অভিযান লামাদের দেশে

হিমালয়ের পথে ইকরামুল হাসান শাকিল
ইকরামুল হাসান শাকিল
প্রকাশ: ১১ মে ২০২৪ | ১২:৫১
তিব্বত লামাদের দেশ, আধ্যাত্মিকতার দেশ, জাদুবিদ্যার দেশ, চিরতুষারাবৃত হিমালয় আর অরণ্য বেষ্টিত একটি অজ্ঞাত দেশ। সেখানকার অধিবাসীদের রীতিনীতি, আচার-ব্যবহার, ধরন-ধারণ আমরা কিছুই আগে জানতাম না। যে স্থানের উপত্যকাগুলোর উচ্চতা সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ১৫ হাজার ফুটের ওপরে, এ সম্পর্কে আমাদের কৌতূহল কম নয়। এর বেশকিছু কারণ ছিল। যেমন– তিব্বতে যাওয়া সহজ ছিল না; কোনোভাবে সেখানে যাওয়া গেলেও তাদের জীবন-রহস্য সম্পর্কে জানা যেত না। তাই তিব্বত সম্পর্কে মানুষের জানার আগ্রহ বরাবরই একটু বেশি ছিল। আধ্যাত্মিক বৌদ্ধ ধর্মগুরু মিলারেপা যেসব স্থানে সাধনারত ছিলেন বা ধ্যান করেছিলেন, তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্মে তা তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। তেমনি একটি তীর্থস্থান নেপালের গোরখা জেলায় অবস্থিত। সামাগাঁও ও সামদো গ্রামের মাঝামাঝি স্থানে অরণ্যঘেরা পাহাড়ে এক বড় পাথরের নিচে মিলারেপা গুহা।
সামাগাঁওয়ের হোটেল নুব্রি ভ্যালিতে থাকার ব্যবস্থা হলো। এখানে দুপুরের খাবারের সময় হোটেলের মালকিনের সঙ্গে গল্প হচ্ছিল। তখনই তাঁর কাছ থেকে মিলারেপা গুহা ও মিলারেপা সম্পর্কে জানতে পারি। আগে বইয়ে পড়েছি মিলারেপা সম্পর্কে। তাই গুহাটি দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। আমার সঙ্গে থাকা গাইড তাশি গ্যালজেনকে বললাম, খাবার শেষেই চলো সেখানে যাই। যেমন কথা তেমনই কাজ। খাবার শেষ করে আর দেরি করলাম না। মিলারেপা গুহা দেখার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। চড়াই আর পথের দৈর্ঘ্য যেন শেষ হতেই চাচ্ছে না। সবুজ পাতার ঝোপ ঠেলে এগিয়ে চলছি। হঠাৎ হঠাৎ ঝোপের ভেতর থেকে পাখির ঝাঁক ফুরুৎ করে উড়ে যাচ্ছে। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক সময় লেগে গেল আমাদের মিলারেপা গুহায় পৌঁছাতে। বিশাল বড় এক পাথর যেন লম্বা হয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। পাঁচ রঙের প্রেয়ার ফ্ল্যাগ বাতাসে পত্ পত্ করে উড়ছে। কোনো মানুষজন নেই এখানে।
আগে এখানে গুহা ছিল। এখন সেই গুহাকে পাথর বসিয়ে বসিয়ে দেয়াল করে একটি ঘরের মতো করে মন্দির বানানো হয়েছে। বন্ধ কাঠের দরজা আমি খুললাম। ভেতরে দরজার সামনেই ১৬টি প্রদীপ জ্বলছে। পায়ের বুট খুলে আমি ভেতরে ঢুকলাম। তাশি আমার পেছন পেছন ভেতরে ঢুকল। চারপাশের দেয়ালে বৌদ্ধ ধর্ম বিশ্বাসের চিত্রকর্ম। ডান পাশে লামা বসার আসন। সেই আসনে বসে লামা প্রার্থনা করেন। দড়িতে ঝুলছে একটি ড্রাম। যেটা প্রার্থনার সময় ঢং ঢং করে বাজানো হয়। ভেতরে ১১টি মূর্তি। সবার মাঝখানে বৌদ্ধের মূর্তি। সাতটি মূর্তি সোনালি রঙের, দুটি মূর্তি কালো এবং দুটি সাদা রঙের। সবার বামে সাদা রঙের মূর্তিটিই মিলারেপার। বৌদ্ধের মূর্তির সামনে বিভিন্ন ধরনের খাবার ছোট ছোট বাটিতে রাখা আছে। তাশি তাঁর ধর্মীয় নিয়ম মতো প্রার্থনাও করে নিল।
দুই.
