‘গৃহহীনমুক্ত’ ঘোষিত জেলা-উপজেলার বাস্তবতা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন

ছবি : সাজ্জাদ হোসেন নয়ন
সমকাল ডেস্ক
প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২৪ | ২৩:৪৫ | আপডেট: ২৬ মার্চ ২০২৪ | ২৩:৫৫
গৃহহীনমুক্ত বলে ঘোষণা দেওয়া জেলা-উপজেলাগুলো আসলেই গৃহহীনমুক্ত কিনা, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশিষ্টজন। তারা বলেন, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন এলাকা সরকারিভাবে গৃহহীন-ভূমিহীনমুক্ত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিভিন্ন মাধ্যমে প্রায়ই শুনতে হয়েছে বা হচ্ছে যে, গ্রামে এখন আর ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষ নেই। ইতোমধ্যে পত্রপত্রিকায় এবং সরকারের ওয়েবসাইটে ভূমিহীনমুক্ত ৩২টি জেলা এবং ৩৯৪টি উপজেলার নাম ঘোষণা করা হয়েছে। এর বাস্তবতা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে গত ১০ মার্চ রোববার রাজধানীর সিরডাপের এটিএম শামসুল হক মিলনায়তনে ‘উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় নারীর ভূমিকা ও ভূমি অধিকারের বাস্তবতা’ শীর্ষক জাতীয় সেমিনারে তারা এসব কথা বলেন।
‘যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটস্ (ইউএস ডস)’, ‘ল্যান্ডেসা’ এবং ‘ইন্টারন্যাশনাল ল্যান্ড কোয়ালিশন (আইএলসি)’-এর সহযোগিতায় ‘স্ট্যান্ড ফর হার ল্যান্ড’, ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি)’ এবং ‘বাংলাদেশ ল্যান্ড রাইটস নেটওয়ার্ক’ যৌথভাবে এর আয়োজন করে। সেমিনারের মিডিয়া পার্টনার ‘সমকাল’
গাজী মোহাম্মদ সোহরাওয়ার্দী
আজকের ভূমিহীনদের বড় অংশই ‘গতকালের’ খুদে পারিবারিক কৃষক, আর ‘আগামীকাল’ এরাই ক্ষেত-মজুর-এর ‘অন্তিম কৃষি-পরিচয়’ লয় করে, ভিড় করবে শহরের অনানুষ্ঠানিক খাতে, ঠাঁই নেবে বস্তিতে। শহরে অভিবাসন প্রত্যাশিত। কিন্তু এই ধরনের অভিবাসন কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। ‘গ্রামে ভূমিহীন মানুষ আছে, (বিদ্যমান অবস্থা চলতে থাকলে) ভবিষ্যতেও থাকবে’– এই কঠিন বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে নীতিনির্ধারণ, উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়ন-বাস্তবায়ন করতে হবে।
ভূমিহীনমুক্ত এলাকা ঘোষণা করলেই কি আমরা লাখ লাখ প্রকৃত ভূমিহীন মানুষ ভূমির মালিক হয়ে যাবো? সর্বশেষ কৃষিশুমারি ২০১৯ অনুযায়ী, ‘পল্লী অঞ্চল’-এ ভূমিহীন পরিবারের সংখ্যা প্রায় ২৩ লাখ ২৩ হাজার ২৭০, যা মোট গ্রামীণ খানার ১২.৮৪%। কৃষিশুমারির প্রায় ১ কোটি এই ভূমিহীন মানুষ কোথায় আছেন? ভূমিহীনতা, খাসজমি, আশ্রয়ণ প্রকল্পসংক্রান্ত বিষয়ে প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য দেশের উত্তর-মধ্য-দক্ষিণাঞ্চলের তিনটি জেলার ৩টি উপজেলায় জনসাধারণ, ভূমি অধিকারকর্মী, গণমাধ্যমকর্মী, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে এই সমীক্ষাপত্র তৈরি করা হয়েছে। ‘ভূমিহীনমুক্ত’ এই প্রপঞ্চের পেছনে যে মূল কারণ জানা যায় তা হলো আশ্রয়ণ প্রকল্পে দরিদ্রদের ঘর দেওয়ার জন্য যে তালিকা তৈরি করা হয়েছিল সেটিই এর ভিত্তি। এই তালিকা অনুযায়ী ঘর দেওয়ার পরপরই কিছু এলাকা ভূমিহীনমুক্ত হয়ে গেছে বলে ঘোষণা করা হচ্ছে। কিন্তু স্থানীয় জনগণ, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে জানা যায় প্রকৃত ভূমিহীনদের ক্ষুদ্র একটি অংশ এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছিল। তাই এই রকমের ঘোষণা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকর ও আত্ম-প্রতারণামূলক।
