শ্রদ্ধাঞ্জলি
মানুষ ও ভাষা

সৈয়দ শামসুল হক [২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫–২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬]
সৈয়দ শামসুল হক
প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক নানা রচনায় শিল্প ও শিল্পকৌশল নিয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করেছেন। তাঁর বিভিন্ন বইয়ের ভূমিকায় তিনি এ প্রসঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর তাঁর সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষে তাঁর দুটি রচনার চুম্বক অংশ পত্রস্থ হলো।
১.
মানুষ জন্ম নেয়, কিন্তু সে-জন্ম তার ওপরে চাপিয়ে দেওয়া একটি ঘটনা; মানুষ জন্ম নেয়, বেড়ে ওঠে এবং অচিরেই সে আবিষ্কার করে– সে হয় এক দুঃশীল দুর্বোধ্য পৃথিবীতে। কিছু প্রশ্ন ক্রমশ বিপুল, প্রবল ও বিনাশী হয়ে দেখা দেয় তার কাছে– আমি কে? আমি কেন? আমি কোথায়?
আমার পক্ষে এ জীবন ধারণ এবং এ জীবনের প্রতি মমতা পোষণ সহজ হতো যদি সমস্ত কিছুই ‘পূর্বর্নির্ধারিত’ এবং ‘পূর্বপরিকল্পিত’ বলে আমি বিশ্বাস করতে পারতাম; আবার এটাও আমার কাছে অসম্ভব বলেই মনে হয় যে, এই জগৎ, এই সমস্ত কিছু কোনো নিয়ম বা শৃঙ্খলা একে ধরে নেই।
আমি কল্পনা করি, আমি যেন সেই লক্ষ বৎসর আগে এই পৃথিবীতে, আমার প্রিয় একটি কল্পনা এই, আমি নির্মেঘ ও অযুত তারাজ্বলা রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি গুহার ভেতর থেকে– শব্দহীন কিন্তু গভীরতর অর্থে বড় শব্দময় এক পৃথিবী, অন্ধকার কিন্তু গভীরতর অর্থে বড় আলোকিত এক পৃথিবী, তবু কিছুই আমি শুনতে পাচ্ছি না, কিছুই আমি দু’চোখ বিস্ফারিত করেও দেখতে পারছি না।
আমি কে?– আমাকে ভাবায়; আমি কেন?– আমাকে ভীত করে; আমি কোথায়?– আমাকে নিঃসঙ্গ করে দেয়।
আমার অভিজ্ঞতা বলে, এই মৌলিক প্রশ্নগুলো মানুষ বারবার বিবেচনা করেছে একদা তার মহাকাব্যে, এবং এখন, বিশেষ করে বিশ শতকের প্রায় শুরু থেকেই তার উপন্যাসে। উপন্যাস আমি তাকেই বলি, তার দৈর্ঘ্য যা-ই হোক না কেন, যেখানে এই মৌলিক প্রশ্নগুলো বিবেচিত হয়, চরিত্রগুলো এই সন্ধান সূত্রেই এমনভাবে বদলে যায় যে সে আর আগের মানুষটি থাকে না। এই সন্ধান সব সময় সচেতন একটি প্রক্রিয়া, তা নয়; আবার কখনও এমনও হতে পারে, যে আকস্মিকভাবে সে নিক্ষিপ্ত হয় এই প্রক্রিয়ার ভেতরে।
যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, আমি বলব– জীবনের কোনো অর্থ বা কারণ আছে বলে আমি মনে করি না। আমরা যা করি তা হচ্ছে জন্মলাভ করবার পর এ জীবনের একটি কারণ নির্ণয় করবার চেষ্টা করি, অস্তিত্বকে অর্থে পুরিত করতে আকাঙ্ক্ষা করি।
উপন্যাসে আমি এই প্রসঙ্গগুলো বিবেচনা করতে চেয়েছি এবং আমি দেখেছি, শেষ পর্যন্ত এই-ই দেখেছি যে, মানুষ নিঃসঙ্গ, মানুষ সাহসী, মানুষের ভেতরে আছে যে কোনো দিকে মোড় নেবার সম্ভাবনা এবং জীবনে আর যা-ই থাক, বিস্ময় বলে কিছু নেই।
