ফ্যাটি লিভার প্রতিরোধে সচেতনতা জরুরি

ছবি : মামুনুর রশিদ
সমকাল ডেস্ক
প্রকাশ: ২৫ জুন ২০২৪ | ২২:১৩ | আপডেট: ২৫ জুন ২০২৪ | ২২:২২
দেশের প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষ ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত। এ সমস্যা এখন নীরব মহামারি হিসেবে দেখা দিয়েছে। প্রযুক্তির প্রতি আসক্তি মানুষের জীবনযাপনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। পরিবর্তন আসছে খাদ্যাভ্যাসে; কায়িক পরিশ্রম কমছে। এতে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে ফ্যাটি লিভারসহ অসংক্রামক রোগ। এসব রোগ প্রতিরোধে প্রান্তিক পর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। এ জন্য সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
গ্লোবাল ফ্যাটি লিভার দিবস উদযাপন উপলক্ষে গত ১২ জুন বুধবার ‘এখনই পদক্ষেপ নিন, ফ্যাটি লিভার পরীক্ষা করান’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন বক্তারা। সমকাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হেপাটোলজি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন এ বৈঠকের আয়োজন করে। রাজধানীর তেজগাঁও শিল্প এলাকায় সমকাল কার্যালয়ের সভাকক্ষে এভারেস্ট ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের সহযোগিতায় এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
আবু সাঈদ খান
ফ্যাটি লিভার আসলে ঘাতক ব্যাধি। অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম না করা ব্যক্তিদের ফ্যাটি লিভার রোগ বেশি হয়। এ রোগ থেকে মুক্ত থাকতে হলে আমার যেটি মনে হয়, সতর্ক ও সচেতন হওয়া দরকার। প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ বেশি জরুরি। এ রোগ প্রতিরোধের জন্য জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। সবার জন্য সুষম খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে। এ ধরনের অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে স্বাস্থ্য বাজেট বাড়ানো জরুরি। একই সঙ্গে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন।
ডা. জামালউদ্দিন চৌধুরী
এ ধরনের অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে সরকারের বিনিয়োগ রয়েছে। ৫০ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে করোনা প্রতিরোধে টিকা কেনার জন্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মৌলিক গবেষণাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। ফ্যাটি লিভার নিয়ে চিকিৎসকদের মধ্যেও ধারণা অনেক কম। গত বছর একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার করেছিলাম। সেখানে দেশি-বিদেশি গবেষকরা এসে বিভিন্ন ধরনের বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। আমরাও চাচ্ছি, আমাদের দেশে মৌলিক গবেষণা হোক। প্রধানমন্ত্রী নিজেও চান, এমন গবেষণা দেশে হোক। এটি নিয়ে কীভাবে জাতীয় পর্যায়ে গবেষণা করা যায়, এ বিষয়ে আমি অবশ্যই আলোচনা করব। একই সঙ্গে জনসচেতনতা তৈরি জরুরি, যেটি নিয়ে আমরা কাজ করছি।
অধ্যাপক ডা. মুনিরুজ্জামান ভুইয়া