রাশেদ খান মেনন, এমপি
বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে প্রথম ভূমিহীনদের খাসজমি দেওয়ার বিষয়ে নীতিমালা করা হয়। পরবর্তী সময়ে সেই নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় এসে পুরুষের সঙ্গে নারীর খাসজমির অধিকার বিষয়ে গুরুত্ব দেন। তবে যে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছিল, তা বেশ কঠিন ছিল। এখন আবার সবকিছু উল্টে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, দেশে কোনো ভূমিহীন নেই, কোনো গৃহহীন নেই। ভূমিহীনদের ভূমি দিতে হবে, গৃহহীনদের গৃহ দিতে হবে– এই নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দেখেছি, এই কথা বলে ভূমিহীনদের জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার বিষয়টি স্থগিত হয়ে গেছে। যেসব জেলা বা উপজেলা ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে, সেই জায়গায় আসলেই ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত হয়েছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখা দরকার।
কৃষিক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ দিন দিন বাড়ছে। সেই অংশগ্রহণের বিষয়টি স্বীকৃত না। শুধু এটিই নয়, নারীর গৃহস্থালি কাজও জিডিপিতে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য নীতিমালা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন সময়। এখনও তা জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। সুতরাং কৃষিক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণকে স্বীকৃতি দেওয়া দরকার। একইসঙ্গে কৃষিতে নারী-পুরুষের যে মজুরি বৈষম্য রয়েছে, সে বিষয়ও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
সম্প্রতি ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো উদ্বৃত্ত জমি রাখা যাবে না। এর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। আমি এ নিয়ে ভূমিমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি আমাকে বলেন, নীতিমালা তৈরি হচ্ছে। সেই নীতিমালা কতদিন ধরে তৈরি হবে, কবে তৈরি হবে– সেটি আমাদের জানা নেই। নিয়ম আছে, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কৃষিকাজ করার ক্ষেত্রে ৩৩ বিঘার বেশি জমি থাকা যাবে না। দেখা যায় এর থেকে অনেক বেশি জমিতে একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষাবাদ করেন। এ ছাড়াও আদিবাসীদের সরিয়ে দিয়ে তাদের জমি দখলে নেওয়া হচ্ছে। এমনকি আদিবাসীদের বাড়ির অধিকারও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এখন সময় এসেছে এ বিষয়ে কথা বলার। ভূমিহীন নেই, গৃহহীন নেই– এমন যুক্তি দিয়ে খাসজমি বণ্টন না করার বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার।
ফওজিয়া মোসলেম
মানুষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার হলো বাসস্থান ও সম্পত্তির অধিকার। টিকে থাকার জন্য মাথার ওপর একটি ছাদ লাগে। আশ্রয়ণের অধিকার মানুষের একটি জন্মগত দাবি এবং ভূমি অধিকারের মূল ভিত্তি। ভূমি আইন বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে জনগণের চাহিদার ভিত্তিতে। ভূমির অধিকার আইনের ক্ষেত্রেও নারীর অবদান কম নয়। বাংলাদেশের কিংবদন্তি নারীনেত্রী ইলা মিত্র তেভাগা আন্দোলনের সময় ভয়ংকর সহিংসতার শিকার হয়েছিলেন। তার একটাই দোষ ছিল, তিনি কৃষকের ভূমির অধিকার আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। ভূমি অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে নারীরা সবসময় যুক্ত থেকেছেন। তবে বর্তমান সময়ে ভূমির অধিকারবিষয়ক আইনগুলো বাস্তবায়নে ধীরগতি দেখা যায়। এ বিষয়ে আদালতের সহায়তা নেওয়ার সুযোগ খুব সীমিত, প্রশাসনও আইন বাস্তবায়নে খুব বেশি যত্নবান নয়। স্থানীয় স্বার্থ, কায়েমি স্বার্থ, প্রভাবশালীদের স্বার্থ ও সাম্প্রদায়িক শক্তি ভূমি অধিকার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। এ ছাড়া সমাজব্যবস্থায় নারী ও সংখ্যালঘুবিরোধী পরিমণ্ডল তৈরি করা হয়েছে। এই পরিমণ্ডলে নারী ও সংখ্যালঘু মানুষ ভূমির অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
শামসুল হুদা
এএলআরডি তিন-চার দশক ধরে ভূমি অধিকার নিয়ে কাজ করে আসছে। আমরা প্রাক্তন ভূমিমন্ত্রী, ভূমি সচিব সবার সাথেই খাসজমি বন্দোবস্ত বিষয়ে আলোচনা করেছি। খাসজমি বন্দোবস্ত নীতিমালার সঠিক বাস্তবায়নের বিষয়ে দাবি তুলেছি। গৃহায়ন ও শিল্পায়নের জন্য খাসজমিগুলো ব্যবহার হবে বলে প্রাক্তন ভূমিমন্ত্রী আমাদের জানিয়েছিলেন। খাসজমি সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকে। সুতরাং প্রকৃত নীতিমালা অনুসরণ করে খাসজমি সরকারের কাছ থেকেই ভূমিহীনদের কাছে যেতে হবে। এই দাবিতেই আমরা বারবার অটল থেকেছি। খাসজমিকে সরকারের ভূমিসংক্রান্ত আলোচনার মূল এজেন্ডা হিসেবে আমরা নিয়ে আসতে চাই।
আমি প্রথমে শুনেছিলাম ১৫৩টি, পরে শুনলাম ৩৯৪টি উপজেলা নাকি ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত। এটা শুনে আমার মনে হলো, এসব উপজেলা সেই রকম ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত, যেমনটা ৪৫ বছর ধরে শুনলাম ‘আদিবাসী আছে’। হঠাৎ শুনি এ দেশে কোনো আদিবাসী নেই। অথচ আদিবাসী দিবসে প্রধানমন্ত্রীও বাণী দিয়েছেন। এই বাণী বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিতও হয়েছে। আমরাও আদিবাসী দিবসে আদিবাসী ফোরামের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছি। তারপরও বলা হচ্ছে, আদিবাসী নেই। ভূমিহীন ও গৃহহীনদের ব্যাপারটাও এমন হয়ে গেছে। আদিবাসী নেই বললেই তো আদিবাসী নেই হয়ে যাবে না কিংবা ভূমিহীন নেই বললেও ভূমিহীন নেই হয়ে যাবে না। যাদের ভূমি ও ঘর দেওয়া হয়েছে তারা আসলেই ভূমি ও ঘর পাওয়ার যোগ্য কিনা, সেটিও খতিয়ে দেখা দরকার। অনেক জায়গায় দেখা গেছে, যাদের বাড়ি দেওয়া হয়েছে তারা সেই বাড়িতে থাকেন না। কারণ তাদের বাড়ি তো দেওয়া হয়েছে কিন্তু চাষাবাদের জন্য কোনো জমি দেওয়া হয়নি। ফলে জীবিকার সন্ধানে তারা অন্য জায়গায় চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। দেখা গেছে, তারা বাড়িটি অন্যের কাছে বিক্রি করে দিয়ে চলে গেছেন। তারা বাড়িটি দলিল করে দেননি, বরং ক্রেতাকে বাড়ির দলিল হস্তান্তর করে চলে গেছেন। এই যদি হয় গৃহহীনদের ঘর দেওয়ার পরিণাম, তাহলে এই প্রকল্প টেকসই হবে না।
উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু সেই উন্নয়ন একপেশে। উন্নয়নের পাশাপাশি বৈষম্য বেড়েছে, দুর্নীতি বেড়েছে। একই সঙ্গে সুশাসনের অভাব প্রকট হয়েছে। কোনো প্রতিষ্ঠানই ঠিকমতো কাজ করছে না। ডিজিটালাইজেশন হচ্ছে, তবে তাতে সব মানুষ যে উপকৃত হচ্ছে, তা আমরা বলতে পারি না। বরং একটি গোষ্ঠী উপকৃত হচ্ছে।
অধ্যাপক ড. সীমা জামান
নারী বঞ্চনা শুরু হওয়ার প্রধান কারণ নারীর অধিকারই স্বীকৃত নয়। অধিকার নেই কারণ অধিকার থাকতে একজন মানুষের ন্যূনতম যে শিক্ষাগত যোগ্যতা, আর্থিক সচ্ছলতা থাকা দরকার তার সবদিক থেকেই নারীরা অনেক পিছিয়ে আছে। আমরা নারীদের ভূমি অধিকারের কথা যখন বলি সেখানে অন্যতম বিষয় হচ্ছে উত্তরাধিকার আইন। সেটা নিয়েও বিতর্ক চলছে, চলবে। আর একটি হচ্ছে খাসজমি বিতরণ নীতিমালা, যেখানে নারীর জমি পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তবে জমির সংকট ও সরকারের নেওয়া বিভিন্ন বৃহৎ প্রকল্পের জন্য খাসজমিগুলো ভূমিহীনদের না দিয়ে সেখানে গৃহায়ন প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। গবেষণা পত্রে দেখা যাচ্ছে, গৃহায়ন প্রকল্পে যাদের ঘর দেওয়া হচ্ছে তাদের অনেকেই সেই ঘরে থাকছে না, ভাড়া দিয়ে দিচ্ছে। আবার অনেকেই বলছে প্রভাবশালীরা ঘরগুলোর দখল নিচ্ছে। গবেষণায় আরও দেখা যাচ্ছে, যেসব জমি গৃহায়ন প্রকল্পে দেওয়া হয়েছে, তা বাসস্থানের জমি ছিল না, তা চাষের জমি ছিল। কৃষিজমি বা নালা ভরাট করে এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ফলে আর্থিক একটি ক্ষতি হয়েছে।
সরকার নিজেই বলে কৃষিজমি অকৃষি কাজে ব্যবহার করা যাবে না, তাহলে সরকারি প্রকল্পের নামে কৃষিজমি অকৃষি কাজে ব্যবহার করা ঠিক হবে না। আমরা যদি মানুষের ঘর করে দিই কিন্তু তার আয়ের উৎস বন্ধ করে দিই তাহলে সে কীভাবে বাঁচবে?
১০ শতাংশ করে জমি ১০ জনকে না দিয়ে যদি তা সমবায়ের মাধ্যমে অনেককেই দিতে পারি তাহলে তা বেশি ভালো হবে। নারীকে ভাবতে হবে যে খাসজমি একসময় শেষ হয়ে যাবে, তখন তারা কী করবে। তাই এখন থেকেই ভাবতে হবে। নারী অধিকারের জন্য আমাদের শিক্ষা-রাজনীতিতে নারীকে এগিয়ে আসতে হবে। নারী অধিকার আন্দোলনে নারীকে সোচ্চার হতে হবে। শুধু উত্তরাধিকার বা খাসজমির মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ না রাখলে আমরা আমাদের অধিকার অর্জন করতে পারব।
সঞ্জীব দ্রং
উন্নয়ন চিন্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সব মানুষ কি সমানভাবে এগিয়ে যাচ্ছে? সবাই কি তার মৌলিক অধিকার পাচ্ছে? শুধু খাদ্য পেলেই হবে না। সেটা মানসম্মত এবং নিরাপদ কিনা, সেটাও দেখা প্রয়োজন। উন্নয়নের সঙ্গে আমাদের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আদিবাসীরা সবসময় বলি ‘ভূমিই জীবন’। পাহাড়ে ভূমি রেজিস্ট্রি হয় না। খাসিয়া কিংবা গারো অঞ্চলে এখনও ভূমি রেজিস্ট্রি হয় না। পৌত্রপৌত্রাদিক্রমে আমরা সেই জমির অধিকার ভোগ করছি। শুধু বাংলাদেশই নয়, ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই বিশেষ ব্যবস্থা বিদ্যমান রয়েছে। মালিকানার সংস্কৃতি সব জায়গায় একরকম নয়।
নারীর অধিকার আদায়ে আমাদের চুপচাপ বসে থাকলে হবে না। আমাদের সবাইকে যার যার জায়গা থেকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। আমাদের সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে। দীর্ঘদিন আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন গঠিত হয়েছে। এর কোনো কার্যকারিতা এখনও নেই। এ ছাড়া ১৬ বছর আগে বর্তমান সরকার সমতলের আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এর কোনো খবরই নেই। এ বছর যেন এটি করা হয়, এটা আমাদের দাবি। আন্তর্জাতিক নারী দিবস, মানবাধিকার দিবস কিংবা আদীবাসী দিবস আমাদের নানাভাবে জানান দিয়ে যায়, আমাদের সক্রিয় করে তোলে। আমি তরুণদের নিয়ে আশাবাদী। সামনে তাদের জন্য একটা দীর্ঘ সময় রয়েছে। সমাজে যে বৈষম্য রয়েছে, তা দূর করতে তরুণদের কাজ করতে হবে।
সংগ্রামের মধ্য দিয়ে খাসজমিতে এ দেশের সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমাদের কাজ করতে হবে। আদিবাসী, দলিত, চা শ্রমিক, বস্তিবাসীসহ সবার জন্য আমাদের কথা বলতে হবে। এ দেশের মেহনতি মানুষ তাদের শ্রমের দাম পান না। এটা আমাদের দেশের অন্যতম বড় সমস্যা। যেদিন নারীকে বা কন্যাকে আমরা মানুষ হিসেবে সম্মান করতে পারব, মর্যাদা দিতে পারব, সেদিনই আমাদের দেশের উন্নয়ন ফলপ্রসূ হবে। আমাদের শিক্ষা, সমাজ, পরিবার, রাজনীতিসহ সব জায়গায় নারীর সম্মানজনক জায়গা নিশ্চিত করতে হবে।
আফজাল হোসেন
সারাদেশে অনেক খাসজমি দখল করে রেখেছে প্রভাবশালীরা। এ জমিগুলো উদ্ধার করলে ভূমিহীনরা জায়গা পাবে। এ ছাড়া কৃষিজমিগুলোতেও শিল্প-কারখানা তৈরি করা হচ্ছে। একইসঙ্গে এসব শিল্প-কারখানার মালিকরা কৃষকদের কৃষিতে নিরুৎসাহিত করে জমিগুলো লিজ নিচ্ছেন। উন্নয়ন হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তা কাজে আসছে না। শুধু খাসজমিই নয়, অন্যান্য জমি নিয়েও জালিয়াতি বাড়ছে। এ জন্য ভূমি আইন সংস্কার করা প্রয়োজন।
দীপু শামসুল ইসলাম
নারীরা কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত থাকলেও বিক্রির ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা কম। এটা বদলাতে হবে। তা না হলে নারীরা পিছিয়ে পড়বে। সে জন্য ভূমির ওপর নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ভূমিহীন হওয়া একটি চলমান প্রক্রিয়া। প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ ভূমিহীন হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে সরকারের স্মার্ট পরিকল্পনা ও বাজেট দিতে হবে।
জয়া ত্রিপুরা
বর্তমান বাস্তবতায় পাহাড়ের মানুষ পানি সংকটে ভুগছে। আগে পাহাড়ি নারীরা ঝর্ণা থেকে পানি সংগ্রহ করতে পারতেন। বর্তমানে পাহাড় কেটে রাস্তা নির্মাণ, নদী ভরাট ও নদীর পাশে কৃষিজমি ভরাটের কারণে আমরা পানি সংকটে ভুগছি।
নারীর অধিকারের কথা কাগজে-কলমে বলা আছে। তারা কতটুকু অধিকার পান, সেটাও দেখতে হবে। শুধু একটি জায়গায় বসিয়ে দিয়ে নারীর অধিকার দেওয়া হয়েছে– এটা বলা যাবে না। তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত নারীর অধিকার দিতে হবে। এ ছাড়া নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় পর্যাপ্ত পরিমাণে বিনিয়োগ করতে হবে। একইসঙ্গে বাবার সম্পত্তিতে নারীর অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
