ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

পুষ্টি সুশাসন নিশ্চিতে ইউনিয়ন সমন্বয় কমিটির ক্ষমতায়ন দরকার

পুষ্টি সুশাসন নিশ্চিতে ইউনিয়ন সমন্বয়  কমিটির ক্ষমতায়ন দরকার

- ছবি : সাজ্জাদ হোসেন নয়ন

সমকাল ডেস্ক

প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৪ | ২৩:৫২ | আপডেট: ২৬ মে ২০২৪ | ০০:০২

যে দেশ পুষ্টি নিশ্চিতকরণে ভালো অবস্থানে রয়েছে, স্বাভাবিকভাবেই মানব উন্নয়নের সব সূচকে সেই দেশ এগিয়ে যায়। ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সেই দেশ উন্নত হতে থাকে। কারণ পুষ্টির সঙ্গে যেমন স্বাস্থ্যের সম্পর্ক রয়েছে, তেমনি এর সঙ্গে উন্নয়নেরও সম্পর্ক রয়েছে। পুষ্টি নিশ্চিতকরণে অগ্রগতি থাকলেও আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে। এর অংশ হিসেবে পুষ্টির সুশাসনের বিষয়টি নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পুষ্টির চাহিদা মেটাতে ইউনিয়ন উন্নয়ন সমন্বয় কমিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এ জন্য ইউনিয়ন উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি ক্ষমতায়ন প্রয়োজন।
গত ২৫ এপ্রিল রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সমকালের সভাকক্ষে আয়োজিত ‘পুষ্টি সুশাসন নিশ্চিতকরণে ইউনিয়ন উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির ভূমিকা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। জানো কনসোর্টিয়ামের (জয়েন্ট অ্যাকশন ফর নিউট্রিশন আউটকাম) আওতায় সমকাল ও কেয়ার এর আয়োজন করে।

ড. মো. মিজানুর রহমান
জানো প্রকল্প দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের রংপুর ও নীলফামারী জেলার মা এবং কিশোর-কিশোরীদের সঠিক পুষ্টি নিশ্চিতকরণে কাজ করছে ২০১৮ সালের আগস্ট মাস থেকে। পুষ্টিসেবা নিশ্চিতের মাধ্যমে নারী এবং কিশোরীদের ক্ষমতায়নে কাজ করছে এই প্রকল্প। একই সঙ্গে এই সেবা প্রাপ্তিতে তাদের সহযোগিতা করেছে। সরকারের পুষ্টি-সংক্রান্ত আঞ্চলিক, জেলা-উপজেলা এবং স্থানীয় পর্যায়ের অবকাঠামোগুলোকে আরও শক্তিশালী করার মাধ্যমে দরিদ্ররা যেন পুষ্টি সেবা পায়, তা নিশ্চিত করেছে। পাশাপাশি উচ্চমানের পুষ্টি উৎপাদন যেন বৃদ্ধি পায়, তা নিয়েও কাজ করেছে। এ ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যবহার করে কীভাবে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরগুলোকে সংযুক্ত করে পুষ্টি-সংক্রান্ত তথ্য প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছানো যায়, তা নিয়েও প্রকল্পটি কাজ করেছে । গত পাঁচ বছরে প্রকল্পের সহযোগিতায় সরাসরি প্রায় ১৪ লাখ মানুষের কাছে স্বাস্থ্য, পুষ্টি, জলবায়ুসহিষ্ণু কৃষি, পুষ্টির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বার্তা পৌঁছাতে পেরেছে। সরকারের পুষ্টি অবকাঠামো, স্থানীয় পর্যায়ে সরকারি ও বেসরকারি যেসব সংস্থা কাজ করছে, তাদের সহযোগিতায় এটি সম্ভব হয়েছে। গত পাঁচ বছরে সরকারের অবকাঠামোর মধ্যে জেলা, উপজেলা পুষ্টি সমন্বয় কমিটি এবং ইউনিয়ন উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির বটমআপ বার্ষিক পুষ্টি কর্মপরিকল্পনা তৈরি এবং বাস্তবায়নে সরকারকে সহযোগিতা করেছে। ফলে দেখা গেছে, এই অবকাঠামোগুলো তাদের পুষ্টি বিষয়ে চিন্তা-চেতনায় একটা ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। নির্দিষ্ট করে ইউনিয়ন পরিষদগুলো তাদের চিন্তা-চেতনায় পুষ্টির বিষয়টি নিয়ে এসেছে। তাদের বার্ষিক পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নে পুষ্টি খাতে তারা প্রায়  ৫২ শতাংশ বরাদ্দ বৃদ্ধি করেছে। এটি সম্ভব হয়েছে ইউনিয়ন সমন্বয় কমিটি সক্রিয় থাকার কারণে। যে কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে ইউনিয়ন পরিষদকে গুরুত্ব দিতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদ ছাড়া ভালো ফলাফল পাওয়া সম্ভব না। মানুষের চাহিদাভিত্তিক পরিকল্পনা করতে ইউনিয়ন পরিষদকে ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত করা প্রয়োজন। এ অবকাঠামোর স্বীকৃতিও প্রয়োজন। এ কমিটি সরকারের একটি কাঠামো। পুষ্টিও যে এ কাঠামোর একটি অংশ, তা নিয়ে আলোচনা হয় না। এ বিষয়ে আমাদের ভাবার সুযোগ ও সময় এসেছে। প্রকল্পটি দেশের ৬৪টি ইউনিয়নে কাজ করেছে । দেশের ৪ হাজার ৫৭১টি ইউনিয়নেও এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায়, তা ভাবার সময় এসেছে। পুষ্টির সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে ইউনিয়ন উন্নয়ন সমন্বয় কমিটিকে জাতীয় পুষ্টি পরিষদের একটি অবকাঠামো হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

ডা. মোহাম্মাদ মাহবুবুর রহমান
মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে এমনিতেই পুষ্টি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। গোলটেবিল বৈঠকে সুন্দর সুন্দর পরামর্শ উঠে এসেছে। বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদ কার্যালয় মানুষের পুষ্টি নিশ্চিতে একটি লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে। পুষ্টিনীতি বাস্তবায়নে ইউনিয়ন পর্যায়েও কমিটি রয়েছে। এ কমিটির সভাপতি স্থানীয় চেয়ারম্যান। যেখানে যেভাবেই আলোচনা হোক না কেন, মাঠ পর্যায়ে কাজটি করতে হয় কমিউনিটি ক্লিনিকের। পুষ্টি কার্যক্রম আরও গতিশীল করতে জাতীয় পুষ্টিনীতি তৈরি করে তা যথাযথ বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে। সব মানুষের পুষ্টি নিশ্চিতে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের কাজ করতে হবে।

 

ডা. ইখতিয়ার উদ্দিন খন্দকার
পুষ্টির সার্বিক বিষয় নিয়ে আমাদের ভাবনার জায়গা রয়েছে, করণীয় রয়েছে। আমরা অনেক দূর এগোলেও পুষ্টি নিশ্চিতকরণে আমাদের আরও অনেকদূর যেতে হবে। এর অংশ হিসেবে পুষ্টির সুশাসনের বিষয়টা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য জাতীয় পর্যায়ে যেসব পরিকল্পনা রয়েছে, তার সঙ্গে ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউনিয়ন সমন্বয় কমিটির ভূমিকা রয়েছে। এই কমিটিকে কাজে লাগানো গেলে পুষ্টি নিশ্চিত করা সম্ভব।
জানো কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে রংপুর ও নীলফামারী জেলার সাতটি উপজেলার ৬৪টি ইউনিয়নে আমাদের দেখার সুযোগ হয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে উন্নয়ন সমন্বয় কমিটিগুলোকে সক্রিয় করে মানুষের মধ্যে সচেতনতা নিশ্চিত করা গেলে পুষ্টির সার্বিক পরিস্থিতি উন্নয়ন করা সম্ভব। এই প্রকল্পের যাবতীয় বিষয় পর্যবেক্ষণ ও ইতিবাচক পরিবর্তন প্রমাণ করে, পুষ্টি উন্নয়নে ইউনিয়ন উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কমিউনিটিভিত্তিক পুষ্টি উন্নয়নের বিষয়টি নীতিমালায় রূপান্তরের একটা জায়গা রয়েছে। নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হলে যে বিষয়টি প্রথমে দরকার, সেটি হলো প্রমাণ। প্রমাণ ছাড়া রাতারাতি নীতিমালা পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। পুষ্টি উন্নয়নে ইউনিয়ন সমন্বয় কমিটির ইতিবাচক ভূমিকা প্রমাণিত। এখন জাতীয় পুষ্টি পরিকল্পনায় এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে আমাদের কাজ করতে হবে। ইউনিয়ন পর্যায়ে মাল্টিসেক্টরাল কনসেপ্ট নিয়ে ভালোভাবে কাজ করলে পুষ্টির উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। এতে পুষ্টি উন্নয়নে আমরা ভূমিকা রাখতে পারব। 

ডা. মহসিন আলী
আমরা একসময় জানতাম, খাদ্যের ব্যবস্থা হলেই পুষ্টির ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু দেখলাম, হয় না। এর সঙ্গে স্বাস্থ্য, রোগব্যাধি, শিক্ষার হার, পরিবেশগত পরিচ্ছন্নতা জড়িত। এগুলোতে উন্নতি করতে হবে। সব কর্মসূচি একবার উন্নতি না করলে পুষ্টির উন্নতি করা সম্ভব নয়। উন্নয়নের সঙ্গে পুষ্টির সম্পর্ক রয়েছে। দেশের মানুষ অর্থনীতিতে তখনই অবদান রাখতে পারেন, যখন তিনি শারীরিকভাবে সুস্থ হন। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য উন্নয়ন হলেই পুষ্টির উন্নয়ন সম্ভব। পুষ্টি  স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং মানবিক উন্নয়নকে প্রভাবিত করে। আরও একটা বিষয় পুষ্টির সঙ্গে জড়িত। তা হলো দেশের সুশাসন। জানো কনসোর্টিয়ামের পুষ্টি উন্নয়নে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়নে ৩০ ধরনের কাজকে এটিতে যুক্ত করা হয়েছে। এগুলো বিভিন্ন বিভাগের। এগুলো বাস্তবায়ন করতে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করা জরুরি।


ফিরোজ আল মাহমুদ
বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিশেষ করে চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। এখন আমরা দৃষ্টি দিয়েছি কীভাবে মানুষের পুষ্টির উন্নয়ন করা যায়। সংবিধানেও জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। পুষ্টি উন্নয়নে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর জোরালো ভূমিকা রয়েছে। সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারেও পুষ্টি উন্নয়নের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। যে কারণে খাদ্য, কৃষিসহ অন্য নীতিমালায়ও পুষ্টি উন্নয়নের বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। একটি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে সুস্থ-সবল জাতি দরকার। এ জন্য রাষ্ট্র পুষ্টি উন্নয়নের বিষয়ে ভাবছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। এ নির্দেশিকায় পুষ্টি বার্তা গুরুত্বসহকারে দেওয়া হয়েছে; যাতে করে মানুষ পুষ্টি উন্নয়ন সম্পর্কে সচেতন হয়ে তাদের পুষ্টির উন্নয়ন ঘটাতে পারে। এ ক্ষেত্রে জানো প্রকল্প মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে। ফলে যেখানে এই প্রকল্প চলছে, সেখানকার মানুষ তাদের পুষ্টি এবং সুস্বাস্থ্যের বিষয়ে সচেতন এবং সাবলীল।
পুষ্টি সুশাসন নিশ্চিতকরণে ইউনিয়ন উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। পুষ্টি নিশ্চিত করতে হলে পুষ্টিকর খাদ্যের চাহিদা ও জোগান থাকতে হবে। আমাদের পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদন করতে হবে। খাদ্য উৎপাদনের পর তা সংরক্ষণে যেন সমস্যা না ঘটে, সে বিষয়েও খেয়াল রাখতে হবে। পুষ্টির মান বজায় রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে ইউনিয়ন উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির ভূমিকা রয়েছে। এ জন্য কমিটির সক্ষমতা এবং অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে সরকারি ও বেসরকারি সেক্টরগুলোরও সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

