ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

বিশেষজ্ঞ মত

টিকে থাকতে টেকসই অর্থায়নের বিকল্প নেই

টিকে থাকতে টেকসই অর্থায়নের বিকল্প নেই

খন্দকার মোরশেদ মিল্লাত

--

প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০২৩ | ১৮:০০

প্রকৃত অর্থে টেকসই অর্থায়নকে একক সংজ্ঞায় বর্ণনা করা সহজ হয় না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), ইউনাইটেড নেশন্স এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনইপি), ইউনাইটেড নেশন্স ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেইঞ্জ (ইউএনএফসিসিসি), ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) ইত্যাদি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সংজ্ঞার সঙ্গে সংগতি রেখে টেকসই অর্থায়নকে সংজ্ঞায়িত করেছে।

সহজ করে বলতে হলে, টেকসই অর্থায়ন অন্তর্ভুক্ত করেছে পরিবেশবান্ধব অর্থায়ন, টেকসই কৃষির জন্য অর্থায়ন, টেকসই সিএসএমইর জন্য অর্থায়ন, সামাজিক দায়বদ্ধতার অর্থায়নসহ অন্যান্য টেকসই অর্থায়নকে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘সাইসটেইনেবল ফাইন্যান্স পলিসি ফর ব্যাংকস অ্যান্ড এফআইএস’ শিরোনামের নীতিমালায় টেকসই কৃষির জন্য অর্থায়ন, টেকসই সিএসএমইর জন্য অর্থায়ন, সামাজিক দায়বদ্ধতার অর্থায়ন ছাড়াও পরিবেশবান্ধব বিভিন্ন খাতসহ টেকসই অর্থায়নের সব কম্পোনেন্ট সুবিন্যস্তভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে টেকসই অর্থায়ন ও পরিবেশবান্ধব অর্থায়ন বিষয়ে ব্যাংক, ঋণগ্রহীতাসহ সংশ্লিষ্টদের কার্যপরিধি ও কার্যক্রমও সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে।

২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৬৮টি পরিবেশবান্ধব পণ্য, প্রকল্প বা উদ্যোগ চিহ্নিত করা হয়েছে, যা নবায়নযোগ্য জ্বালানি, জ্বালানি দক্ষতা, বিকল্প জ্বালানি, তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ ও পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ দ্রব্য তৈরি করা, পরিবেশবান্ধব ইট উৎপাদন, পরিবেশবান্ধব স্থাপনা, কৃষি, সিএসএমই ও সামাজিক দায়বদ্ধতার অর্থায়ন এমন ১১টি পরিবেশবান্ধব খাতের অন্তর্ভুক্ত।

টেকসই অর্থায়ন নীতিমালা সম্পর্কিত বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২০ ও ২০২২ সালের নির্দেশনার আলোকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ১১টি পরিবেশবান্ধব খাত এবং পুনঃঅর্থায়ন সুবিধার আওতায় এ খাতের আওতাভুক্ত ৬৮টি পরিবেশবান্ধব পণ্য, প্রকল্প বা উদ্যোগে সুনির্দিষ্টভাবে উদ্যোক্তা ও ঋণগ্রহীতাকে ৫ বছর মেয়াদে ৬ শতাংশ, ৫ বছরের ঊর্ধ্বে ৮ বছর পর্যন্ত ৫.৫ শতাংশ, ৮ বছরের ঊর্ধ্ব থেকে ১০ বছর মেয়াদে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ সহজ সুদহারে অর্থায়ন করতে সক্ষম হচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক তার নির্দেশনায় সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে দিয়েছে যে, কেবল মেয়াদি ঋণের বিপরীতে এ পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা প্রযোজ্য হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২০ সালে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে টেকসই অর্থায়ন খাতে তাদের মোট বিতরণকৃত ঋণের ন্যূনতম ২০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করে দিয়েছে, যার মধ্যে মোট বিতরণকৃত মেয়াদি ঋণ ন্যূনতম ৫ শতাংশ হতে হবে। কিছু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যাংক এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এখনও সক্ষম হয়নি। এর কারণ হতে পারে, ওইসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর টেকসই অর্থায়ন এবং পরিবেশবান্ধব অর্থায়নসংক্রান্ত কৌশলগত পরিকল্পনায় ঘাটতি বা কৌশলগত পরিকল্পনার অনুপস্থিতি। এ কৌশলগত পরিকল্পনা এক বা দুই বছরের জন্য নয়, এটি হতে হবে ন্যূনতম ২০ বছরের জন্য। এ পরিকল্পনায় সরকারের টেকসই উন্নয়ন অভীস্ট (এসডিজি), পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনাসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে টেকসই অর্থায়ন নীতিমালা এবং পুনঃঅর্থায়ন-সংক্রান্ত নীতিমালা প্রবর্তন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

যেসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবর্তিত নীতিমালার সঙ্গে এখনও খাপ খাওয়াতে না পেরে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারছে না, তাদের জন্য টেকসই অর্থায়ন এবং পরিবেশবান্ধব অর্থায়ন-সংক্রান্ত কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ একান্ত জরুরি। এক্ষেত্রে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বোচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ ও উদ্যোগ দরকার।

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এক্ষেত্রে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা নিয়ে বাস্তবায়ন করতে পারে। বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সঙ্গে সঙ্গে বিদেশি অনুদান ও বিদেশি অর্থায়নকারী সংস্থা থেকে সহজ শর্তে ঋণের প্রাপ্যতা কমে যাবে। ফলে নিজস্ব সক্ষমতা অর্জন করতে না পারলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিবেশ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত পরিবেশ ও সামাজিক লাভজনক খাতে অর্থায়ন বা বিনিয়োগ করতে হবে। এ-সংক্রান্ত প্রকল্পে টেকনোলজিক্যাল অ্যাডভান্সমেন্ট সংযুক্ত করে প্রকল্প থেকে সর্বোত্তম কার্যকরী উপযোগিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনার আওতায় বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রকল্পে অর্থায়নের আগে পরিবেশগত ও সামাজিক ঝুঁকি নিশ্চিত হয়ে অর্থায়ন করতে হবে। ঋণ যেন খেলাপি না হয় সেজন্য নিরবচ্ছিন্ন তদারকি জরুরি। প্রচলিত জনবল নিয়োগের সঙ্গে পরিবেশ ও সামাজিক অনুষদের বিশেষজ্ঞ, এনার্জি অডিটর, কৃষিবিদ, সয়েল সায়েন্টিস্ট, পরিবেশগত প্রকৌশলী ইত্যাদি ক্ষেত্রের লোকবলও নিয়োগ করা প্রয়োজন হবে।

প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকার জন্য ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সব পর্যায়ের কর্মকর্তার যার যার ক্ষেত্র অনুযায়ী টেকসই অর্থায়ন ও সাসটেইনিবিলিটি ইস্যুতে কর্মদক্ষতা অর্জনে কার্যকর প্রশিক্ষণ একান্ত জরুরি। এছাড়া ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ ও সামাজিক পণ্য, প্রকল্প বা উদ্যোগে সম্ভাবনাময় ঋণগ্রহীতা, সাপ্লায়ার্স, সার্ভিস প্রোভাইডার্স, অ্যাসোসিয়েশন ইত্যাদির সমন্বিত ডেটাবেজ থাকা প্রয়োজন। কারণ তথ্যের ঘাটতি ও ডকুমেন্টেশনে জটিলতা এক্ষেত্রে বড় একটি চ্যালেঞ্জ।

সংশ্লিষ্ট সবাইকে মনে রাখতে হবে, কেবল অর্থায়ন হলেই হবে না, তা হতে হবে টেকসই অর্থায়ন। সিএমএসএমই, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, সবুজ কৃষি, সামাজিক দায়বদ্ধতার অর্থায়ন, সাশ্রয়ী সবুজ গৃহায়ন, শিল্প, সলিড ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট প্রভৃতি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ক্ষেত্রে কার্যকর অর্থায়ন করতে হবে। প্রয়োজনে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব টেকসই অর্থায়ন নীতিমালার আলোকে তাদের কৌশলগত পরিকল্পনায় পৃথক পৃথক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে পারে। এতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো টেকসই অর্থায়ন ও পরিবেশবান্ধব অর্থায়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে এবং সাসটেইনেবিলিটি রেটিংয়ে সম্মানজনক পর্যায়ে থেকে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে পারবে। অপরদিকে গ্রাহক পর্যায়েও চাহিদা বহুলাংশে পূরণ হবে।

লেখক: ফ্যাকাল্টি মেম্বার, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)

আরও পড়ুন

×