মালদ্বীপের কোলঘেঁষে নৌঘাঁটি খুলতে ভারত-চীনের আগ্রহ কেন?

ছবি: হিন্দুস্তান টাইমস
মো. মাহমুদুল হাসান
প্রকাশ: ০৪ মার্চ ২০২৪ | ১৮:৪৪ | আপডেট: ০৪ মার্চ ২০২৪ | ১৯:২৩
ভারতের নৌবাহিনী কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের কাছে নতুন ঘাঁটি খুলতে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চীনও এই দ্বীপরাষ্ট্রের কোলঘেঁষে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে যাচ্ছে। তাহলে চীন কি মালদ্বীপকে টার্গেট করছে নাকি ভারতকে বৃদ্ধাঙ্গলি দেখাতে এই পরিকল্পনা গ্রহণ করছে? আর কেনই বা মালদ্বীপকে ঘিরে ভারত-চীনের এত আগ্রহ?
‘সিন্ধুর টিপ সিংহল দ্বীপ’ শ্রীলঙ্কার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং ভারত মহাসাগরের একেবারে কেন্দ্রে থাকা এই মালদ্বীপে দুই বৃহৎ প্রতিবেশি ভারত ও চীনের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা দিন দিন কদর্য চেহারা নিচ্ছে। এই হস্তক্ষেপের অভিঘাতে দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও এক যুগের বেশি সময় ধরে টালমাটাল। ছোট্ট মালদ্বীপকে কেন যুক্তরাষ্ট্র ও এশিয়ার ‘জায়ান্ট’ দুই রাষ্ট্র এত গুরুত্ব দিচ্ছে, এর পরিণতি কী হবে, মালদ্বীপ তার সার্বভৌমত্ব বাঁচিয়ে রেখে চলতে পারবে কি না- এমন প্রশ্নও দেখা দিয়েছে।
গত শনিবার ভারতের নৌবাহিনী এক বিবৃতিতে বলেছে, কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের কাছে নতুন ঘাঁটি খুলা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে তারা মালদ্বীপের কাছাকাছি ‘কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ’ দ্বীপগুলোতে ভারতীয় বাহিনী শক্তিশালী করছে।
ঘাঁটিটি বানানো হবে মালদ্বীপের ১৩০ কিলোমিটার উত্তরে ভারতের লাক্ষ্যাদ্বীপে। আগামী বুধবার নতুন নৌ ঘাঁটি খোলা হবে। নতুন এই ঘাঁটি ওই এলাকায় ভারতের সক্রিয় নজরদারি জোরদার করবে বলে বিবৃতিতে জানানো হয়।
ভারতের লাক্ষ্মা দ্বীপ থেকে মালদ্বীপের দূরত্ব মাত্র ৭০ নটিক্যাল মাইল। আর ভারতের পশ্চিম উপকূল থেকে দূরত্ব ৩০০ নটিক্যাল মাইলের মতো। মালদ্বীপ শুরু থেকেই ভারতের প্রভাব বলয়ের অধীনে থাকা একটি দেশ। দেশ দুটির সম্পর্ককে এক হিসেবে ঐতিহাসিক বলা যায়। ১৯৬৫ সালে মালদ্বীপ ব্রিটিশদের কাছ থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার পর ভারত কেবল মালদ্বীপকে প্রথম স্বীকৃতিদাতা দেশই নয়, ভারত প্রথম দেশ, যারা রাজধানী মালেতে আবাসিক মিশন খুলেছিল। স্বাধীনতার প্রথম চার দশক মালদ্বীপের সঙ্গে বহির্বিশ্বের কূটনৈতিক সম্পর্কের কেন্দ্রে ছিল কেবল ভারতই। ২০০৪ সালেও বিশ্বব্যাপী তাদের কূটনৈতিক মিশন ছিল চারটি, যার একটি নয়াদিল্লিতে।
অপর দিকে মালদ্বীপের সঙ্গে চীনের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সূচনা ১৯৭২ সালে। তখন থেকেই চীন দেশটিতে বিনিয়োগ বাড়াতে থাকে। ১৯৮৫ সাল থেকে চীনা কোম্পানিগুলো মালদ্বীপে নানা ধরনের বিনিয়োগ উদ্যোগ গ্রহণ করে। যদিও মালেতে চীনা দূতাবাস স্থাপন করা হয়েছে মাত্র এক দশক আগে। চিন পিং ক্ষমতায় এসেই তার অতি উচ্চাভিলাষী বৈশ্বিক ট্রান্সপোর্ট করিডর ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই) প্রকল্প গ্রহণ করেন। পরের বছর চিন পিং মালদ্বীপ সফরে যান এবং শ্রীলঙ্কার পরে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় দেশ হিসেবে মালদ্বীপ বিআরআইতে যুক্ত হয়।
গত বছরের সেপ্টেম্বর মালদ্বীপে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভারতপন্থি মালডিভিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এমডিপি) নেতা ইব্রাহিম মোহামেদ সোলিহ্ এবং চীনপন্থি প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স কোয়ালিশনের নেতা মোহামেদ মুইজ্জু অংশগ্রহণ করেন। নির্বাচনে চীনপন্থি মোহাম্মদ মুইজ্জুর বিজয়ের পর ভারত-মালদ্বীপের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ে।
পরে মুইজ্জু মালদ্বীপে থাকা ভারতের ৮৯ সেনা সদস্যকে দেশে প্রত্যাহারের অনুরোধ করেন। জানানো হয়, ১০ মার্চ প্রথম দফায় এবং বাকি সৈন্যরা আগামী দুই মাসের মধ্যে মালদ্বীপ ছেড়ে যাবে।
