বিশেষজ্ঞদের নানা বার্তা

.
সমকাল ডেস্ক
প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৫ | ০১:১৯
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ বিশ্বকে নতুন বাস্তবতার পথ দেখাচ্ছে। দু’পক্ষের অনড় অবস্থানে পাল্টাপাল্টি হামলা অব্যাহত রয়েছে। এই অবস্থায় যুদ্ধ পরিস্থিতি এক নতুন স্বাভাবিক রূপ পাচ্ছে। পরিস্থিতির বাস্তবতায় ইরান আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ। দেশটির জনগণ আগুনের মুখে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। যেসব নাগরিক একসময় নিজ দেশের সরকারের নীতির সমালোচনা করেছিল, তারাও এখন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলার পক্ষে সোচ্চার। অন্যদিকে শান্তির পক্ষে কথা বললেও ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন ইউরোপীয় নেতারা। তারা মুখে শান্তির কথা বলেন, অথচ ইসরায়েলের অবৈধ হামলার শিকার ইরানকে তারা ক্ষতিগ্রস্ত দেখতে চান। চীন ইসরায়েলের আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়েছে, যা ইরানের ন্যায্যতাকে সমর্থন দেয়।
আরও ঐক্যবদ্ধ ইরান
দ্য ক্রেডল জানায়, গত ১৩ জুন ইসরায়েল সামরিক, পারমাণবিক ও বেসামরিক অবকাঠামো লক্ষ্য করে বিমান হামলা করে। এই হামলার নাম ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’। এই হামলাকে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ১৯৮১ সালে ইরাকের ওসিরাক চুল্লিতে বোমা হামলার সঙ্গে তুলনা করেছেন। তারা মূলত ইরানের শিরশ্ছেদ করতে চেয়েছিল। কিন্তু ইসরায়েলের আগুনের মুখে ছত্রভঙ্গ না হয়ে দেশটির নাগরিকরা এখন আরও ঐক্যবদ্ধ। তারা প্রতিনিয়ত ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নামছে। গ্লোবাল সাউথজুড়ে এখন ইরানের প্রতি সহানুভূতিশীল।
পশ্চিমা বর্ণনার বিপরীতে ইরানের সামরিক বাহিনী বলছে, শীর্ষ কমান্ডার ও পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা করে ইসরায়েল ইরানের কৌশলগত অবস্থানকে খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারেনি। বরং নতুন বিজ্ঞানী ও কমান্ডাররা সক্রিয় হয়েছেন। ১৩ জুন থেকে দেশটির ভিন্নমতাবলম্বীরাও এখন সরকারের পক্ষে কথা বলছেন।
প্রাক্তন রাজনৈতিক বন্দি আলী ঘোলিজাদেহ বলেন, সরকারের প্রতি আমার সব সমালোচনা সত্ত্বেও আমি স্বদেশ রক্ষায় ইরানি প্রতিরক্ষা বাহিনীকে পুরোপুরি সমর্থন করি।
হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে বিপর্যয়
বিবিসি জানায়, ইরান মার্কিন হামলার প্রতিশোধ নিতে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ততম তেল পরিবহন চ্যানেল হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিতে পারে। এই নৌপথ দিয়ে তেল ও গ্যাসের ২০ শতাংশ রপ্তানি হয়। প্রণালিটি বন্ধ হলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যাপক হারে ব্যাহত হবে এবং জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাবে।
বিশ্বের বৃহত্তম অপরিশোধিত তেল ট্যাঙ্কার পরিবহনের জন্য এই প্রণালি যথেষ্ট গভীর এবং মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান তেল ও গ্যাস উৎপাদনকারী ও তাদের গ্রাহকরা এটি ব্যবহার করে।
যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থা এম১৬-এর সাবেক প্রধান স্যার অ্যালেক্স ইয়ঙ্গার বলছেন, প্রণালি বন্ধ করলে স্পষ্টতই বিরাট অর্থনৈতিক সমস্যা হবে। যার সরাসরি প্রভাব পড়বে বিশ্ববাজারে। শুধু সৌদি আরব প্রতিদিন প্রায় ছয় মিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল রপ্তানি করে এই প্রণালি দিয়ে। ইরান নিজেই প্রতিদিন প্রায় ১.৭ মিলিয়ন ব্যারেল তেল রপ্তানি করে। দেশটি ২০২৫ সালের মার্চ মাসে শেষ হওয়া অর্থবছরে ৬৭ বিলিয়ন ডলার মূল্যের তেল রপ্তানি করেছে। এই তেলের ৯০ শতাংশই নেয় চীন।
জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী, একটি দেশ তাদের উপকূলরেখা থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল (১৩.৮ মাইল) পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এর মানে হলো, প্রণালির সবচেয়ে সংকীর্ণ স্থানটি ইরান নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। তা করতে ইরান মাইন ব্যবহার করতে পারে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও দাবি করেছেন, ইরানের হরমুজ প্রণালি বন্ধ করা আত্মঘাতী হবে। জ্বালানি বিশ্লেষক বন্দনা হারি বলেন, প্রণালি বন্ধ করলে ইরানের লাভ কম; ক্ষতিই বেশি হবে। প্রতিবেশী দেশগুলো পরিণত হবে শত্রুতে।
ইউরোপের কাছে যুদ্ধবাজ ইসরায়েলই প্রিয়
আরটি জানায়, মুখে শান্তির পক্ষে বক্তব্য দেওয়া ইউরোপীয় নেতারা এখন যুদ্ধবাজ ইসরায়েলের পক্ষে সাফাই গাইছেন। তারা একদিকে সভা-সমাবেশে শান্তির কথা ঘোষণা করেন, অন্যদিকে ইরানে হামলা চালানোকে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার হিসেবে বিবেচনা করেন। রাশিয়া এই নেতাদের ইউরোজোকার হিসেবে বর্ণনা করেছে।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়ের মাখোঁ সামাজিক মাধ্যমে ঘোষণা করেছিলেন, এই অঞ্চলের সবার জন্য শান্তি এবং নিরাপত্তা আমাদের পথপ্রদর্শক নীতি হিসেবে থাকা উচিত। অথচ তেহরানে একতরফা ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর যুদ্ধবাজ দেশটির বিরুদ্ধে তাঁর উচ্চারণ বন্ধ হয়ে যায়। ফ্রান্স ইসরায়েলের অবৈধ হামলার সমালোচনা না করে দেশটির আত্মরক্ষা ও নিরাপত্তার অধিকার নিয়ে উদ্বিগ্ন। যে ইসরায়েল প্রথমেই অশান্তির দাবানল সৃষ্টি করেছে, তারাই নাকি এখন শান্তির পক্ষে আছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল স্পষ্টভাবে বলেছে, ইউরোপ গাজা হামলা নিয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানালেও ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলকে সমর্থন করে।
সংঘাতে চীনের অবস্থান
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের ব্যাপারে চীনের অবস্থা স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের হামলার কড়া নিন্দা করে দেশটি জানিয়েছে, এই হামলা মধ্যপ্রাচ্যে একটি বড় সামরিক সংঘাত তৈরি করতে পারে। চীন ইরানের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা লঙ্ঘনের নিন্দা জানিয়েছে। তারা সংকটের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে। দেশটি সতর্ক করে দিয়েছে– উত্তেজনা বৃদ্ধি কারোরই কাজে আসবে না। বেইজিং পরিস্থিতি শান্ত করতে সহযোগিতা করারও ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকে চীন একই অবস্থান বজায় রেখেছে। জাতিসংঘে চীনের রাষ্ট্রদূত ফু কং ইসরায়েলের হামলাকে ‘সামরিক দুঃসাহসিকতা’ হিসেবে উল্লেখ করে নিন্দা করেছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই ইসরায়েলি আগ্রাসনকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ফোনে ইরান-ইসরায়েল উভয় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচির সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি ইসরায়েলের হামলাকে ‘বেপরোয়া’ হিসেবে অভিহিত করেন।
- বিষয় :
- মতামত