সাবিনা হেমব্রম
আমরা ভূমিহীন ছিলাম। স্থানীয় মিশন থেকে আমাদের থাকার ঘর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মিশনের জায়গায় থাকার কারণে আমরা সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাই না। আমরা আদিবাসীরা অন্যদের মতো সমান সুযোগ-সুবিধা পাই না। পরিষেবা ও ভাতা সঠিকভাবে পাই না। আমরা বৈষম্যহীনভাবে বাঁচতে চাই। শুধু ভোটের সময়ই আমাদের গুরুত্ব বাড়ে।
শরীফা আক্তার নিপা
চাটমোহর উপজেলায় প্রায় তিন হাজার বিঘা খাসজমি ছিল। তখন আমি খাসজমি পেয়েছি। আমি কৃষিকাজ করি। আমার মতো বহু নারী কৃষি কাজ করেন। আমরা কৃষিজমিতে শ্রম দিই। কিন্তু আমাদের কৃষানি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। আমাদের কৃষি কার্ড দেওয়া হয় না। যাদের ১০ বিঘা জমি আছে, তাদের কার্ড দেওয়া হয়। তারা বীজ, সার, ওষুধ সব পান। কিন্তু তারা নিজেরা জমিতে খাটেন না। আমাদের মতো মানুষদেরই খাটান তারা। আমাদের অনেক উন্নয়ন হয়েছে ঠিকই। কিন্তু সব সুবিধা পুরুষরাই বেশি পান আর নারীরা কম পান। তাই কৃষিতে নারীর সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
মনীরা বেগম
খাসজমিগুলো প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে। এটাই আসলে বাস্তবতা। ভূমিহীনরা খাসজমি পাচ্ছে না। তারা কষ্টে দিনযাপন করছে। খাসজমি দেওয়ার সময় সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করতে হবে। বাড়ি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষিজমিও দিতে হবে। কারণ কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি না হলে বাড়ি দিলেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নাও হতে পারে।
কৃষ্ণপদ মুণ্ডা
পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীর অধিকার নিশ্চিত করা চ্যালেঞ্জ। সুন্দরবন এলাকার নারীরা নানাভাবে বঞ্চনার শিকার হন। পুরুষরা সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের পেটে গেলে নারীকে অপয়া বলে দোষারোপ করা হয়। সুন্দরবন অঞ্চলে কাজ কমে যাওয়ায় পুরুষরা এলাকা ছেড়ে অন্য জায়গায় যান কাজের খোঁজে। নিরাপত্তাহীনতার কারণে মেয়েদেরও কম বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া নারীর মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা-ভাবনার কারণে নারীরা পিছিয়ে যাচ্ছেন। নারীর অধিকার আদায়ে কথা বলতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন করতে হবে। এর শুরু হতে হবে পরিবার থেকে।
সপ্তমী রানী
নারী জন্মলগ্ন থেকেই নির্যাতিত। যদি ছেলেশিশু জন্মায়, তাহলে সবাই খুশি হয়। মেয়ে হলে খুশি হয় না। শিক্ষা আর সম্পত্তির ক্ষেত্রেও নারীরা বঞ্চিত। বিশেষ করে হিন্দু সমাজে নারীরা বাবা ও স্বামীর সম্পত্তিতে অধিকার পান না। নারীকে নিজেদের অধিকার নিজেদেরই আদায় করতে হবে।
আক্তার নূর
পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলা ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করা হলেও, সেখানে অনেক ভূমিহীন রয়েছে। বিশেষ করে নারীরা ভূমির ক্ষেত্রে বঞ্চিত। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের অনুরোধ, নারীর ভূমি পাওয়ার ক্ষেত্রে যে কঠিন শর্ত রয়েছে, তা দূর করুন। শর্তের বেড়াজালে আটকে নারীরা ভূমি পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