এদিকে ভারত মহাসাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব পূর্ব-পশ্চিমের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক পথগুলোকে উপেক্ষা এ অঞ্চলে উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। এ অবস্থায় ভারতীয় নৌবাহিনী নতুন ঘাঁটি স্থাপনের ঘোষণা নতুন করে অস্থিরতা তৈরি করবে।
২০২৩ সালের ১৭ জুলাই রাশিয়ান সংবাদ সংস্থা তাসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল্লাহ শহীদ বলেছেন, সংবিধানের ২৫১ অনুচ্ছেদ অনুসারে, মালদ্বীপে বিদেশি কোনো সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করা যাবে না। এ বিষয়ে ১৯৯৮ সাল এবং ২০০৮ সালে সংবিধান সংশোধন করা হয়। তাই, আমাদের দেশে বিদেশের সেনা ঘাঁটি স্থাপন করা যাবে। এমন কোনো প্রস্তাব থাকতে পারে না।
তবে ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী মালদ্বীপে অ্যাটলগুলোর একটিতে ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। তখন একটি ঘাঁটি পরিচালনা করে রয়েল ব্রিটিশ বিমান বাহিনী।
বিদেশী সৈন্যদের উপস্থিতি নিয়ে ২০২৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মালদ্বীপের জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী (এমএনডিএফ) প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবদুল্লাহ শামাল রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ভারতীয় সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি এবং তাদের কর্মকাণ্ড দেশটির স্বাধীনতার জন্য হুমকি।
এমএনডিএফ প্রধান বলেন, এমন কোনো স্থান-সামরিক স্থাপনা নেই, যেখানে মালদ্বীপ সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নেই। নিয়মিতভাবে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রশিক্ষণ নেয় এমএনডিএফ। তবে এসব মন্তব্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডে ইব্রাহিম মোহাম্মদ সোলিহের পরাজয়ের পর বিরোধীদের অভিযোগের সঙ্গে মিলে যায়।
২০১৮ সালে জুন চীনের কৌশলগত সম্পদের সম্ভাব্য সম্প্রসারণে উদ্বেগ দূর করে মালদ্বীপের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুল্লাহ ইয়ামিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আশ্বস্ত করেন, তার দেশ কোনো বিদেশি শক্তিকে নতুন আইনের অধীনে একটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি দেবে না।
ইউরোএশিয়ান টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত মহাসাগরে মালদ্বীপের কাছে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করবে চীন। এ অঞ্চলে ভারতের চিরশত্রু চীনের সামরিক ঘাঁটি ‘মুক্তার স্ট্রিং’ ভারতের উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
ইউরএশিয়ান টাইমসের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, সামরিক বিশ্লেষক এবং ভূ-রাজনৈতিক ভাষ্যকার নীতিন জে টিকু বলেন, মালদ্বীপসহ ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের (আইওআর) দেশগুলো কৌশলগত গুরুত্ব এবং প্রভাব বলয়ের একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করে নয়াদিল্লি। মালদ্বীপ থেকে ভারতের সামরিক ঘাটি প্রত্যাহার করা এবং দেশটির কাছে চীনের ঘাঁটি স্থাপনের পরিকল্পনা এ অঞ্চলের পরিবশেকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক লেফটেন্যান্ট জেনারেল পি.সি. কাটচ চায়না ডেইলিকে বলেন, চীন ভারত মহাসাগর অঞ্চলে (আইওআর) ১৮টি ‘কৌশলগত সহায়তা ঘাঁটি’ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে। এর মধ্যে রয়েছে- হাম্বানটোটা (শ্রীলঙ্কা), পাকিস্তান ও মায়ানমার, ওয়ালভিস বে (নামিবিয়া), জিবুতি, ইয়েমেন, ওমান, কেনিয়া, তানজানিয়া, মোজাম্বিক, সেশেলস ও মাদাগাস্কার।
মালদ্বীপ হচ্ছে দ্বীপের মালা। ভারত মহাসাগরে নীল জলরাশির ১ হাজার ২০০টির মতো ছোট–বড় দ্বীপ আর অ্যাটল নিয়ে গঠিত দেশটি। অপরূপ সৌন্দর্যের সমুদ্রসৈকত আর বিলাসবহুল রিসোর্টের জন্য দেশটি সুপরিচিত।
ভারত মহাসাগরে মালদ্বীপ তার অনিন্দ্যসুন্দর সৈকত, কোরাল রিফ আর সামুদ্রিক প্রাণিবৈচিত্র্যে ভরপুর ছোট দ্বীপগুলো বিশ্বের ধনী ও খ্যাতনামা ব্যক্তিদের অবকাশযাপনের ঠিকানা। ভূরাজনীতির প্রতিদ্বন্দ্বিতার ছায়া শান্ত দেশটিকে অশান্তিতে ফেলতে পারে।
সূত্র: ইউরোএশিয়ান টাইমস, ইকোনোমিক টাইমস, ইন্ডিয়া টুডে, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস