যের মৃত্যুজনিত শোকসাগর সাঁতরে নৈমিত্তিকতার তীরে উঠেছিলেন তারা মা সারদা দেবী (১৮৭৫), নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী (১৮৮৪), স্ত্রী মৃণালিনী (১৯০২), কন্যা রেণুকা (১৯০৪), পিতৃদেব (১৯০৫), প্রিয়তম পুত্র শমীন্দ্রনাথ (১৯০৭) প্রমুখ। এসব নিকটজনের মৃত্যুশোক কবির জন্য ছিল অস্তিত্বের ওপর অপঘাত। তন্মধ্যে কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু রসেকষে বাংলা সাহিত্যের বহুল আলোচিত প্রসঙ্গ। উপর্যুপরি এতগুলো মৃত্যু ঘটনাজনিত শোককে রবীন্দ্রনাথ শক্তিতে পরিণত করেছিলেন। তন্মধ্যে ডাকঘরের অমলের প্রায় সমবয়সী শমীন্দ্রনাথের অকাল (১১ বছর) মৃত্যুর ঘটনা তাঁকে ভয়ংকরভাবে আলোড়িত করে থাকবে। সম্ভবত শমীর মৃত্যুর সঙ্গে মিলিয়ে অমলের মৃত্যুর ভাবনাও অসংগত মনে হয় না। আবার তাকে জোর করে প্রতিষ্ঠা দিতে যাওয়াও যায় না। ডাকঘরের গ্রন্থ পরিচয় অংশে চয়িতার বক্তব্য, [...] ‘ডাকঘর’ রচনাকালে “আমার মনের মধ্যে বিচ্ছেদের বেদনা ততটা ছিল না।” তত না হোক ছিল এ কথা সত্য। রবীন্দ্রনাথ আরও বলেন– “ডাকঘর’ যখন লিখি তখন হঠাৎ আমার অন্তরের মধ্যে আবেগের তরঙ্গ উঠেছিল। [...] চল চল বাইরে, যাবার আগে তোমাকে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে হবে সেখানকার মানুষের সুখদুঃখের উচ্ছ্বাসের পরিচয় পেতে হবে। রাত দুটো-তিনটের সময় অন্ধকার ছাদে এসে মনটা পাখা বিস্তার করল। [...] আমার মনে হচ্ছিল একটা কিছু ঘটবে, হয়তো মৃত্যু। [...] কোথাও যাবার ডাক ও মৃত্যুর কথা [...] ডাকঘরে [...] প্রকাশ করলুম।” এই দুটো প্রসঙ্গই রবীন্দ্রভাব বিশ্বের রূপে-রসে রঞ্জিত হয়ে এখানে অভিব্যক্তি পেয়েছে। আমৃত্যু শিল্পসাধনার ব্যাপ্ত সময়পরিধিতে সীমা ও অসীমের মেলবন্ধন রচনার অগ্রযাত্রায় অন্য অনেক চিন্তার মতো রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুচিন্তারও রূপান্তর লক্ষণীয়। যৌবনে তাঁর রোমান্টিক মন মৃত্যুকে ‘শ্যাম সমান’ কাঙ্ক্ষিত বলে ঘোষণা করেছিল। যদিও সাধারণের কাছে মৃত্যু তা নয়। দেহ ও প্রাণকে তিনি ‘শেষ সপ্তকে’র ‘বাইশ’ সংখ্যক কবিতায় পৃথক করেছেন। “শুরু হতেই ও আমার সঙ্গ ধরেছে,/ ওই একটা অনেক কালের বুড়ো,/ আমাতে মিশিয়ে আছে এক হয়ে।/ আজ আমি ওকে জানাচ্ছি -/ পৃথক হব আমরা। [...] ‘জীর্ণ করে ওকে দিনে দিনে পলে পলে/ বাসনার দহনে,/ ওর জরা দিয়ে আচ্ছন্ন করে আমাকে/ যে-আমি জরাহীন।