ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

নারীর পারিশ্রমিকে অধিকার কতটুকু

নারীর পারিশ্রমিকে অধিকার কতটুকু

ছবি: সাখাওয়াৎ হোসেন সাফাত

--

প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। তবে এখনও শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ পুরুষের তুলনায় অনেক কম। গত ৩০ বছরে গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন খাতে নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এখন প্রায় সব ধরনের কাজেই নারীর অংশগ্রহণ রয়েছে। অথচ নিজের পারিশ্রমিকে তাদের অনেকেরই অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। লিখেছেন সানজিদা আহমেদ

আসমা বেগম (ছদ্মনাম) ঢাকায় আসেন বছর পাঁচেক আগে। মূলত পাশের বাড়ির জোবেদাকে দেখেই তাঁর ঢাকায় আসা। জোবেদা ঢাকায় একটি গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করেন। গার্মেন্টসের বেতন আর কাজের কথা শুনে আসমার খুব ইচ্ছা হয় কাজ করার। তাই আসমা আর তাঁর স্বামী ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় আসার পর জোবেদা আসমাকে গার্মেন্টসে কাজ খুঁজে দেন। এভাবেই দেখতে দেখতে পাঁচ বছর পেরিয়ে যায়। একটি শার্ট সেলাই করতে করতে আসমা কথাগুলো ভাবছিলেন। আজ আসমার বেতন পাওয়ার দিন। কিন্তু আসমার এতে কোনো উৎসাহ নেই। গত পাঁচ বছরে আসমা তাঁর বেতনের কোনো টাকাই নিজের মতো করে খরচ করতে পারেননি; না পেরেছেন নিজের মা-বাবাকে কোনো টাকা দিতে। স্বামীকে এসব নিয়ে বলতে চেয়েছেন কয়েকবার। কিন্তু স্বামী বলেন, ‘তোর সমস্যা থাকলে ঘর করিস না।’ আসমা ভাবেন, স্বামী না থাকলে এ সমাজে বেঁচে থাকাটা আরও বেশি দুরূহ।

মিতু (ছদ্মনাম) গার্মেন্টসে কাজ করেন আজ প্রায় তিন বছর। তিনি সুপারভাইজার রোকনকে প্রায়ই বলেন, ‘স্যার, আমাগো বেতন আসার মেসেজ মোবাইলে না দিলে হয় না। মেসেজ তো পান জামাই। নিজে যে কিছু টাকা সম্বল রাখমু, হেইডা আর হয় না। সব টাকা লইয়া যায়। কিছু কইলে মারধর করেন। দেখেন না কিছু করা যায় কিনা!’ জীবনটাকে তাঁর খুব অসহ্য মনে হয়। বাড়িতে এক টাকাও তিনি দিতে পারেননি এই তিন বছরে।

আসমা আর মিতুর গল্প কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। লাখো নারী শ্রমিকের গল্পটা কমবেশি এমনই। গার্মেন্টসে কঠোর পরিশ্রম করলেও নিজের টাকার ওপর নেই তাদের কোনো অধিকার। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বিরূপ অবস্থার মধ্যেও টিকে থাকার জন্য যে দুটি খাতকে কৃতিত্ব দেওয়া হয়, এর একটি তৈরি পোশাক শিল্প; অপরটি প্রবাসী আয়।

২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো রপ্তানি থেকে ৫২.০৮ বিলিয়ন ডলার আয় করে। এর মধ্যে কেবল তৈরি পোশাক খাত থেকে ৪২.৬১ বিলিয়ন ডলার, যা মোট রপ্তানির ৮১.৮১ শতাংশ। এটি ছিল লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৯.৭৩ শতাংশ বেশি। বিপুল অঙ্কের এই রপ্তানির পেছনে রয়েছেন গ্রাম থেকে উঠে আসা লাখ লাখ নারী। কর্মক্ষেত্রে মানুষের অংশগ্রহণের হিসাব রাখা হয় লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন (এলএফপি) বা শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ পরিমাপকে। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে এলএফপিতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ৪ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে এটি পৌঁছেছে ৩৬ শতাংশে। পরে করোনাকালে অবশ্য ১ শতাংশ কমেছে।