ডা. এম ইসলাম বুলবুল
যেই দেশ পুষ্টি নিশ্চিতকরণে ভালো অবস্থানে রয়েছে, স্বাভাবিকভাবেই মানব উন্নয়নের সব সূচকে সেই দেশ এগিয়ে যায়। ফলে সেই দেশ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই উন্নত হতে থাকে। কারণ পুষ্টির সঙ্গে যেমন স্বাস্থ্যের সম্পর্ক রয়েছে, তেমনি এর সঙ্গে উন্নয়নেরও সম্পর্ক রয়েছে। এ বিষয়টি যদি মানুষকে বোঝানো যায়, বিশেষ করে ইউনিয়ন পর্যায়ে বোঝাতে হবে। যেসব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নারী, শিশু-কিশোরসহ জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেছেন, তারা মানুষের হৃদয়ে বেশি স্থান পেয়েছেন। এ বিষয়টি ছড়িয়ে দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 
পরিকল্পনা অনেক হতে পারে। কিন্তু তা বাস্তবায়নের জন্য বরাদ্দ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেই জায়গা থেকে একটা বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। এর অংশ হিসেবে আমাদের জনপ্রতিনিধিদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি খাতে কাজ করতে বিশেষ বরাদ্দের যেন সম্পূর্ণটা দেওয়া হয়। বিভিন্ন কমিউনিটিকে যুক্ত করে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানরা যদি কাজ করেন, তাহলে পুষ্টি খাতে আমরা আরও উন্নতি করতে পারব। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে আমাদের অনেক পদক্ষেপ রয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য মন্ত্রণালয়েরও পুষ্টি বিষয়ে যেসব পরিকল্পনা রয়েছে, তা যেন প্রান্তিক পর্যায়ে সমন্বিতরূপে থাকে। একই সঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের সক্ষমতা বাড়িয়ে চাহিদাভিত্তিক নতুন নতুন উদ্যোগ নেওয়া হলে আমরা পুষ্টি খাতে এগিয়ে যাব।
জাতীয় পরিকল্পনাগুলোতে ইউনিয়ন পরিষদকে যুক্ত করা না গেলে প্রান্তিক উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। ইউনিয়ন পরিষদকে সেভাবে নেতৃত্বের জায়গায় রাখা হয় না। এটা ভাবা হয় যে, ইউনিয়ন পরিষদ শুধু নির্দেশনা পালন করবে। এটা খুবই দুঃখজনক। ইউনিয়ন পরিষদের ‘সক্ষমতা বৃদ্ধি’– এই শব্দগুচ্ছের বিষয়ে আমার ঘোর আপত্তি রয়েছে। আমি মনে করি, ইউনিয়ন পরিষদের নেতৃত্বে এ দেশের উন্নয়ন করতে হবে। 

মনিরুজ্জামান বিপুল
ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে বিভিন্ন সংস্থার যেসব প্রকল্প রয়েছে, তার ফল মূল্যায়ন করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে যদি তারা মডেল হিসেবে মূলধারায় আনে, তাহলে পুষ্টি উন্নয়নে অনেক উন্নয়ন সাধন হবে। জেলা, উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ের পুষ্টি উন্নয়নে যে নির্দেশনা যায়, পার্বত্য পর্যায়ের ক্ষেত্রে তা একটু আলাদা রাখতে হবে। 

 

 


মার্গারিটা কাপালাবি
জাতীয় পুষ্টি নীতিমালায় ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম ও কর্মসূচি যুক্ত করতে হবে। বিশেষভাবে পুষ্টির কার্যক্রম শুরু করতে হবে শিশু যখন মায়ের গর্ভে থাকে তখন। আগামী জাতীয় নীতিমালায় সুনির্দিষ্ট পুষ্টি পরিকল্পনা করে এটি বাস্তবায়নে বেসরকারিভাবে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু উন্নয়ন সংস্থা দিয়ে জনপ্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

 

 

 

ড. মুহম্মদ শহীদ উজ জামান
জাতীয় পরিকল্পনাগুলোতে ইউনিয়ন পরিষদকে যুক্ত করা না গেলে প্রান্তিক উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। ইউনিয়ন পরিষদকে সেভাবে নেতৃত্বের জায়গায় রাখা হয় না। এটা ভাবা হয় যে, ইউনিয়ন পরিষদ শুধু নির্দেশনা পালন করবে। এ বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। ইউনিয়ন পরিষদের ‘সক্ষমতা বৃদ্ধি’– এই শব্দগুচ্ছের বিষয়ে আমার আপত্তি রয়েছে। আমি মনে করি, ইউনিয়ন পরিষদের নেতৃত্বে এদেশের উন্নয়ন করতে হবে। 