/ মুহূর্তে মুহূর্তে ও জিতে নিয়েছে আমার মমতা,/ তাই ওকে যখন মরণে ধরে/ভয় লাগে আমার/ যে-আমি মৃত্যুহীন।” বৃদ্ধ দেহটার মৃত্যুও কামনা করছেন এবং দেহবিহীন প্রাণের যে অস্তিত্ব নেই তা আবিষ্কার করে কষ্ট অনুভব করেছেন। দেহের খাঁচায় প্রাণসত্তা, আত্মা বন্দি। তার মুক্তি চাই-ই। মৃত্যু রবীন্দ্র-চেতনায় মুক্তি, সেই বন্দিদশা থেকে মহাজগতে লীন হবার উপায়, পরম মুক্তি। এ বিশ্বজগতে জীবনলীলার প্রাত্যহিকতার ভিতর দিয়ে নিখিল জীবন স্রোতকে প্রত্যক্ষ করতেন রবীন্দ্রনাথ। কেবল তাই নয়, ব্যক্তি অস্তিত্বের নিভৃতে যে, তারই নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ চলিষ্ণু তাতে কবির ছিল স্থির বিশ্বাস। ‘আত্মপরিচয়’ দ্রষ্টব্য। ১৮৮৫ সালে রচিত ‘বিচিত্র প্রবন্ধে’র ‘রুদ্ধ গৃহ’ নামক রচনায় রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুচেতনার বিশেষ রূপটির প্রকাশ লক্ষণীয়। এ-রচনায় তিনি বলেন– “পৃথিবী মৃত্যুকেও কোলে করিয়া লয় জীবনকেও কোলে করিয়া রাখে, পৃথিবীর কোলে উভয়েই ভাইবোনের মতো খেলা করে। এই জীবনমৃত্যুর প্রবাহ দেখিলে, তরঙ্গভঙ্গের উপর ছায়া-আলোর খেলা দেখিলে, আমাদের কোনো ভয় থাকে না। কিন্তু বন্ধ-মৃত্যু রুদ্ধ-ছায়া দেখিলেই আমাদের ভয় হয়। মৃত্যুর গতি যেখানে আছে, জীবনের হাত ধরিয়া মৃত্যু যেখানে একতালে নৃত্য করে, সেখানে মৃত্যুরও জীবন আছে, সেখানে মৃত্যু ভয়ানক নহে। কিন্তু চিহ্নের মধ্যে আবদ্ধ গতিহীন মৃত্যুই প্রকৃত মৃত্যু, তাহাই ভয়ানক।” ‘ডাকঘরে’ এই ‘চিহ্নের মধ্যে আবদ্ধ গতিহীন মৃত্যু’র ষোলআনা আয়োজন সম্পন্ন করে ‘কবিরাজ’ কিন্তু ‘রাজকবিরাজ’ বাইরের সাথে ভিতরের অন্দরের সাথে সদরের আলোর সাথে বদ্ধঘরের অন্ধকারের মিলন ঘটিয়ে দিয়ে প্রকৃত মৃত্যুর নখর বিদ্ধ অমলকে বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে পতির মধ্যে, আনন্দের মধ্যে, অসীমের মধ্যে মুক্তি দিয়েছে। তাইতো অমল মরে না। বিশ্রামের পরিতৃপ্তির নিদ্রার কোলে আশ্রয় নেয়। সুধা যে তাকে ভোলেনি, তার জন্যই অমলকে জেগে উঠতে হবে। ছোট্ট পরিসরের এই টেক্সট ঐতিহ্যবাহী পালানাটকের নিয়মে রুগ্‌ণ অমলের ঘরে, ঘরের বাইরে আঙিনায় নাটকের সমস্ত চরিত্র নির্দিষ্ট নিয়মে আসা-যাওয়া করে। কেজো পৃথিবী আর তার রক্ষক কায়েমি স্বার্থবাদী মোড়ল, প্রাণের বিনষ্টি সাধক, সংস্কাররক্ষক কবিরাজ, মাধবদত্তদের মতো সংসারজীবী স্বার্থপরের বাস এই পৃথিবীতে। বিশ্ববীণার প্রাণের তন্ত্রীতে যে নিত্য সুরের ঝংকার প্রতিনিয়ত ধ্বনিত হচ্ছে, তার স্পর্শ ওদের চেতনা আলোড়িত করে না। কাঁধে বাঁশের লাঠি, লাঠির আগায় পুঁটুলিতে ছাতু যে পথিক নাগরা জুতা পরে অজানার পথে প্রবাহিত হচ্ছে, শামলী নদীর ধারের পাঁচমুড়া পাহাড়ের তলার গ্রাম থেকে আসা দইওয়ালা, প্রহরী, অন্ধ খোঁড়া ভিক্ষুক, মালিনীর মেয়ে সুধা এবং ছেলের দল অসুস্থ অমলের কাছে কর্মমুখর নিত্য গতিশীল ও পরিবর্তনশীল পৃথিবী ও তার অনন্ত সৌন্দর্য উপস্থাপন করে। সেসব তথ্য অমলের অভাবনীয় কল্পনাশক্তিকে উস্কে দেয়। অদেখা, অজানা, অচেনা স্থান সম্পর্কে অমলের কল্পনাসৃষ্ট বর্ণনা, বর্ণিত দৃশ্যাবলি জাতিশ্বরকেও হার মানায়। অমল কোনো ব্যক্তিরূপ নয়, রবীন্দ্রনাথের গৃহবন্দি আত্মা। ঠাকুরদা, ফকির, রাজকবিরাজ অভিন্ন চরিত্রের ভিন্ন ভিন্ন রূপ। তাদের পরিণত বয়সের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, জগদ্বোধ, মহাজাগতিক রহস্যানুভব অমলের চৈতন্যের পরিপূরক। তারা কেজো পৃথিবীর বাইরের জগতের নিবাসী। বিনাখরচায় ফকির রূপকথার ক্রৌঞ্চদ্বীপ ঘুরে অমলের কাছে তার ঐশ্বর্যের খবর জানায়। ‘যেখানে খুশি যাবার ক্ষমতা সংরক্ষণ করে ফকির। সেই ক্ষমতা অর্জনের প্রত্যাশী অমলের তাই প্রাণের মানুষ ফকির। ফকির আসলে ছদ্মবেশী ঠাকুরদা এবং অমলের পরিতৃপ্তির জন্যই এই ছদ্মবেশ। অমলও নদী পাহাড় সমুদ্রের সব বাধা তুচ্ছ করে ফকিরের সাথে চলে যেতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ‘ডাকঘরে’ দুইজন রাজার অনুপস্থিত অস্তিত্ব রয়েছে। একজন ডাকঘর স্থাপন করে তার অস্তিত্বের ও ক্ষমতার প্রমাণ দিচ্ছে, অন্যজন মহাজগতের রাজা। এ-রাজাকে ‘রাজা’ নাটকেও দেখা গেছে অনুপস্থিত থেকেও তিনি সর্বত্র উপস্থিত। এখানেও তিনি অনুপস্থিত কিন্তু নিত্য তাঁর ডাক আসে তাঁরই ডাকহরকরার মাধ্যমে। তাঁর চিঠি আসে প্রকৃতির মধ্যে অস্তিত্বশীল বস্তুরাজি ঝড়-জল-বৃষ্টি, বাতাস-বিদ্যুৎ, আকাশের রং, ঋতুবৈচিত্র্য, ফুলের রং, পাখি, সাগর-নদী, পাহাড়-পর্বত-উপত্যকার আঁকাবাঁকা পথ, সে চিঠি তারায় তারায় ঝলসে ওঠে। সে চিঠিই অমলের জীবনীশক্তি প্রাণদায়িনী শক্তি। ‘ডাকঘর’ নাটকে আত্মার স্বাধীনতা বনাম শাসন নিষেধের দ্বন্দ্ব। জীবন ও মৃত্যুর দ্বন্দ্বে জীবনজয়ী হয়েছে। পরিশেষে, সীমার মধ্যে অসীমের সর্বময় প্রকাশ এ-নাটকের কেন্দ্রীয় সত্য হয়ে উঠেছে। “আমি বালকের শিয়রের কাছে বসব ওর ঘুম আসছে।” ঠাকুরদার এ-উক্তির পর মাধবদত্তের উদ্বেগ বৃদ্ধি পেয়েছে তার এক প্রশ্নের উত্তরে ঠাকুরদা মাধবদত্তকে অবিশ্বাসী বলে তিরস্কার করেছে। সুধা অমলের জন্য ফুল নিয়ে এসে তাকে ডাকলে রাজকবিরাজ বলেছে “ও ঘুমিয়ে পড়েছে।” এবং “বোলো যে, ‘সুধা তোমাকে ভোলেনি।” এই ছোট্ট সংলাপের মধ্য দিয়ে নাটক শেষ হয়েছে। তাই বলা সংগত যে, এ-নাটকে মুক্তির কথা আছে মৃত্যুর কোনো প্রত্যক্ষ ঘটনা নেই। এতদ্‌বিষয়ে নাট্যকার রবীন্দ্রনাথেরও স্বীকৃতি মেলে, ১৯৩৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারির এক চিঠি সূত্রে জানা যায় তিনি লিখেছেন “ডাকঘরের অমল মরেছে বলে সন্দেহ যারা করে তারা অবিশ্বাসী-রাজবৈদ্যের হাতে কেউ মরে না– কবিরাজটা ওকে মারতে বসেছিল বটে।” সংক্ষিপ্ত আলোচনার অস্তে এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, ‘ডাকঘর’ নাটকে রূপকে সংকেতে রাবীন্দ্রিক মৃত্যুচেতনা এক বিশিষ্টরূপ লাভ করেছে। সেই চেতনার মর্মে রয়েছে জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার অবিচ্ছেদ্য রূপে একাত্ম হওয়া। পরমাত্মার সাথে জীবাত্মার কাঙ্ক্ষিত মিলন।  

আরও পড়ুন

×