এখন শুধু শহরের মানুষ নয়, গ্রামের মানুষও ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত হচ্ছে। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের কারণে গ্রামের মানুষের মধ্যে ফ্যাটি লিভার দেখা দিচ্ছে। যারা মাছ, শাকসবজি খান না, বেশি করে ফাস্টফুড খান, তাদের ফ্যাটি লিভার বেশি হয়। এ রোগ প্রতিরোধে ও প্রচারে গুরুত্ব দিতে হবে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। এর পাশাপাশি গবেষণায় জোর দিতে হবে। গবেষণালব্ধ ফলাফল ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে। তাহলে জনগণ ফ্যাটি লিভারের সমস্যা সম্পর্কে জানবে এবং এ বিষয়ে আলোচনার সুযোগ পাবে।
অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন
বাংলাদেশে এমন অনেক মানুষ পাওয়া যাবে, যারা ফ্যাটি লিভারের বিষয়ে এখনও সচেতন নয়। অনেকেই এ শব্দটি শোনেনি। এ বিষয়ে অনেক কাজ করার সুযোগ রয়েছে। জাতীয় পর্যায়েও তেমন কাজ হয় কিনা আমার জানা নেই। ফ্যাটি লিভার এখন জনস্বাস্থ্যের জন্য অন্যতম সমস্যা। যে কোনো বয়সে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে। আমরা যখনই এ বিষয়ে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করি, তখন দেখি ৯০ শতাংশ মানুষ এ সমস্যায় আক্রান্ত। তবে এটি কী কারণে হচ্ছে– আজকের আলোচনায় এ বিষয়গুলো উঠে এসেছে। ওবিসিটির বিষয়ে কথা হয়েছে। তবে আলোচনা করা দরকার, যেমন কী খেলে ওজন নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব হবে। কী খাবার গ্রহণ করলে চর্বি ছাড়া শক্তি আসবে দেহে। ফ্যাটমুক্ত খাবার সহজলভ্য করতে হবে। এ ইস্যুগুলো নিয়ে আমাদের সচেতনতামূলক প্রচারাভিযান চালাতে হবে। কী খাওয়া উচিত, কী খাওয়া উচিত নয়– এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে হবে এবং জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। দুটি বিষয় নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এক, সুষম একটা খাদ্য তালিকা তৈরি করতে হবে। ফ্যাটি লিভারের বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। শহরকেন্দ্রিক জীবনে মানুষের হাঁটার জায়গা তৈরি করার দায়িত্ব সরকারের। শিশুদের খেলার মাঠ তৈরি করে দেওয়ার দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের। জায়গা যখন না থাকবে, সরকার কীভাবে এসব তৈরি করবে! স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হলে সম্মিলিতভাবে মন্ত্রণালয়গুলোকে কাজ করতে হবে। সব সেক্টর এগিয়ে এসে শহরকে মানুষের বসবাসের উপযোগী করতে হবে। এখানে জনসচেতন তৈরিতে গণমাধ্যমকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে।
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ
আগামী দিনে যারা বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে, সেই শিশুদেরও ফ্যাটি লিভার পাওয়া যাচ্ছে। এটা ভীষণ উদ্বেগজনক। আজ থেকে ৪০ বছর আগে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টিজনিত রোগ বেশি দেখা যেত। আর্থসামাজিক উন্নয়নের কারণে এ রোগগুলো অনেক অংশে কমে এসেছে। এখন দেশে ওবিসিটি বেশি দেখা দিচ্ছে। দেশে অধিকাংশ শিশু এখন মেদবহুল। ৯০ শতাংশ অভিভাবক তাদের সন্তানের ওবিসিটির বিষয়ে গুরুত্ব দেন না। অন্য সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে আসেন, কিন্তু বলেন না– আমার বাচ্চার ওবিসিটি প্রতিরোধে কী করব। এমনকি অভিভাবকদের এসব কথা বললে তারা মন খারাপ করেন। মূলত খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের কারণে এ সমস্যা দেখা যাচ্ছে। শিশুরা এখন ফাস্টফুড বেশি খায়। শাকসবজি দিয়ে ভাত কম খায়। এমনকি খেলা করার মতো কোনো পরিবেশ নেই। তারা মোবাইল-ইন্টারনেটে আসক্ত। এদের বেশি হচ্ছে ফ্যাটি লিভার। আমাদের উচিত শিশুকে খেলার সময় দেওয়া এবং স্থানীয় সরকারের উচিত খেলার মাঠ তৈরি করে দেওয়া। চিকিৎসকদের বোঝাতে হবে, জীবনযাত্রার মান ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন আমাদের অনেক রোগ কমিয়ে দেবে।
ডা. বায়েজিদ খুরশিদ রিয়াজ
সাধারণ মানুষের সঙ্গে লিভারের পরিচয়টা শৈশব থেকেই। মা-বাবা আমাদের ডাকেন কলিজার টুকরা বলে। এই কলিজা শব্দের ইংরেজি হলো লিভার। মানুষের সবচেয়ে বড় অঙ্গের নাম হলো লিভার। বিশেষ একটি সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, প্রতি পাঁচজনে একজন ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত। বিশ্বব্যাপী ১১৫ মিলিয়ন মানুষ ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ২ শতাংশ মানুষ ফ্যাটি লিভারে ভুগছে। সংবাদপত্রের মাধ্যমে যেহেতু আমরা জনসচেতনতা তৈরি করতে চাই, তাই এ বিষয়ে একটু কথা বলা প্রয়োজন। এটি অসংক্রামক রোগ। সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী অসংক্রামক রোগ বেড়েছে। তবে কী কারণে এ অসংক্রামক রোগ বাড়ছে, এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরাও কিছু বলতে পারেননি। তবে কী কী করলে এ রোগে ঝুঁকি তৈরি হয়, এ বিষয়ে বলা হয়েছে। সার্বিকভাবে যদি আমরা অসংক্রামক রোগ মোকাবিলা করতে পারি, তবে ফ্যাটি লিভারের মতো অনেক রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব। এখন আলোচনা করা দরকার, অসংক্রামক রোগ বাড়ার জন্য কী কী জিনিস সবচেয়ে বেশি দায়ী। যেমন– কায়িক পরিশ্রম না করা, অনেক সময় ধরে বসে কাজ করা, ব্যায়াম না করা। তবে খেলার মাঠও আগের মতো নেই। সব খেলা চলে গেছে হাতে ছোট একটি ডিভাইসের মধ্যে। অস্বাস্থ্যকর খাবার। এখানেও ফ্যাটি লিভার থেকে শুরু করে সব রোগ বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। অনিয়মিত জীবনযাপন, ওবিসিটির কারণে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে। এসব কারণে শুধু ফ্যাটি লিভার নয়; অতিরিক্ত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা অসংক্রামক রোগ দেখা দেয়। এ বিষয়ে যদি আমরা সচেতন থাকতে পারি, তাহলে আমাদের দেশে ফ্যাটি লিভার থেকে শুরু করে অন্যান্য অসংক্রামক রোগ কমে আসবে। এসব রোগ নিয়ন্ত্রণে মানুষের মধ্যে দৃশ্যমান কুসংস্কার দূর করতে হবে। ভিন্ন ভিন্ন রোগ নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষে আলাদা আলাদা প্রোগ্রাম নেওয়া সম্ভব নয়। তবে সব অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম নেওয়া হয়েছে।
অধ্যাপক মো. ইজাজুল হক
দেশের প্রায় সব মেডিকেল কলেজে হেপাটোলজি বিভাগ রয়েছে। বেসরকারি মেডিকেল কলেজেও এ বিষয়ে পড়ানো হয়। ২০২১ সালের কারিকুলামে হেপাটোলজি নিয়ে আলাদা কোনো পাঠ নেই। মেডিসিন বিভাগের উদ্যোগে শিক্ষার্থীরা পাঁচ বছরের মধ্যে মাত্র ১০ ঘণ্টা এ বিষয়ে জানতে পারে। এ পাঠদানের মধ্যে ফ্যাটি লিভার বিষয়ে আলোচনা করা হয়। তাই ফ্যাটি লিভার প্রতিরোধে জোর দিতে হবে। আমাদের এক গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রামে ৩১ শতাংশ মানুষের মধ্যে ফ্যাটি লিভারের সমস্যা রয়েছে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ফ্যাটি লিভার একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। তাই মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যবইয়ে এ বিষয়ে আলোচনা করা জরুরি।
