ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার

কতটা প্রস্তুত সমাজ

কতটা প্রস্তুত সমাজ

মহাখালী বাস টার্মিনালে ‘মাতৃদুগ্ধ সেবন কেন্দ্র’ রয়েছে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ভেতরে দুটি মোটরসাইকেল রাখা, দুটি ছোট টেবিল রয়েছে আর দু’জন লোক বসে আছেন।

এ আর শ্যামলী

প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ০৫:৪৫

শিশুর মানসিক ও শারীরিক বৃদ্ধি ও পুষ্টির জন্য মায়ের বুকের দুধের বিকল্প নেই। জনসমাগমস্থলে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। তবে অনেক কর্মস্থল বা বাস, ট্রেন স্টেশনে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপন করা হয়নি বা তা সুরক্ষিত নয়। এতে মায়েদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। আমাদের বিষয়টি কতটুকু গ্রহণ করতে পেরেছে, তা নিয়েও আছে প্রশ্ন। লিখেছেন এ আর শ্যামলী

‘মায়ের এক ধার দুধের দাম/ কাটিয়া গায়ের চাম/ পাপোশ বানাইলেও/ ঋণের শোধ হবে না…।’ কথা: মঈন সাঁই

যে সমাজ গেয়ে ফেরে এই গান, সেই সমাজেই মায়েরা তাঁর দুগ্ধপোষ্য সন্তানকে নিয়ে ঘরের বাইরে বের হলে ক্ষুধায় কাতর শিশুর মুখে সংকোচহীনভাবে বুকের দুধ তুলে দিতে পারেন না। অন্যদিকে নির্বিঘ্নে দুধ খাওয়ানোর মতো খুঁজে পান না এক চিলতে জায়গা। কোলের শিশুটি যখন ক্ষুধায় কাতর হয়ে কাঁদতে শুরু করে তখন বিরক্ত বোধ করে আশপাশের মানুষজন। ওই মাকেই তখন শুনতে হয় লোকের কটু কথা। কেন তিনি এতটুকু শিশুকে নিয়ে বাইরে এসেছেন, কেন খাবার বানিয়ে নিয়ে আসেননি! এসব সয়েও যদি কোনো মা তাঁর শিশুসন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে বসেন, তবে তাঁর দিকে ধেয়ে আসে হাজার জোড়া চোখ। যে চোখের ভাষায় কুঁকড়ে যেতে হয় মাকে। সমাজ, সংসার, রাষ্ট্র নারীকে মা হওয়ার জন্য যে পরিমাণ উৎসাহ জোগায়; সেই পরিমাণ দেখভালের জায়গা রাখে না। মাকে লজ্জার বেড়াজালে ঘিরে রাখে; বদলায় না দীর্ঘদিনের দৃষ্টিভঙ্গিও।

এ প্রসঙ্গে আমরা দেখে নিতে পারি কয়েকটি বাস্তব ঘটনা–

ঘটনা-১: নাদিয়া মাহমুদ টুশি। বয়স ৩২। মা হওয়ার পরে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো নিয়ে অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলে বলেন, আমার মেয়ে আসিয়াকে যে পেডিট্রেশিয়ানকে দেখাই, তিনি অনেক নামকরা শিশু বিশেষজ্ঞ। তাঁর ব্যক্তিগত চেম্বারে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার নেই। এ ছাড়া ওকে আরও কয়েকজন ডাক্তার দেখাই, তারাও শিশু বিশেষজ্ঞ। তারা শিশুদের ফর্মুলা খাবার খাওয়াতে মানা করেন; কিন্তু নিজেদের চেম্বারে ব্রেস্ট ফিডিংয়ের কোনো জায়গা রাখেননি।

ঘটনা-২ : সামিয়া আহমেদ (ছদ্মনাম) কিছুদিন হলো দ্বিতীয়বারের মতো মা হয়েছেন। সন্তানের যত্ন-আত্তিতে কোনো ত্রুটি রাখতে নারাজ মাইশা। কিন্তু বুকের দুধ পান করানোর ক্ষেত্রে মাইশা পড়ে যান সংকটে। তাঁর আরও একটি সন্তান রয়েছে। তাকে স্কুলে দিয়ে আসা, নিয়ে আসার সময় দুধের শিশুটিকেও সঙ্গে নিতে হয়। স্কুলের পাশেই তাঁকে অপেক্ষা করতে হয় ঘণ্টা তিনেক। এই সময়ের মধ্যে কোলের শিশুটির ক্ষিধে পেলে ছটফট করতে থাকেন তিনি। একটু আড়ালের অভাবে প্রায়ই শিশুটিকে বুকের দুধ পান করাতে পারেন না। এ জন্য তাঁকে আগেই পাম্প করে ফিডারে দুধ নিয়ে রাখতে হয়। কখনও কখনও সেটি সম্ভব না হলে বাধ্য হয়ে বাইরের কেনা দুধই খাওয়ান। একবার এমন হয়েছে, তাড়াহুড়ো করে বের হতে গিয়ে ফিডারে রাখা খাবার নিতে ভুলে গেছেন। বড় সন্তানকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে রাস্তায় অপেক্ষা করার সময় শিশুটি ক্ষুধায় কাঁদতে শুরু করে। তখন তাঁর খেয়াল হয়, তিনি খাবার আনেননি। অথচ পরিস্থিতি এমন যে তিনি তখন বাসায়ও ফিরতে পারবেন না আবার রাস্তায় দাঁড়িয়ে বুকের দুধও খাওয়ানো সম্ভব না। তখন অন্য মায়েরা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নিজেদের ওড়না দিয়ে আড়াল তৈরি করলে দুধ খাইয়েছিলেন।