সুপারিশসমূহ
‘গ্রামে ভূমিহীন মানুষ আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে’– এই কঠিন বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে নীতিনির্ধারণ, উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়ন-বাস্তবায়ন করা।
ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে সঠিক যাচাই-বাছাইয়ের ভিত্তিতে প্রকৃত ভূমিহীনদের একটি তথ্যভান্ডার তৈরি করা। তালিকা অনুযায়ী অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভূমিহীনদের ঘর ও খাসজমি প্রদান করা। এ ক্ষেত্রে নারীপ্রধান ভূমিহীন খানাগুলো এবং সমতলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন।
খাসজমি-জলার স্থায়ী বরাদ্দ ও একসনা বন্দোবস্ত দ্রুত চালু করা।
খাসজমি বন্দোবস্ত প্রদান নীতিমালার অগ্রাধিকার তালিকায় উল্লিখিত নারীপ্রধান পরিবারের ক্ষেত্রে সক্ষম পুত্রসন্তান থাকার শর্ত/বিধান অবিলম্বে বাতিল করা।
অবৈধ দখলমুক্ত করে খাসজমি প্রকৃত ভূমিহীনদের মধ্যে বণ্টন করা।
খাসজমি-জলা চিহ্নিত করে মৌজা অনুযায়ী তালিকা তৈরি করাসহ দিয়ারা জরিপ করে দ্রুত খাসজমি চিহ্নিত ও ভূমি অফিসে প্রকাশ্য স্থানে তা প্রদর্শন করা।
যেসব দরিদ্র ভূমিহীন গৃহহীন এখনও আশ্রয়ণের ঘর বরাদ্দ পাননি, তাদের জন্য ঘর বরাদ্দের ব্যবস্থা করা।
প্রতি পরিবারের জন্য ঘর ছাড়াও কমপক্ষে পাঁচ শতাংশ জমি বরাদ্দ দেওয়া। এ ছাড়া ঘরের মান নিশ্চিত করার জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়াসহ মানসম্পন্ন ঘর নির্মাণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
নদী-খাল-জলা ভরাট করে জমিকে খাস দেখিয়ে তাতে আশ্রয়ণ প্রকল্প করা পরিবেশ সুরক্ষার স্বার্থে বন্ধ করা।
প্রধান অতিথি
রাশেদ খান মেনন, এমপি
সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও সভাপতি
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি
সভাপতি
ফওজিয়া মোসলেম
সভাপতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন
গাজী মোহাম্মদ সোহরাওয়ার্দী
উন্নয়ন গবেষক ও সমন্বয়ক
সেন্টার ফর নলেজ (সিএফকে)
প্যানেল আলোচক
অধ্যাপক ড. সীমা জামান
ডিন, আইন অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সঞ্জীব দ্রং
সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম
শামসুল হুদা
নির্বাহী পরিচালক
অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি)
তৃণমূল আলোচনা
আফজাল হোসেন
নির্বাহী পরিচালক, রুলফাও, রাজশাহী
দীপু শামসুল ইসলাম
নির্বাহী পরিচালক, স্পিড ট্রাস্ট, বরিশাল
জয়া ত্রিপুরা
হেডম্যান, সিএইচটি হেডম্যান নেটওয়ার্ক
সাবিনা হেমব্রম
আদিবাসী নারীনেত্রী, দিনাজপুর
শরীফা আক্তার নিপা
নারী কৃষক, চাটমোহর, পাবনা
মনীরা বেগম
নারী কৃষক, নর্থ চ্যানেল ইউনিয়ন, ফরিদপুর সদর
কৃষ্ণপদ মুণ্ডা
নির্বাহী পরিচালক, সামস, সাতক্ষীরা
সপ্তমী রানী
জনসমবায় নেত্রী, মেহেরপুর
আক্তার নূর
যুবনেত্রী, বাউফল উপজেলা, পটুয়াখালী
অনুলিখন
মাজহারুল ইসলাম রবিন
নিজস্ব প্রতিবেদক, সমকাল
সমন্বয়
হাসান জাকির
হেড অব ইভেন্টস, সমকাল
রফিকুল ইসলাম
কর্মসূচি কর্মকর্তা, এএলআরডি
সোহেল রানা
কর্মসূচি কর্মকর্তা, এএলআরডি