সৈয়দ মুজতবা আলী
শাঁখের করাতে কাটা

সৈয়দ মুজতবা আলী [১৩ সেপ্টেম্বর ১৯০৪–১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪]
নূরুর রহমান খান
প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:১৮
শান্তিনিকেতনের প্রথম মুসলমান ছাত্র সৈয়দ মুজতবা আলী ১৯২১ সালে স্কুল বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন এবং ১৯২৬ সালে বিশ্বভারতী থেকে দু’জন– বাচুভাই শুক্লা এবং সৈয়দ মুজতবা আলী স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। হাতে লেখা তাঁদের সনদপত্র অলংকরণ করেছিলেন নন্দলাল বসু এবং তাতে স্বাক্ষর করেছিলেন বিশ্বভারতীর আচার্য গুরুদেব– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অতঃপর ১৯৩২-এ জার্মানির বন্ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে ডি.ফিল ডিগ্রি অর্জন।
রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য মুজতবা আলী সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে থেকে মনুষ্যত্বের সাধনার ব্রত নিয়েছিলেন, ধর্ম নয়– মনুষ্যত্বই মানুষের একমাত্র পরিচয় এবং এই সত্যবোধ অন্যদের মধ্যে জাগ্রত করতে হয়েছেন প্রয়াসী। বিশেষ করে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সৌহার্দের সেতুবন্ধের জন্য আমরণ নিরলস সংগ্রাম করেছেন। তাঁর রচনায় সাম্রাজ্যবাদের প্রতি ঘৃণা, নির্জিত পরাধীন জাতির প্রতি অসীম করুণা এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামী চেতনার প্রতি সশ্রদ্ধ অভিনন্দন, সর্বোপরি হিন্দু-মুসলমানের মিলন কামনায় তাঁর আর্তি সুপ্রকাশিত। মুজতবার নিজস্ব শৈলীতে সাহিত্যগুরুদের উল্লেখে তার প্রমাণ বর্তমান: ‘আমি মুসলমান। আমার শাস্ত্রে আছে বিধর্মীর ভয়ে আল্লা রসুলকে বর্জন করা মহাপাপ। আমার সাহিত্যধর্মে গুরু-মুর্শীদ হয়ে আছেন রবিঠাকুর, হাইনে, তুর্গেনেফ, মাইকেল।’ তাঁর আরেক মুর্শীদ ঈশ্চরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ‘কস্যচিৎ ভাইপোস্যে’র ভাষায় তিনি আপন রচনাশৈলীর দিকনির্দেশ লাভ করেছিলেন। তাই ‘বীরসিংহগ্রাম’ ‘তাঁর তীর্থভূমি’। দু’শ বছরের পরাধীনতার গ্লানি মুজতবা আলীকে ব্রিটিশের প্রতি বিদ্বিষ্ট করে তুলেছিল। ফলে সরকারি স্কুল বর্জন করেছেন, কখনও ইংরেজের অধীনে চাকরি গ্রহণের কথা ভাবতেই পারেননি এবং যে কোনো সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে তিনি মনুষ্যত্ব তথা মানবসভ্যতার নিকৃষ্টতম শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন; স্বাধীন ভারতের নাগরিক হিসেবে কামনা করেছেন– ‘আমাদের যেন রাজ্যলোভ না হয়। ... পরাধীনতার বেদনা আমরা জানি। আমরা যেন কাউকে পরাধীন না করি।’ বিভাগোত্তরকালে ১৯৪৭ সালের ৩০ নভেম্বর সিলেটে এক বক্তৃতায় আলী সাহেব ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন: ‘পূর্ব পাকিস্তানের অনিচ্ছা সত্ত্বেও যদি তার ঘাড়ে উর্দু চাপানো হয় তবে স্বভাবতই উর্দু ভাষাভাষী বহু নিষ্কর্মাও শুধু ভাষার জোরে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করার চেষ্টা করবে– ... এবং ফলে জনসাধারণ একদিন বিদ্রোহ করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।’ মাত্র চব্বিশ বৎসরের মধ্যে তাঁর বাণী যথার্থ প্রমাণিত।