সম্ভবত এ সংকলনের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত লেখা খেলারাম খেলে যা– রচনার প্রায় কুড়ি বছর পরও এর জন্য আমাকে আমার অন্যান্য রচনার চেয়ে অনেক বেশি জবাবদিহি করতে হয়। ‘খেলারাম খেলে যা’ এ দেশের সবচেয়ে ভুল-বোঝা উপন্যাস। না, এ উপন্যাসের জন্য আমি লজ্জিত নই, বরং আমি লজ্জিত তাদের জন্য, যারা উপন্যাসের নেপথ্য একটি চরিত্র– বাবর আলীর বোনকে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে কেবল বাবলি বা জাহেদার কথা মনে রাখে। আমি খুব কম পাঠককে জানি, যিনি উপন্যাসের একেবারে শেষ বাক্যটি লক্ষ্য করেছেন। আমার বিশ্বাস, এই শেষ বাক্যটিতে দাঁড়িয়ে কেউ এ উপন্যাসের জন্য আমাকে তিরস্কার করতে পারবেন না।
লক্ষ্য করে থাকবেন অনেকেই হয়তো, যে, আমার গল্প এবং উপন্যাসে আমি একটি ছোট শহর এবং তার আশেপাশের কিছু জনপদ, গ্রাম ও ভূগোল ব্যবহার করে থাকি, শহরটির নাম জলেশ্বরী– যে শহরে আমার জন্ম সেই কুড়িগ্রামের ওপর ভিত্তি করে কাল্পনিক এই শহর এবং এর মানচিত্র আমি গড়ে তুলেছি। কিছু আসল নাম এবং অধিকাংশ কাল্পনিক নাম দিয়ে গড়ে তোলা এই অঞ্চলটি আমার সবচেয়ে চেনা জনপদ কুড়িগ্রাম– একদা যে কুড়িগ্রাম ছিল ব্রিটিশ বাংলার সবচেয়ে দুর্গম এবং গরিব এলাকার একটি এবং শুধু যে কারণেই আমার বাবা ডা. সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন এই অঞ্চলটিকে ১৯২০ সালে বেছে নিয়েছিলেন তাঁর কর্মস্থল হিসেবে। কুড়িগ্রামের মাটি আমার শরীরে, কুড়িগ্রাম আছে আমার জলেশ্বরীর গভীরে।
কেবল ভূগোল নয়, কুড়িগ্রাম থেকে বহু মানুষ উঠে এসেছে আমার উপন্যাসে– প্রধান, অপ্রধান বহু চরিত্র কুড়িগ্রামের অনেকেই– বিশেষ করে আমার সমসাময়িক যারা– চিনতে পারবেন।
এখনও যে উপন্যাসটি আমি লিখিনি, যে উপন্যাসের বীজ আজও বহন করে চলেছি ১৯৫৩ সাল থেকে, তার পটভূমি জলেশ্বরী এবং তার নায়ক জলেশ্বরী।
১৬ জানুয়ারি ১৯৯০
[ভূমিকা: শ্রেষ্ঠ উপন্যাস]
২.
আমি যখন ক্লাস টেনের ছাত্র, সে ১৯৪৯ সালের কথা, তখন বাংলা দ্রুতপঠনের খাতে একটি প্রবন্ধের বই নির্ধারিত ছিল। নীল মলাটে সস্তা কাগজে ছাপা বই। প্রথম প্রবন্ধটি শহীদুল্লাহ সাহেবের লেখা। নাম- অভিধানে আমোদ। তাঁর প্রস্তাব ছিল– এই যে কত সব শব্দ আমাদের এত চেনা– এদের একেকটির ভেতরে পোরা আছে কতই-না মজার তথ্য। বস্তুত ভাষারই সে ইতিহাস আর গল্পকথা। সেই প্রবন্ধ পড়ে আমার চোখ খুলে যায়। শব্দ আমাকে খেলাতে শুরু করে। সে খেলার আমি-এই পুতুলটিকে অদৃশ্য সুতোয় নাচাতে থাকেন প্রাতঃস্মরণীয় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।
ভাষা ও শব্দের প্রতি আমার চোখ ফেরানো– এর পেছনে আরও দুটি কথা আছে। যখন লিখতে শুরু করি– ১৯৫১ সালে প্রথম লেখাটি ছাপিয়ে, প্রায় দেড় বছর পরে আবার যখন কলম ধরি, তখন এ দেশের সাহিত্যরচনার পর্যায় ও সাহিত্যপাঠের রুচি, কোনোটিই আধুনিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিল না। সেই আধুনিকতা আনবার হাড়ভাঙা কাজটি আমাকেই করতে হবে, আর, তখন বাংলা ভাষাটাই ছিল পাকিস্তানিদের হাতে বিপন্ন, লিখে যেতে হবে বাংলাতেই। রাজনৈতিক পর্যায়ে শুরু হয় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করবার আন্দোলন। আর আমি লিখতে থাকি– সৃষ্টিশীলতার ব্যক্তিগত অন্তর্গত চাপ অতিরেকে– বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্যই যেন গল্প ও কবিতা।