অদ্ভুত এক শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল। হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। হিমাংকের নিচে তাপমাত্রা থাকা সত্ত্বেও ঘেমে যাচ্ছি। ভয়ে গলাটাও শুকিয়ে গেছে। ধীরে ধীরে স্লিপিং ব্যাগের জিপারটা বুক পর্যন্ত খুলে নিঃশ্বাস চেপে রেখে বাইরের শব্দটা ভালো করে শোনার চেষ্টা করছি। তাঁবুর বাইরে বড় দেহের কোনো এক প্রাণীর অস্তিত্ব বুঝতে পারলাম। কিছু একটা চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। অদ্ভুত সেই শব্দে তেমনই মনে হচ্ছে। আকাশে মেঘ নেই, তারায় ছেয়ে আছে পুরো আকাশ। বাতাসও বইছে মৃদু গতিতে। তাঁবুর ভেতর থেকে বাইরে কিছুটা আলো আছে। তাই তাঁবুর ভেতর থেকে বাইরের প্রাণীর দেহটি স্পষ্ট ছায়ার মতো দেখা যাচ্ছে।
প্রাণীটি দেখে মনে হচ্ছে তাঁবু থেকেও উঁচু এবং বড়। এত বড় প্রাণী! ইয়েতি? না, ইয়েতি বলতে কিছু আছে বলে আমার বিশ্বাস হয় না। গত রাতেও শিয়াল এসে তাঁবুর বাইরে মহড়া দিয়ে গেছে। ভয় বেড়েই চলছে। গত তিন দিন আগে শেষ গ্রাম ছেড়ে এসেছি। যতটা জানি, সামনে আরও পাঁচ-ছয় দিন কোনো গ্রাম বা মানুষের দেখা পাব না। ধীরে ধীরে নিঃশব্দে উঠে বসলাম। অন্ধকারে হাত দিয়ে হেড টর্চ খুঁজতে লাগলাম। খুঁজে পাচ্ছি না। হাতের কাছে পানির বোতল পেলাম। পানিও পান করতে পারলাম না। জমে বরফ হয়ে আছে। আবার হেড টর্চ খুঁজতে লাগলাম। এবার টর্চটা খুঁজে পেলাম নিজের মাথার মধ্যেই। রাতে ঘুমানোর আগে যে টর্চটা মাথায় লাগানো ছিল সেখানেই আছে। টর্চটা কি জ্বালাব? নাকি জ্বালাব না। না জ্বালিয়েই রুকস্যাকের পকেট থেকে আগে সুইচ নাইফটি বের করে হাতে নিলাম। আস্তে আস্তে তাঁবুর জিপার সামান্য খুলে দেখার চেষ্টা করলাম।
অল্প ফাঁকা দিয়ে যতটা দেখতে পেলাম কোনো প্রাণী চোখে পড়ল না। তাঁবুর জিপার একটু বেশি করে খুলে মাথা বের করে চারপাশটা দেখার চেষ্টা করলাম। ভয়ে গা জমে যাওয়ার অবস্থা। মাথা বের করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁবুর পেছন থেকে সেই বড় দেহের প্রাণীটি দৌড়ে দূরে সরে গেল। মাথাটা মুহূর্তের মধ্যেই তাঁবুর ভেতরে ঢুকিয়ে ফেললাম। ভয়ে শরীরের সব শক্তি নিমেষেই শেষ হয়ে গেল। নিজেকে বোঝালাম এখানে মৃত্যুর থেকে বড় কিছু হওয়ার নেই। এখানে আমাকে মেরে ফেলবে এমন কোনো প্রাণী থাকার কথাও নয়। আবার সাহস নিয়ে মাথা বের করলাম। তাঁবু থেকে ২০-২৫ মিটার দূরে সাদা রঙের কয়েকটা ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে। বড় আকারের তিনটি ঘোড়া ও ছোট একটা ঘোড়ার বাচ্চা। ভয় দূর হলো। পকেট থেকে একটা চকলেট বের করে মুখে নিয়ে ভাবতে লাগলাম, এই জীবনে কি এর থেকে বেশি ভয় কখনও পেয়েছিলাম?
তিন.
সালদাং গ্রামের প্রধান লামার বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা হলো। এ গ্রামের ঘরগুলোর আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে অন্য সব গ্রামের থেকে। এখানে যেহেতু বড় বড় গাছ নেই তাই কাঠের ব্যবহারও কম। এমনকি খুব বেশি পাথরও যেহেতু নেই সেহেতু এখানে পাথরের ব্যবহারও কম। এখানে নুড়ি মিশ্রিত মাটি দিয়ে ঘরগুলো তৈরি। প্রতিটি বাড়িতে একটি করেই বড় ঘর। একেকটি ঘরে অনেক কক্ষ। প্রায় প্রতিটি ঘরই দোতলা। নিচ তলায় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখা হয়। ওপরের ঘরগুলোয় থাকার ব্যবস্থা।
অনেক পুরোনো কাঠের দরজা ঠেলে ঘরের ভেতরে ঢুকলাম। নানা জিনিসপত্র রাখা আছে চারপাশে। দেখে মনে হচ্ছে একটি গোডাউন। ওপরের কক্ষে যাওয়ার জন্য একটি গাছের গুঁড়ি রাখা আছে। এই গুঁড়িটি সিঁড়ির মতো খাঁচকাটা। এর মাধ্যমেই ওপরে উঠে এলাম। পুরো বিকেলটাই কাটালাম গ্রামটি ঘুরে। গ্রামের একটি বাড়িতে বেশকিছু মানুষের ভিড় দেখতে পেলাম। এগিয়ে গিয়ে দেখলাম একজন মৃত মানুষের সৎকারের জন্য ধর্মীয় ও সামাজিক কাজগুলো পালন করা হচ্ছে।
কাল সকাল পর্যন্ত চলবে এ আনুষ্ঠানিকতা। তারপর সকালে গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে পাহাড়ের ওপরে নিয়ে যাওয়া হবে মৃতদেহটির সৎকার করতে। এরা মৃতদেহকে কবর দেওয়া বা চিতায় দাহ করে না। এদের সৎকারের প্রথা অন্যরকম। মৃতদেহটিকে টুকরো টুকরো করে কেটে শকুন, চিলদের খেতে দেওয়া হয়। মাংসাশী পাখিরা মৃতদেহটির মাংস খেয়ে উড়ে যায়।