ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

বেলুনকাণ্ডে বাড়ল চীন-আমেরিকা কূটনৈতিক উত্তেজনা

বেলুনকাণ্ডে বাড়ল চীন-আমেরিকা কূটনৈতিক উত্তেজনা

সমকাল ডেস্ক

প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ২৩:২৬

যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে চীনের যে বেলুনটি শনাক্ত হয়েছে, তা ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩৭ কিলোমিটার পর্যন্ত উঁচুতে উড়তে পারে। অত্যধিক উচ্চতায় নজরদারি করতে সক্ষম হলেও বেলুনটি বিশ্বের দুই পরাশক্তির অবনতিশীল সম্পর্ককে আবারও সর্বনিল্ফেম্ন নিয়ে গেছে।

ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার জন্য বেইজিংয়ের সাম্প্রতিক প্রচেষ্টায় কিছুটা অগ্রগতি দেখা যাচ্ছিল। তবে বেলুন শনাক্তের পর দুই দেশের দীর্ঘস্থায়ী অবিশ্বাস এবং ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার পারদ আবার ওপরে উঠল। গত নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় শীর্ষ সম্মেলনের পর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রস্তুতি চলছিল। এরই অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের আজ রোববার বেইজিং পৌঁছানোর কথা ছিল। প্রায় পাঁচ বছর পর মার্কিন কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চীন সফর হতো এটি। তার আগমুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্রের আধার মন্টানায় শনাক্ত হয় চীনা বেলুনটি। এরপরই সবকিছু উল্টে যায়। আকস্মিকভাবে সফর স্থগিতের ঘোষণা দেন শীর্ষ মার্কিন কূটনীতিক।

এ ঘটনা ক্রমবর্ধমান উত্তেজনাপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে আটকে থাকা দুটি শক্তির মধ্যে সম্পর্কের ভঙ্গুরতা আবারও প্রকাশ করেছে। দুটি দেশ সামরিক, ভূরাজনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত আধিপত্যের জন্য লড়াই করছে। বেলুনকাণ্ড যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিদলীয় ক্ষোভকে উসকে দিয়েছে। এটিকে গুলি করার আহ্বান জানানোসহ বাইডেন প্রশাসনের ওপর চাপ বাড়ছে। বিশ্নেষকরা বলছেন, চীন এ ঘটনায় নরম সুর ধরেছে।

নজিরবিহীনভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছে বেইজিং। তারা বেলুন ইস্যুতে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। শনিবার এক বিবৃতিতে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, বেইজিং কখনোই কোনো সার্বভৌম দেশের ভূখ ও আকাশসীমা লঙ্ঘন করেনি।

চীনের শীর্ষ পররাষ্ট্র কর্মকর্তা ওয়াং ই ফোনে ব্লিংকেনকে বলেছেন, সব স্তরে যোগাযোগের চ্যানেল বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত কিছু অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি শান্ত এবং নির্ভরযোগ্যভাবে মোকাবিলা করার জন। তবে বেইজিংয়ের অভিযোগ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু রাজনীতিবিদ এবং মিডিয়া এই ঘটনাটিকে চীনকে আক্রমণ ও বদনাম করার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছেন।

চীনের প্রতিক্রিয়া ছিল লক্ষ্যণীয়। অতীতের 'উলফ ওয়ারিয়র' বা নেকড়ে যোদ্ধা কূটনীতি বাদ দিয়ে চীন বেলুনের জন্য অনুশোচনা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার করেছে। চীন ব্লিংকেনের সফরকে এগিয়ে নেওয়ারও ইচ্ছা পোষণ করছে।

ব্লিংকেনের প্রথম চীন সফরে প্রেসিডেন্ট জিনপিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করার কথা ছিল। ব্লিংকেন শুক্রবার চীনের শীর্ষ পররাষ্ট্র কর্মকর্তা ওয়াং ইকে ফোন করে বলেছেন, বেলুনের কারণে তিনি তাঁর সফর স্থগিত করছেন।