এমনই ঘটনার শিকার এক মা ২০১৯ সালের গত ২২ অক্টোবর নিরাপদ পরিবেশে ও স্বাচ্ছন্দ্যে মায়ের বুকের দুধ পান করতে ৯ মাসের শিশু উমাইর বিন সাদিকের পক্ষে তাঁর মা ব্যারিস্টার ইশরাত হাসান এই রিট দায়ের করেন। রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানির পর ২০১৯ সালের ২৭ অক্টোবর দেশের সব কর্মক্ষেত্র, এয়ারপোর্ট, বাসস্টেশন, রেলস্টেশন, শপিং মলে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার ও বেবি কেয়ার কর্নার স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। এছাড়াও পাবলিক প্লেস ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপনে নীতিমালা তৈরি করতে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, রুলে তাও জানতে চান আদালত। এ বিষয়ে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে চলতি বছরের ২ এপ্রিল (রোববার) বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী ইবাদত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রায় দেন। তা সত্ত্বেও বদল হয়নি সমাজের চিত্র। বাসস্ট্যান্ড, কর্মক্ষেত্র, রেলস্টেশন, বেশির ভাগ শপিং মল, লঞ্চ, স্কুল-কলেজসহ যে কোনো ধরনের পাবলিক জায়গা, এমনকি হাসপাতালগুলোতেও নেই ফিডিং কর্নার। এর ফলে বুকের দুধ পান করে এমন শিশুসহ মায়েদের ভোগান্তির শেষ নেই।

এ প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া (আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট) বলেন, ‘২০১৩ সালের মাতৃদুগ্ধ বিকল্প, শিশুখাদ্য, বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুত করা শিশুর বাড়তি খাদ্য এবং সেটি ব্যবহারের সরঞ্জামাদি (বিপণন নিয়ন্ত্রণ) আইনে ব্রেস্ট ফিডিংকে উৎসাহিত করা হয়েছে। মূলত মাতৃদুগ্ধের যে বিকল্প সামগ্রী রয়েছে, সেসব বিপণন নিয়ন্ত্রণের জন্য আইনটি করা হয়। ১৯৮৪ সালে একটি অর্ডিন্যান্স জারি করা হয় ব্রেস্ট ফিডিং নিয়ে। সেই আইন বাতিল করে ২০১৩ সালে নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়। ব্রেস্ট ফিডিংকে উৎসাহ দেওয়া হয়। ২০১৩ সালে এ বিষয়ে আইন প্রণয়নের জন্য একটি বিধিমালার প্রয়োজন হয়। কেননা বিধিমালা না থাকলে আইন প্রয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়। সেই বিধিমালা ২০১৫ সালেও কার্যকর হয়নি। অথচ নিয়ম হলো, বিধিমালা প্রণয়নের ছয় মাসের মধ্যে তা কার্যকর করা। ওই আইনে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপনের কথা কোথাও উল্লেখ নেই। হাইকোর্ট গত ২ এপ্রিল ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপনের ওপর রুল জারি করেন। ২০১৩ সালের আইনে বিধি ভঙ্গের কারণে শাস্তি দেওয়া হবে বলা আছে। ওই আইনে যেহেতু ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপনের বিষয়টি উল্লেখ নেই, সে ক্ষেত্রে কেউ যদি এই কর্নার স্থাপন না করেন তাহলে শাস্তি কীভাবে হবে তা নির্ধারিত নয়। যদি আইনে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপনের বিষয়টি আনা হয়, তাহলে ফৌজদারি বা দেওয়ানি মামলা বা অর্থদণ্ডের মতো শাস্তি নিশ্চিত করা যাবে। সরকার আইন প্রণয়ন করলে সেটি কার্যকরের জায়গাটিও সরকারকেই তৈরি করে দিতে হবে। তা না হলে ব্রেস্ট ফিডিং ইস্যুতে মায়েদের দুর্ভোগের শেষ হবে না। সরকার আরও খানিকটা অগ্রসর হয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতে পারে। বিভিন্ন অফিস-আদালত, জনবহুল জায়গা, মার্কেটসহ সব জায়গায় ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপনের যে নির্দেশনা, সেটি কার্যকর হলো কিনা দেখতে পারে। সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও এ বিষয়ে উদ্যোগী হয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।’