 


ডা. মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
এখানে উপস্থাপিত তথ্য দিয়ে আমরা দেখলাম গত এক যুগেও দেশে পুষ্টি পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। এই ইস্যু নিয়ে মাত্র কয়েকটি এনজিও কাজ করছে। সুতরাং এ জায়গাতে জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। নির্দিষ্ট এলাকা ছাড়া কোনো ক্ষেত্রেই উন্নতি হচ্ছে না। এনজিওর মাধ্যমে উদ্যোগ নিয়ে বেশ কিছু এলাকায় পুষ্টি কার্যক্রমে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। এ কার্যক্রম টেকসই বা ধরে রাখতে সংশ্লিষ্টদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এ সক্ষমতার জন্য বাজেট বাড়াতে হবে। এ বাজেট বাড়াতে হলে সরকারকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। তদারকিতেও আমাদের সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। আমাদের যারা প্রতিবেদন দিচ্ছেন, তারা সম্পূর্ণ প্রতিবেদন তৈরি করছেন না। এ জায়গাগুলোতেও অধিদপ্তর কাজ করছে। কমিউনিটি ক্লিনিকে আমরা কাজ করেছি। আমি দেখেছি, সেখানে সেবা তথ্য নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সেই তথ্য অধিকাংশ কমিউনিটি ক্লিনিক দেয় না। এখানেও গুরুত্ব দিতে হবে। এমন দৃশ্যপট উন্নয়নে জাতীয় পর্যায় থেকে একটি নির্দেশনা পাঠাতে হবে– কী কী তথ্য গ্রাম বা মাঠ পর্যায় থেকে নিতে হবে। তা ঠিকমতো নিচ্ছে কিনা– এ বিষয়ে তদারকি বাড়াতে হবে। এগুলো নিয়ে অনেক আগে থেকে বেসরকারি সংস্থা কাজ করছে। আরও কাজ বাড়াতে হবে। এককথায় সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। সমন্বয়ের মাধ্যমে মায়ের গর্ভকালীন থেকে পুষ্টির কাজ করতে হবে। মায়ের রক্তশূন্যতা দূর করতে কাজ করতে হবে।


ডা. শেখ সাহেদ রহমান
রাষ্ট্রের পুরোনো একটি কাঠামো হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ। ইউনিয়ন উন্নয়ন সমন্বয় কমিটিও পুরোনো কাঠামো। সংবিধানে তাদের কাজের স্বীকৃতি দেওয়া আছে। মাঠপর্যায়ে মানুষের পুষ্টি উন্নয়নে সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। কয়েক বছরের মধ্যে দেশ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের কাতারে যাচ্ছে। পুষ্টি নিয়ে টেকসই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে যে সক্ষমতা স্থানীয় সরকারের থাকা প্রয়োজন, আসলেই কি তাদের আছে। তাহলে স্থানীয় সরকারের সক্ষমতা বাড়াতে বাজেট রাখা হয়েছে কেন। এ ছাড়া স্থানীয় মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় জরুরি। যারা সমন্বয় করে কাজ করবে, তাদেরও একটি স্বীকৃতি দরকার। তা না হলে তারা কীসের ভিত্তিতে কাজ করবে। শুধু উন্নয়ন সংস্থা দিয়ে এ কাজ করা সম্ভব নয়। এ জন্য সরকারের একটি উদ্যোগ দরকার। আমরা যে চাহিদা তৈরি করছি, সেই চাহিদা বাস্তবায়নে আমাদের একটি মহাপরিকল্পনা জরুরি। গত বছর একটি গবেষণা হয়। সেখানে দেখা গেছে, জনশক্তির প্রশিক্ষণে অনেক গ্যাপ রয়েছে। 