ড. এস এম আব্দুর রহমান
ফ্যাটি লিভারের সমস্যা উপেক্ষা করার বিষয় নয়। অনেক ক্ষেত্রে এটি বড় ক্ষতি হিসেবে দেখা দিতে পারে। এর চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। অনেক সময় লিভার প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়। তবে সেভাবে আমাদের দেশে সচেতনতা নেই। এ ছাড়া এ রোগ প্রতিরোধে তেমন কোনো ওষুধ এখনও তৈরি হয়নি। সারাবিশ্বে মাত্র দুটি ওষুধ দিয়ে এ রোগ প্রতিরোধে কাজ করা হচ্ছে। তাই ফ্যাটি লিভার প্রতিরোধে সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। আমার জানামতে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এমন কোনো কর্মসূচি নেই। চিকিৎসকরা বলছেন, জন্মগত ও জিনগত কারণেও এ রোগ হতে পারে। দেশে বর্তমানে কতজন এ রোগে আক্রান্ত, এ হিসাব সরকারের কাছে নেই। এর জন্য নতুন করে গবেষণা করা প্রয়োজন। এ কাজ সরকারের। এ রোগকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার একটি গবেষণা করতে পারে। নতুন নতুন গবেষণা করে এ রোগের জন্য নতুন ওষুধ আবিষ্কার করা জরুরি। সবচেয়ে বড় বিষয়, এ রোগ প্রতিরোধে গুরুত্ব দিতে হবে। এ জন্য খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপনে পরিবর্তন আনতে হবে। এ জন্য সচেতনতা বাড়াতে হবে। সম্মিলিতভাবে নানা উদ্যোগ নিতে হবে। যদি বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি ব্যাপকভাবে পালন করা হয়, তাহলে অবশ্যই মানুষ সচেতন হবে।
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল
ফ্যাটি লিভার সমস্যা নীরব মহামারি হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশেও এ রোগ নীরব ঘাতক। করোনা মহামারি নিয়ে আমরা অনেক ভয়ে ছিলাম; কিন্তু সেটি এসে আবার চলে গেছে। করোনার চেয়ে ফ্যাটি লিভার আরও বেশি ভয়াবহ। এ নিয়ে আমরা দুটি কারণে উদাসীন। করোনার ক্ষতি আমরা তৎক্ষণিকভাবে দেখেছিলাম। তবে ফ্যাটি লিভার দেহের ক্ষতি করে ধীরে ধীরে। এটি ধীরগতিতে আক্রমণ করায় মানুষ এ রোগের গুরুত্ব কম দিয়ে থাকে। এখনও হেপাটাইটিস-বি হচ্ছে লিভার সিরোসিসের প্রথম কারণ; দ্বিতীয় কারণ ফ্যাটি লিভার। এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি জরুরি। শুধু গণমানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করলে হবে না, চিকিৎসকের মধ্যেও এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। কারণ, অধিকাংশ সময় এ রোগ শনাক্ত হচ্ছে চিকিৎসকের কাছ থেকে। হার্টে চর্বি জমলে আমরা অনেক চিন্তিত হয়ে পড়ি। কিন্তু লিভারে চর্বি জমলে আমরা এটিকে অবহেলা করি, গুরুত্ব কম দিই। এটি নিয়ে সার্বিক সচেতনতার জায়গা রয়েছে। ফ্যাটি লিভারের মতো অসংক্রামক রোগ বাড়ছে। এ জন্য হৃদরোগ, ক্যান্সার হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ছে। এ রোগ প্রতিরোধে জাতীয় কর্মসূচি গ্রহণ করা জরুরি। ভারতেও কিছু জাতীয় কর্মসূচির মধ্যে এ প্রোগ্রামকে যুক্ত করেছে।
ডা. মো. এম এ রহিম