বিশ্বজুড়ে মা শব্দটি যেন এক অমিয় ধারা। মা মানেই অপত্য স্নেহের আধার। সেই মাকেই তাঁর সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানো নিয়ে প্রতিনিয়ত পড়তে হয় নানা বিড়ম্বনায়। এ বিড়ম্বনাই হতে পারে মা ও সন্তানের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির কারণ। এ বিয়য়ে হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘প্রতিটি শিশুর অধিকার মায়ের বুকের দুধ পান করা এবং প্রতিটি সভ্য রাষ্ট্রের দায়িত্ব শিশুটিকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ার উপযোগী সামাজিক পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া। এ জন্য যেমন– অফিস, স্কুল, মার্কেট, পার্ক, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন ইত্যাদি জায়গায় ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার তৈরি করে দেওয়া। আমাদের দেশের বড় বড় শহরে কোথাও কোথাও আছে, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার নেই। অথচ শিশুটির বুকের দুধ খাওয়ার মধ্যে লুকিয়ে আছে তার স্বাভাবিক বিকাশ এবং এটিই তার বিকাশের সঠিক পন্থা। শিশু যদি ঠিকমতো বুকের দুধ না খায় তাহলে তার মস্তিষ্ক গঠন ব্যাহত হয়। তাই সুস্থ শিশুর জন্য ব্রেস্ট ফিডিং একটি জরুরি বিষয়। অন্যদিকে এটি মায়ের জন্যও উপকারী। দেখা গেছে, যে মা সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ান, তাঁর স্তন ক্যান্সার কম হয়। অন্যদিকে যিনি তা করেন না, তাঁর স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি থাকে। একই সঙ্গে যে নারীর ছোট শিশু আছে, তিনি যদি বাইরে অনেকক্ষণ থাকার কারণে তাঁকে বুকের দুধ খাওয়াতে না পারেন, তাহলে স্তনে দুধ জমে ইনফেকশনও হতে পারে। কখনও কখনও সেই ইনফেকশনের কারণে স্তনের ভেতরে পুঁজ জমে যায়। পরে অপারেশন করতে হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘বুকের দুধ খাওয়ানোর মাধ্যমে সন্তানের সঙ্গে মায়ের অবিচ্ছেদ্য বন্ধন তৈরি হয়। কোনো মা যদি তাঁর বুকে পর্যাপ্ত দুধ থাকা সত্ত্বেও সন্তানকে সময়মতো খাওয়াতে না পারেন এতে মা ও শিশু মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’

আমাদের সমাজে নারীরা সবক্ষেত্রেই সাফল্যের সঙ্গে বিচরণ করছে। অথচ নারীর লিঙ্গীয় পরিচয়ের কারণে বিড়ম্বনা যেন শেষ হওয়ার নয়। এ সামাজিক মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের পরিচালক (জেন্ডার কর্মসূচি) নবনীতা চৌধুরী বলেন, ‘‘আমাদের সমাজের মূল মনোভাব হলো– মেয়েরা বাইরে যাবে কেন? নারীদের বাইরে যাওয়ার বিষয়টিই যেখানে গ্রহণ করতে পারেনি, সেখানে মায়েরা শিশুদের নিয়ে বাইরে যাবে, তাদের জন্য ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার থাকবে– এমনটা ভাবতেই পারে না। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো রাস্তাঘাটে, গণপরিবহনে মেয়েদের রোজকার ভোগান্তি। এমন পরিস্থিতিতে ব্রেস্ট ফিডিং নিয়ে যখন আলোচনা হচ্ছে তখন আমি মনে করি, এটি একটি শুভ দিক। সমাজের পরিবর্তনটা টিমটিম করে হলেও এগিয়ে চলেছে। রাষ্ট্রের মনোভাবের যে পরিবর্তন শুরু হয়েছে। নানা জায়গায় ‘ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার’ লেখা একটি নির্দিষ্ট জায়গা বা কর্নার বরাদ্দ করা হয়েছে; এটি মায়েরা সন্তানসহ সেখানে যাওয়ার একটি স্বীকৃতি। এই বিষয়টি বড় একটি পরিবর্তন। এর যথাযথ বাস্তবায়নের দায় রাষ্ট্রের রয়েছে।’’

আরও পড়ুন

×