ড. ফরায়েজী বিন্তি ফেরদৌস 
ইউনিয়ন উন্নয়ন সমন্বয় কমিটি শক্তিশালী করতে সমন্বয়ের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে আলোচনা হয়েছে। আমি দুটি বিষয় আলোচনা করতে চাই। উচ্চ-নিম্ন পর্যায়– সবখানে দুটি গ্যাপ রয়েছে। একটি হচ্ছে প্রশিক্ষণ এবং সক্ষমতা বাড়াতে ইউনিয়ন উন্নয়ন সমন্বয় কমিটি তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে জ্ঞান প্রদান করা। জরিপের তথ্যও বলছে এখানে অনেক গ্যাপ রয়েছে।
পুষ্টি উন্নয়নে যেসব জনশক্তি কাজ করছে, তাদের প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। রাজধানী থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত সবখানে এর অভার রয়েছে। সরকারি চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জায়গায় এই কর্মকর্তারা বদলি হয়ে চলে যাচ্ছেন। এই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কীভাবে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা যায়, এ বিষয়ে ভাবতে হবে। পুষ্টির সক্ষমতা বাড়াতে মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যাতায়াত সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের আইডিয়াগুলো নতুন নয়, তবে যখন পরিকল্পনা করব, তখন বাস্তবায়ন করতে জাতীয় পুষ্টি কর্মসূচিতে যুক্ত করতে হবে। আমরা এক সময় জানতাম খাদ্যের ব্যবস্থা হলেই পুষ্টির ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু দেখলাম হয় না। এর সঙ্গে স্বাস্থ্য রোগ ব্যাধি, শিক্ষার হার, পরিবেশগত পরিচ্ছন্নতা জড়িত। এগুলোর উন্নতি করতে হবে। সমাজে অর্থনীতির উন্নয়নে আগে ব্যক্তি উন্নতি, পরে তাঁর স্বাস্থ্যের উন্নতি জরুরি।

মো. মিজানুর রহমান
ইউনিয়ন উন্নয়ন সমন্বয় কমিটিকে পুষ্টি সুশাসন কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে ইউনিয়নের সংশ্লিষ্ট স্ট্যান্ডিং কমিটি, কমিউনিটি বেইজড অর্গানাইজেশন, প্রাইভেট সেক্টর এবং কমিউনিটি ক্লিনিকের অন্তর্ভুক্ত কমিউনিটি গ্রুপ ও কমিউনিটি সাপোর্ট গ্রুপের সঙ্গে সমন্বয়সাধন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য ইউনিয়ন উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সঙ্গে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের সমন্বয় কমিটির একটা মেলবন্ধন থাকা প্রয়োজন। 

 


শিশ রহমান
নীলফামারীতে পুষ্টি নিয়ে কাজ করার কারণে প্রায় তিন লাখ মানুষ পুষ্টি বিষয়ে সচেতন হয়েছে। পুষ্টি মানুষের জীবনে কতটুকু গুরুত্ব রাখতে পারে এবং একটি দেশের উন্নয়নে কাজ করতে পারে, এই বার্তা কেয়ার বাংলাদেশ ও জানো দিতে সক্ষম হয়েছে। দেশের পুষ্টি উন্নয়নে একটি প্ল্যাটফর্ম প্রয়োজন। যেখানে মাঠপর্যায় থেকে মন্ত্রী পর্যন্ত এই প্ল্যাটফর্ম প্রতিনিধিত্ব করবে। মাঠপর্যায়ের মানুষকে বাদ দিয়ে এসি রুমে পরিকল্পনা করে দেশের পুষ্টি উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে সরকারে ২২ মন্ত্রণালয়ের মতো ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়েও পুষ্টি নিয়ে কাজ করতে হবে। ২০২৩ সালে পুষ্টির একটি নীতিমালা তৈরি করা হয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, পুষ্টি হবে উন্নয়নের অভীষ্ট। সেই ক্ষেত্রে আমরা ২০৪১ সালকে টার্গেট করে এগিয়ে যাচ্ছি। পুষ্টির একটি বড় শত্রু তৈরি হয়েছে, তা হলো জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ুর কারণে আমাদের পুষ্টির ক্ষেত্রে অনেক কাজ ব্যাহত হচ্ছে। আমার মনে হয়, আপনারা এই বিষয়টি নজরে রাখবেন।

 

আমিনুল ইসলাম রিমন
ইউনিয়নের মানুষের পুষ্টি ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণে আমি জানো প্রকল্পের সঙ্গে ২০১৮ সাল থেকে কাজ করছি। ইউনিয়ন সমন্বয় কমিটি থেকে যে পরিকল্পনা করে, তা দুই মাস অন্তর আমরা পর্যালোচনা করি। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা অনেক কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়েছি। ফলে আমার ইউনিয়নের মানুষ কীভাবে স্বাস্থ্যসেবা পাবে, সেটি সম্পর্কে জানে। 