ফ্যাটি লিভার বা লিভারে চর্বি জমা সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি। এ ফ্যাটি লিভারের সঙ্গে ‘ন্যাশ’-এর সম্পর্ক রয়েছে। লিভারের ৫ শতাংশের বেশি চর্বি জমলে একপর্যায়ে লিভারে প্রদাহ হয়, তখন তাকে ন্যাশ বলা হয়। ফ্যাটি লিভারে ৫ শতাংশের ওপর চর্বি জমলে লিভার সিরোসিসের সমস্যা দেখা দেয়। এ ক্ষেত্রে জটিল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। ফ্যাটি লিভার আমাদের লিভারকে পুরোপুরি অকেজো ও নষ্ট করে দিতে পারে। এ উদ্বেগজনক সমস্যার বিষয়ে মানুষ সচেতন নয়। এ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই।
ডা. মো. আশরাফুল আলম
একসময় হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি ভাইরাসকে মানুষ বেশি গুরুত্ব দিত। এখন ফ্যাটি লিভারের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি আমরা। বর্তমানে হাসপাতালে এ ধরনের সেবা নেওয়া ৯০ শতাংশ রোগীর মধ্যে ফ্যাটি লিভারের সমস্যা দেখা যাচ্ছে। ফ্যাটি লিভারের মাধ্যমে আমাদের হার্টে ও কিডনিতে চর্বি জমে। ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে সাধারণত আমরা মনে করতাম, এই রোগীদের হার্ট ও কিডনিতে সমস্যা থাকে। তবে ডায়াবেটিস রোগীদের ফ্যাটি লিভারও পাওয়া যাচ্ছে। আশার কথা হচ্ছে, এটি প্রতিরোধী রোগ। এ রোগ হয়ে যাওয়ার পরও প্রতিরোধের অনেক সুযোগ রয়েছে। রোগী ইচ্ছা করলে এটি প্রতিরোধ করতে পারবে। এ জন্য জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনতে হবে। আমাদের দেশের মানুষ এখন বেশি হাঁটতে চায় না। অল্প দূরত্বের পথও রিকশায় যেতে চায়। আমাদের হাঁটার ইচ্ছা নেই। প্রতিদিন নিয়ম করে হাঁটতে হবে। ভাত খাওয়ার অভ্যাসটা কমাতে হবে।
মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন
বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক মানুষ ফ্যাটি লিভার সম্পর্কে জানে না। অনেকেই শনাক্তের বাইরে। গবেষণায় কাজ করার সুবাদে হেপাটাইটিস-বি প্রতিরোধে ‘ন্যাসভ্যাক’ নামক একটি ওষুধের ট্রায়ালের সঙ্গে আমি যুক্ত ছিলাম। পরীক্ষামূলক প্রয়োগের পর ১০ বছর অতিবাহিত হয়েছে। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ফ্যাটি লিভার নিয়ে রোগীদের সচেতন করা জরুরি। রোগীর পরিবারকেও সচেতন করা জরুরি। অনেক সময় দেখি, সকালবেলা পরিবারের কর্তাব্যক্তিটি হাঁটতে বের হয়েছেন। হয়তো তিনি ফ্যাটি লিভার বা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তিনি সচেতন হয়ে হাঁটতে যাচ্ছেন, তবে বাসার অন্য সদস্যরা গভীর ঘুমে রয়েছেন। তারা রাতের বেলা হয়তো বার্গার বা পিৎজা খেয়েছেন। তার মানে রোগ হওয়ার পর আমরা ঠেকে শিখছি; দেখে শিখছি না। এই দেখে শেখার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যম বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। জাতীয় কর্মসূচি গ্রহণের আগে এ রোগে কতজন আক্রান্ত, তা বের করতে হবে। এ জন্য জাতীয় পর্যায়ে গবেষণা প্রয়োজন। ফ্যাটি লিভারের পরীক্ষার সুযোগ তৈরি করতে হবে। ফ্যাটি লিভার রোগ বিষয়ে জানতে পারলে আমরা অনেক মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারব।
মো. জাকির হোসেন