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অধিক অংশগ্রহণকে অনেক বিশেষজ্ঞ নারীর ক্ষমতায়ন হিসেবে দেখছেন। যদিও এ নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনাও রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, নারীর শ্রম সস্তা। তাই পোশাকশিল্পে নারীদের নিয়োগ দেওয়া হয় বেশি। সাভারের গার্মেন্টস সিকেডিএলের জেনারেল ম্যানেজার আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, ‘পোশাকশিল্পে অনেক নারী আসছেন, এটি ঠিক। নারীরা কাজেও দক্ষ। বর্তমানে বেশির ভাগ গার্মেন্টসে কর্মীর নিরাপত্তা, সুযোগ-সুবিধা, যৌন হয়রানিমুক্ত কর্মপরিবেশের মতো বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে আমলে নেওয়া হয়। গার্মেন্টসের প্রত্যেক কর্মী এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ পান।’ নারীর নিজের আয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে কিনা– এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বেশির ভাগ নারী কর্মীর গল্প একই। গার্মেন্টসে বেতন বা যে কোনো ধরনের বোনাস ব্যাংকে দেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে টাকা ব্যাংকে ক্রেডিট হওয়ার সময় মোবাইলে মেসেজ যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্বামীর মোবাইল নম্বর দেওয়া থাকে। বেতনের বিষয়টি মোবাইলে মেসেজের মাধ্যমে দেখলে অফিস ছুটির সময় স্বামী বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন। মেয়েটি আর টাকা নিজের হাতে নিতেও পারেন না। অনেকে প্রতিবাদ করতে চাইলেও সংসার ভাঙার ভয়ে করেন না। অনেক শ্রমিকই এ বিষয়গুলো জানান।’

জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ধীমান হালদার বলেন, ‘নারীর ক্ষমতায়নের রয়েছে বিভিন্ন নির্দেশক। একেকজন মানুষের ক্ষেত্রে নির্দেশক একেক ধরনের হতে পারে। কোনো নারীর জন্য যদি সেটি চলাচলের স্বাধীনতা হয়, কোনো নারীর জন্য সেটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ। শুধু চাকরিতে আসা মানেই নারীর ক্ষমতায়ন নয়।’ নারী শ্রমিকদের আয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নারী শ্রমিকের ক্ষমতায়নে পুরুষদের সম্পৃক্ত করার বিকল্প নেই। নারী ও পুরুষ এ সমাজেই বেড়ে ওঠেন। একজন পুরুষ যখন একজন নারীকে তাঁর অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন– এ বিষয়টি সেই পুরুষ অনুধাবন করতে পারেন না। কারণ তিনি ভেবে নেন, এটাই নিয়ম। তাই তিনি তাঁর স্ত্রীর আয়ের ওপর সম্পূর্ণ অধিকার দেখান। স্ত্রী প্রতিবাদ করলে নির্যাতন করেন এবং তালাকের হুমকি দেন। গার্মেন্টস এ সমস্যা সমাধানে কর্মীদের স্বামীদের নিয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে পারে। সেটা হতে পারে কোনো সচেতনতামূলক আলোচনা অথবা কোনো পথনাটক অথবা অন্য যে কোনো পদক্ষেপ; যেখানে স্বামী ও স্ত্রী একসঙ্গে অংশগ্রহণ করবেন।’

পিতৃতান্ত্রিক এ সমাজব্যবস্থায় নারীর ক্ষমতায়নের পথটি মোটেও সুগম নয়। বিভিন্ন পক্ষের আন্দোলনের ফলে কর্মীদের সুরক্ষা নিয়ে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে ও হচ্ছে। কিন্তু পারিবারিক জীবন নিয়ে কাজ করার বিষয়টি এখনও গুরুত্ব কম পাচ্ছে। আজও বেশির ভাগ নারী শ্রমিকের নিজের পারিশ্রমিকে নেই কোনো অধিকার। গার্মেন্টসে প্রতিটি সেকেন্ডের মূল্য কাজ দিয়ে মূল্যায়ন করা হয়। কর্মী যদি সেখানে মানসিক অবসাদ নিয়ে কাজ করেন, তবে কাজের গুণগতমানের ব্যাঘাত ঘটে। তাই নারী শ্রমিকদের পারিবারিক জীবনের সমস্যা নিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া, বিশেষ করে নিজের পারিশ্রমিকে অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিতে পারেন গার্মেন্টস মালিকরা। পুরুষদের সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে নিয়মিত প্রচারণা ও বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্য দিয়েই নারী শ্রমিকের এ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

লেখক : উন্নয়নকর্মী

আরও পড়ুন

×