 

 

শেখ রোকন 
সমকালের সম্পাদকীয় নীতির একটি অংশ হলো জনগণের পুষ্টির বিষয়টি অগ্রাধিকার দেওয়া। কিন্তু দেখা যায়, জাতীয় পর্যায়ের সংবাদমাধ্যমে পুষ্টি নিয়ে আলোচনা খুব কম হয়। আসলে এ বিষয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। আমাদের দেশে পুষ্টির যে চিত্র, তার সঙ্গে পরিবেশের একটা সম্পর্ক রয়েছে। আমরা পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জলাভূমি হারিয়ে ফেলছি। রংপুর ও নীলফামারী অঞ্চলে শুধু তিস্তা নদী মরে গেছে, তা নয়। এ এলাকাগুলোতে আরও অনেক ছোট ছোট নদী মরে গেছে। এ নদীগুলো রক্ষা করা গেলে ইকোলজি রক্ষা হবে। একই সঙ্গে এ এলাকার মানুষও স্বাবলম্বী হবে। আমরা যদি ‘ইকোলজি, এডুকেশন ও এমপাওয়ারমেন্ট (ইইই)’ এ তিনটি বিষয় নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে পুষ্টির ক্ষেত্রে এক ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হতে পারে। অন্যদিকে, ইউনিয়ন পরিষদ শুধু একটি স্থানীয় সরকারই নয়। শত শত বছর ধরে এর বিবর্তন হয়েছে। মানুষের সবচেয়ে কাছে গিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ কাজ করে। ইউরোপের দেশগুলোতে দেখা যায়, স্থানীয় সরকার অনেক শক্তিশালী। আমাদের ক্ষেত্রেও এটি করা যেতে পারে।
 

মূল প্রবন্ধ 

ড. মো. মিজানুর রহমান
সিনিয়র টিম লিডার, জানো কনসোর্টিয়াম
কেয়ার বাংলাদেশ 

আলোচক

ডা. মোহাম্মাদ মাহবুবুর রহমান
মহাপরিচালক, বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদ কার্যালয় (বিএনএনসি) 

ডা. ইখতিয়ার উদ্দিন খন্দকার
ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর (ভারপ্রাপ্ত), কেয়ার বাংলাদেশ

ডা. মহসিন আলী
কনসালট্যান্ট 
বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদ কার্যালয়
 
ফিরোজ আল মাহমুদ
গবেষণা পরিচালক
খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিট (এফপিএমইউ) 

ডা. এম ইসলাম বুলবুল
প্রোগ্রাম ম্যানেজার, জাতীয় পুষ্টিসেবা

মনিরুজ্জামান বিপুল
পোর্টফোলীয় লিড, দ্য গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইমপ্রুভমেন্ট নিউট্রিশন (গেইন) 

মার্গারিটা কাপালাবি
প্রোগ্রাম ম্যানেজার– এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট, ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন সিকিউরিটি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশ ডেলিগেশন 

ড. মুহম্মদ শহীদ উজ জামান
নির্বাহী পরিচালক
ইকো-সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও) 

ডা. মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
উপপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

ডা. শেখ সাহেদ রহমান
কনসালট্যান্ট, সেক্রেটারি– সিএসএ ফর সান

ড. ফরায়েজী বিন্তি ফেরদৌস 
কনসালট্যান্ট, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি প্রোগ্রাম

মো. মিজানুর রহমান,
সিনিয়র ম্যানেজার
স্বাস্থ্য ও পুষ্টি প্রোগ্রাম, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ 

শিশ রহমান
সম্পাদক, দৈনিক নীলফামারী বার্তা
 
আমিনুল ইসলাম রিমন
চেয়ারম্যান, বরাগারি ইউনিয়ন পরিষদ
ডোমার, নীলফামারী

সঞ্চালনা 

শেখ রোকন
সহযোগী সম্পাদক, সমকাল

অনুলিখন

তবিবুর রহমান
নিজস্ব প্রতিবেদক, সমকাল

মাজহারুল ইসলাম রবিন
নিজস্ব প্রতিবেদক, সমকাল

সমন্বয়

হাসান জাকির
হেড অব ইভেন্টস, সমকাল

আরও পড়ুন

×