ফ্যাটি লিভার ধীরে ধীরে আক্রমণ করে। যখন অবস্থা বেশি জটিল হয়ে পড়ে, মানুষ তখন চিকিৎসকের কাছে যায় এবং তখন এটি ধরা পড়ে। এই সমস্যা দিনে দিনে বাড়ছে। ফ্যাটি লিভার প্রতিরোধের জন্য বাজারে দুটি ওষুধ রয়েছে। এভারেস্ট ফার্মাসহ দেশের পাঁচ থেকে ছয়টি কোম্পানি এ ওষুধ নিয়ে কাজ করছে। বাংলাদেশ ওষুধ উৎপাদনে মূলত মেধাস্বত্ব থেকে অব্যাহতি পেয়ে আসছে। ওষুধের ক্ষেত্রে স্বল্পোন্নত দেশগুলো এ সুবিধা ২০৩৩ সাল পর্যন্ত পাবে। কিন্তু ২০২৬ সালে বাংলাদেশ এলডিসির অন্তর্ভুক্ত হলে আমাদের সেই সুবিধা হারাতে হবে। এ সময়ে আমাদের নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। ফলে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সাশ্রয়ী দামের ওষুধের সহজলভ্যতা নিয়ে আমাদের এখনই কাজ করতে হবে।
গৌতম মণ্ডল
আজকের আলোচনায় যেসব বিষয় উঠে এসেছে এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, লিভারে ৫ শতাংশের বেশি চর্বি থাকলে আমরা এটাকে ফ্যাটি লিভার বলতে পারি। এটি আতঙ্কিত হওয়ার মতো বিষয়। গ্রামের মানুষের মধ্যেও ফ্যাটি লিভার দেখা দিচ্ছে। শিশুদের ফ্যাটি লিভার হচ্ছে। এ সমস্যা প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। প্রচারের জন্য মিডিয়াকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। জাতীয় পর্যায়ে এ সমস্যার বিষয়ে আলোচনা কম হচ্ছে। এ রোগ প্রতিরোধে সুষম খাবার গ্রহণ ও হাঁটার অভ্যাস করতে হবে। এ বিষয়ে কমিউনিটি পর্যায়েও আলোচনা হওয়া দরকার।
সভাপতি
আবু সাঈদ খান
উপদেষ্টা সম্পাদক, সমকাল
আলোচক
ডা. জামালউদ্দিন চৌধুরী
সভাপতি, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ
অধ্যাপক ডা. মুনিরুজ্জামান ভুইয়া
সভাপতি, বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল প্র্যাকটিশনার্স অ্যাসোসিয়েশন
অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন
সভাপতি
পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ সাবেক মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ
সভাপতি, বাংলাদেশ কলেজ অব
ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস
ডা. বায়েজিদ খুরশিদ রিয়াজ
অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন)
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর
অধ্যাপক মো. ইজাজুল হক
অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ
ড. এস এম আব্দুর রহমান
চেয়ারম্যান, ফার্মাসি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল
ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বিএসএমএমইউ
সভাপতি, বিএসএমএমইউ হেপাটোলজি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন
ডা. মো. এম এ রহিম
সহযোগী অধ্যাপক, লিভার বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
ডা. মো. আশরাফুল আলম
সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
লিভার বিভাগ, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর
মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
ক্লিনিক্যাল রিসার্চ অর্গানাইজেশন
মো. জাকির হোসেন
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এভারেস্ট ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড
সঞ্চালনা
গৌতম মণ্ডল
বার্তা সম্পাদক (অনলাইন), সমকাল
অনুলিখন
তবিবুর রহমান
নিজস্ব প্রতিবেদক, সমকাল
সমন্বয়
হাসান জাকির
হেড অব ইভেন্টস, সমকাল
- বিষয় :
- ফ্যাটি লিভার