... কথা বলা বা লিখতে পারাটাই বড় নয়। ভাষাবোধ থাকতে হয়। নইলে ভাষা আমাদের দিয়ে কথা বলিয়ে নেবে ঠিকই, ভাষাকে দিয়ে আমরা কথা বলিয়ে নিতে পারব না। চট করেই আমরা মানুষ-অমানুষ চিনতে পারি, কিন্তু ভাষাবোধ যার নেই, তার ভাষা শুনেও ব্যাপারটা সহজে ধরতে পারব না। এর কারণ, ভাষা আমাদের শেখানো হয়, কিন্তু ভাষাবোধ আমাদের ভেতরে সৃষ্টি করা হয় না। ভাষা আর ভাষাবোধ এক জিনিস নয়। আমাদের বাক্য ব্যাকরণের বিচারে হয়তো শুদ্ধ, কিন্তু ভাষাবোধটি না থাকলে ভাব-প্রকাশ শুদ্ধ নাও হতে পারে।
ভাষার দিকে তাকিয়ে দেখি, জলের মতোই সে মানবজীবনকে সম্ভব করে তুলেছে, মানবজীবনের ঘটমানতার পেছনে নিরন্তর সে ক্রিয়াশীল রয়েছে। মানবজাতির সঞ্জীবন ও উদ্দীপন হয় ভাষাতেই। শিশুর প্রথম মা ডেকে ওঠা, কবির প্রথম জল পড়ে পাতা নড়ে রচনা করে ওঠা, পড়ো সেই প্রভুর নামে– এই প্রত্যাদেশ পেয়ে ওঠা, সবই ভাষায়। ওম্ ধ্বনি থেকে জগৎ। লেট দেয়ার বি লাইট, অ্যান্ড দেয়ার ওয়াজ লাইট– আলোর আদেশ হয়েছিল বলেই আলো। কুনফা ইয়াকুন– হও এবং হইলো। ভাষাতেই তবে এই শক্তি, এই সৃজন, এই অগ্রসরণ। আমরা হতেই পারি না ভাষা ছাড়া। আমরা ভাবতেই পারি না ভাষা বিহনে।
... ভাষার জায়গা দুটি। উচ্চারণ আর লেখন। উচ্চারণ করে দেখি সারা দিন আর সাড়া দিন। গুপ্তচর আর গুপ্তচড়। জিভের ডগায় এক। লেখনে ধাঁধা! সাড়া দিন-এর বদলে সারা দিন লিখলে কেউ সাড়া দেবে বলে মনে হয় না। গুপ্তচরের হাতে গুপ্তচড় খাবারও ভয় আমাদের থাকবে না। মানুষের উচ্চারণটা আগে এসেছিল, তার অনেক পরে লেখন। লেখনেই যদি কথা পৌঁছে দিতে হয়, শব্দের বানানটা তবে মোটেই হেলা করা কর্তব্য হয় না। লেখনের আগে যেহেতু উচ্চারণ, উচ্চারণটি ঠিক করলে বানানও ঠিকমতো কলমে আসে। শব্দ এবং শব্দ ব্যবহার করে বাক্য রচনা, এর মাধ্যমে ভাব প্রকাশ করা, ভাষার এটাই হচ্ছে কাজ। শুধু কি তাই? ভাব গোপন করাও ভাষার একটি কাজ। রাজনীতিকরা আর কিছুতে না হোক ভাষা ব্যবহারের এই চাতুরীতে বড় পারঙ্গম। যিনি যত, তাঁর উন্নতিও তত। ভাষা ব্যবহার করবার এই অপকৌশলটি কেবল রাজনীতিকই কি ব্যবহার করে?
চারদিকে উচ্চারণের কোলাহল। কীই বাগ্মিতা! কতটাই-না মিথ্যা কথন শোনা হলো এই বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় জন্ম নিয়ে। ভাষার যে-দাবি, ভাষায় সেই চিন্তন ও অভিজ্ঞতা ব্যবহারের সৃজনশীলতা আমরা মনে হয় হারিয়েই ফেলেছি। সেই সৃজনশীলতার কথা বলছি যা দিয়ে সত্যকে সত্য, মিথ্যাকে মিথ্যা, অন্যায়কে অন্যায় বলে আমরা চিনে উঠতে পারি, বীরকে বীর বলে গ্রহণ করতে পারি, অসুরকে অসুর।
প্রতিদিনের ভাষা ব্যবহারে আমি লেখক হয়েও সাধারণই বৈকি। এই সাধারণ মানুষের অসাধারণ একটি ভূমিকা আছে, সামান্য মানুষের অসামান্য একটি কাজ– ভাষায়। ভাষাকে সচল রাখা, ভাষাকে বদলে দেওয়া। নদী যেমন চলতে চলতে নতুন একটা বাঁক নেয়, কথা বলতে বলতেও ভাষা নেয় বাঁক। এই সাধারণের মুখেই বাক্যগঠনের রীতি পালটায়।
গায়কের সপ্তস্বর, চিত্রকরের রং, নর্তকের মুদ্রা, সাহিত্যেও আমার সৃজনের উপকরণ শব্দ। শব্দ বিনা ভাব কিছু নয়। ভাব আকার ধরে উঠতেই পারে না শব্দের সহায় বিনা।
১৮ জানুয়ারি, ২০০৬
[ভূমিকা : কথা সামান্যই]
- বিষয় :
- শ্রদ্ধাঞ্জলি
- সৈয়দ শামসুল হক