ব্লিংকেন এবং মার্কিন উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়েন্ডি শেরম্যান বুধবার রাতে চীনা দূতাবাসের কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। বেইজিংয়ে আমেরিকার কূটনীতিকরা চীনা কর্মকর্তাদের কাছে কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন।

বিশ্নেষকরা মনে করছেন, চীন সরকারের প্রধান ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতি কৌশল সম্পর্কে বেইজিংয়ে সমন্বয়ের অভাব দেখা দিয়েছে।

ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো এবং চীনবিষয়ক জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সাবেক পরিচালক রায়ান হাস বলেছেন, চীনের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক বার্তাগুলোতে সামগ্রিক উত্তেজনা কমানোর চেষ্টা ছিল। তবে গুপ্তচর বেলুনের ঘটনাটি সামগ্রিক বার্তার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। এতে চীনের নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয়ের গুণমান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

বেলুনে নজরদারির ঘটনা এটাই প্রথম নয়। জাপানি সামরিক বাহিনী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রে বোমা হামলা করতে এটি ব্যবহার করেছিল। স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নও ব্যাপকভাবে নজরদারি বেলুন ব্যবহার করেছিল। অনেক উঁচুতে উড়ে নজরদারি করতে পারে- এমন বেলুন যুক্ত করার কথা বিবেচনা করছে যুক্তরাষ্ট্রও।

তবে পেন্টাগনের কর্মকর্তারা বলেছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অন্যান্য নজরদারি বেলুন যুক্তরাষ্ট্রে ঘোরাফেরা করলেও এটি আগেরগুলোর চেয়ে দীর্ঘ সময় অবস্থান করেছে। এতে জ্বালানি সরবরাহের জন্য সোলার প্যানেল রয়েছে। এটি ক্যামেরা এবং অন্যান্য নজরদারি সরঞ্জাম দিয়ে সজ্জিত। ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়তে পারে এটি।

মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, চীনা গুপ্তচর বেলুন অতীতে আমেরিকান আকাশসীমা অতিক্রম করেছে। তবে সেগুলোকে অশনাক্ত উড়ন্ত বস্তু (ইউএফও) হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেন- উভয় প্রশাসনই চীনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, চীনের কমিউনিস্ট পার্টি মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থা দুর্বল করার চেষ্টা করছে। বাইডেন চীনের প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে আটকানোর প্রচেষ্টাকে ব্যাপকভাবে প্রসারিত করেছেন। তিনি চীনের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাতের ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য তাইওয়ানসহ এশিয়াজুড়ে মিত্র ও অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করেছেন।

তাইওয়ানের সঙ্গে সম্ভাব্য যুদ্ধ নিয়ে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের মধ্যে চীনকে মোকাবিলা করার জন্য কয়েক দিনে মার্কিন সামরিক বাহিনী ফিলিপাইনে তার উপস্থিতি বিস্তৃত করছে।

এবার লাতিন আমেরিকায় বেলুন: যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে চীনা 'গোয়েন্দা' বেলুনের উপস্থিতি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যেই এবার মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন জানিয়েছে, শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, লাতিন আমেরিকার আকাশেও উড়ছে সন্দেহজনক চীনা গোয়েন্দা বেলুন।

পেন্টাগনের মুখপাত্র প্যাট রাইডার শুক্রবার সাংবাদিকদের বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের মতো লাতিন আমেরিকার আকাশেও সন্দেহজনক বেলুন উড়ছে বলে আমরা খবর পেয়েছি। আমরা ধারণা করছি, এটি আরেকটি চীনা গোয়েন্দা বেলুন।' তবে লাতিন আমেরিকার কোনো দেশের ওপর কিংবা কবে থেকে বেলুনটি উড়ছে, কবে সেটি শনাক্ত করা হয়েছে, সেসব বিষয়ে কিছুই জানায়নি পেন্টাগন। সূত্র : বিবিসি ও নিউইয়র্ক টাইমস

আরও পড়ুন

×