ধর্মীয় সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে জেহাদ ছিল সৈয়দ মুজতবা আলীর জীবনের মূলমন্ত্র এবং সর্বাবস্থায় মনুষ্যত্বের জয়গানে যাঁর লেখনী ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। অথচ সাম্প্রদায়িক কাল্পনিক আচ্ছাদনে আবৃত করে তাঁকে লোকসমাজে হেয়প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টা হয়েছে উভয় বঙ্গে। এই সম্প্রদায় পশ্চিম বাংলায় তাঁর উদার ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিকে ‘ধুরন্ধর পাকিস্তানি এজেন্ট’-এর ‘একটা আইওয়াশ’ বলে অপপ্রচারে মেতে উঠেছিল, তেমনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এদেরই সমগোত্রীয়দের বিচারে তিনি ছিলেন ‘ধুতি-চাদর পরা, তিলক-কাটা এবং নামাবলী গায়ে’, ‘পৌত্তলিকতার এজেন্ট, তেত্রিশ কোটি দেবতার মুসলমান পূজারী’, ‘বাংলা ভাষার হালজামানার খ্যাতিমান লেখক’! পশ্চিম বাংলার ঈর্ষাকাতর হীনমন্যজন তাঁর জীবন বিষময় করে তুলেছিল, তেমনি এপারের স্বধর্মীয় গোঁড়া কূপমণ্ডূকদের ক্ষমাহীন আচরণ বীভৎস কুৎসিততম রূপ ধারণ করে তাঁর প্রাণসংহারেও ছিল অকুণ্ঠিত। এর পরেও যেটা সুখের বিষয় সত্য-সুন্দর-মঙ্গলের সাধক মুষ্টিমেয় হলেও আছেন এবং ছিলেন। তাঁরা প্রতিবাদ করেছেন। মুজতবা আলীরা বৈরী পরিবেশেও আবিষ্কার করেছেন তাঁরা একা নন, নিঃসঙ্গ নন, ভরসা হারাবার কোনো হেতু নেই। আলী সাহেব পরবর্তীকালে পরম শ্রদ্ধায় দুর্দিনের বন্ধু সমমর্মীদের প্রতি তাঁর আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। সর্বোপরি বাংলার বিদগ্ধ পাঠক সমাজ তাঁকে হৃদয়ে বরণ করে নিয়েছিলেন একান্ত আপনজন হিসেবেই। যুগে যুগে লাঞ্ছিত হলেও তাঁদের দুঃখের কারণ নেই। বিশেষ করে মুজতবা আলী অবগত ছিলেন:
‘বাঙলাদেশে একটা দল আছে। ... এ দল পরপর রামমোহন, দেবেন্দ্রনাথ, ঈশ্বরচন্দ্র এবং সর্বশেষ রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধাচরণ করে উপস্থিত অন্তঃসলিলা। মোকা পেলে বুজ্বুজ্ করে বেরুতে চায়।’ এই ‘বুজ্বুজে’র দল বিভিন্ন সময়ে মুজতবা আলীর মর্মান্তিক মানসিক নির্যাতনের কারণ হয়েছে। রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মাতৃভাষাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা হয় এবং তারই ফলে ঢাকায় স্থাপিত হয় ‘বাংলা একাডেমী’। প্রতিষ্ঠানটির মুখপত্র ‘বাংলা একাডেমী পত্রিকা’র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হলে সৈয়দ মুজতবা আলী সাপ্তাহিক ‘দেশ’-এ পঞ্চতন্ত্র কলামে পত্রিকাটির বলিষ্ঠ উদ্যোগের প্রশংসা করে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন। সুতরাং তাঁর আলোচনা পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধগুলিতেই সীমাবদ্ধ ছিল এবং নিবন্ধকারদের মহত্ত্বর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে তিনি আন্তরিক স্বাগত জানিয়েছিলেন। উক্ত পত্রিকায় এমন কয়েকটি প্রবন্ধ ছিল, যার মূল বক্তব্য– মাতৃভাষা চর্চায় বাঙালি মুসলমানের অবদান। কারণ সুস্পষ্ট। তখনও পূর্ব পাকিস্তানে সুপরিকল্পিতভাবে অপপ্রচার চলছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে বাঙালি মুসলমানের কোনো যোগসূত্র নেই এবং ছিল না। এমনকি তাদের মাতৃভাষা বাংলা কি না, সে প্রশ্ন নানাভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে উপস্থাপন করা হতো। প্রকাশিত নিবন্ধগুলো ছিল তারই অভ্রান্ত জবাব। সম্ভবত পত্রিকা-পরিচিতিমূলক নিবন্ধটির মূল সুর উপলব্ধি করতে অসমর্থ জনৈক পাঠক মুজতবা আলীকে সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করে ‘দেশ’-এর সম্পাদককে লেখেন, ‘এই পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধগুলির বিবরণ হইতে মনে হইবে যে পূর্ববঙ্গের সাহিত্য একমাত্র মুসলমানদিগেরই জিনিষ। উক্ত পত্রিকার কর্মকর্তারা ভুলিয়া যাইতে চান যে হিন্দু-মুসলমানের সমবেত চেষ্টার ফলেই বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টি ও পুষ্টি। হিন্দু কবিদের নাম ইচ্ছা করিয়াই এড়াইয়া যাওয়া হইয়াছে। ... অবশ্য কেহ যদি সাহিত্যের ক্ষেত্রেও সাম্প্রদায়িকতার সর্বনাশা সীমারেখা টানিতে চান সে কথা স্বতন্ত্র।’ পত্রিকাটির পীঠস্থান এবং সেখানকার সমকালীন রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত হলে সম্ভবত তিনিও পত্রিকাটিকে সাদর সম্ভাষণ জানাতেন। ১৯৬৪ সালের ৩ অক্টোবর, আকাশবাণীর কোলকাতা কেন্দ্র থেকে মুজতবা আলী ‘সত্য ঘটনামূলক’ কথিকা ‘কোষ্ঠী-বিচার’ নামে প্রচারিত এবং শারদীয় বেতার জগতে গল্পাকারে প্রকাশিত হয়। বন্ধুপত্নী রাধারানী মুখোপাধ্যায় তাঁর কনিষ্ঠা ভগ্নি সরজু গঙ্গোপাধ্যায়ের দুর্ভাগ্যের কাহিনি আলী সাহেবকে শুনিয়েছিলেন। সরজু দেবীর স্বামী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বোমা বর্ষণে বোম্বাই বন্দরে নিহত হন। ঘটনাটি মুজতবা আলী তুলে ধরেছিলেন ‘কোষ্ঠী-বিচার’-এ। ভাগ্যহতা সরজুই হচ্ছে কোষ্ঠী-বিচারের মাধুরী এবং বোম্বাই বন্দর রূপান্তরিত হয়েছে মাদ্রাজে– এইটুকু মাত্র পরিবর্তন।
কথিকাটি শ্রবণ ও পাঠ করে জনৈক বিক্ষুব্ধ শ্রোতা-পাঠক ২৪ অক্টোবর কোলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক যুগান্তর’ পত্রিকায় লেখেন: “এরূপ একটি জাতিবিদ্বেষমূলক কথিকা (বেতার জগতে গল্প) প্রচার ও প্রকাশ মোটেই সমীচীন হয়নি, যখন ভারতবর্ষ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত। যে কোনো হিন্দু বাঙালি ভদ্রলোক ... লেখকের এই হিন্দু বিদ্বেষমূলক আচরণে বিস্মিত ও বিক্ষুব্ধ হবেন। লেখক সাহিত্যের মধ্যে অশ্লীলতাকে যে কীভাবে স্থান দিলেন এবং আবার তা বেতার কর্তৃপক্ষ কী করে অনুমোদন করলেন, তার চিন্তার কথা। ... হিন্দু ও বাঙালির দেব-দেবী পূজার ওপর লেখকের বিদ্বেষ ও বিদ্রুপ-কটাক্ষ মোটেই সহ্য করা যায় না ... ‘ওঁয়ারা তো ছিলেনই, এঁয়ারাও এসে জুটলেন।’ এইরূপে হিন্দু দেবতা সম্বন্ধে তাচ্ছিল্যকর মন্তব্যের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য কী? ... এ রকম সাম্প্রদায়িক অসৎ মনোভাবের পরিচয় আরও মেলে। ... এরূপ অশালীন ও ধর্মবিদ্বেষমূলক ‘গল্প’ ‘বেতার জগৎ’ ও বেতার কর্তৃপক্ষ কী করে প্রকাশ ও প্রচার করলেন।” ‘মুজতবা আলীর এমন চমৎকার একটি কথিকার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ আবিষ্কার করার দৃষ্টান্তে’ ‘স্তম্ভিত’ বিশিষ্ট সাহিত্যিক পরিমল গোস্বামী তীব্রতম ভাষায় এর প্রতিবাদ করেছিলেন। তাঁর নয়টি শানিত যুক্তির অন্যতম– “আচারসর্বস্বতা যদি হিনডুইজম হয় তা হলে তাতে প্রথম আঘাত হেনেছেন শ্রীচৈতন্যদেব। সতীদাহ যদি হিনডুইজম হয় তা হলে রামমোহন রায় তার অপমান করেছেন। চিরবৈধব্য রক্ষা যদি হিনডুইজম হয় তা হলে তার ওপর আঘাত হেনেছেন বিদ্যাসাগর। পুরোহিত প্রথা যদি হিনডুইজম হয় তবে বিবেকানন্দ ‘আগে পুরোতগুলোকে দূর কর’ বলে তাকে অপমান করেছেন।” সবক’টি যুক্তি উপস্থাপন করে মোক্ষম বাণ ছুড়ে পরিমল গোস্বামী লক্ষ্য ভেদ করেছেন– ‘আলোচ্যমান গল্পের লেখকের নাম আলী না হয়ে কোনো দেবশর্মা হলে কোনো প্রশ্নই উঠতো না।’ একটি পত্রে মুজতবা আলী একই প্রসঙ্গে পরিমল গোস্বামীকে লিখেছিলেন, ‘ঢাকায় একটি কাগজে editorial রূপে সিরিয়াল বেরুচ্ছে– আমি হেঁদু হয়ে গিয়েছি। ... ওরা বলে আমি কাফের, এরা বলে আমি লেড়ে। ভালোই, রাইকুল শ্যামকুল দুই-ই গেল। নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।’
- বিষয় :
- নিবন্ধ