ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

পাকিস্তানের গলার কাঁটা তালেবান

পাকিস্তানের গলার কাঁটা তালেবান

ছবি: এশিয়াটাইমস

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০২১ | ১০:৩৯ | আপডেট: ২৪ আগস্ট ২০২১ | ১০:৩৯

আফগানিস্তানের মাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়ে বিশ্বের অনেক দেশের পাশাপাশি পাকিস্তানও খুশি হয়েছে। তবে অন্যান্য দেশের সঙ্গে পাকিস্তানের পার্থক্য হচ্ছে, আনন্দের পাশাপাশি ভয়কে সঙ্গী করে প্রতিটি দিন পার করতে হচ্ছে দেশটির জনগণকে। এই ভয় পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় পরিচর্যায় লালিত-পালিত 'তালেবান' নামক দানবের ভয়। যে তালেবানরা যুদ্ধক্ষেত্রের লড়াই পাকিস্তানের প্রতিটি মসজিদ ও স্কুলে স্কুলে ছড়িয়ে দিয়েছে।

ইসলামাবাদের তৈরি এই দানব এখন খোদ পাকিস্তানেরই গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কবে, কীভাবে তালেবান নামের এই গলার কাঁটা গলা থেকে নামবে- এখন এই অপেক্ষা করা ছাড়া পাকিস্তানের দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। তালেবান ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানে বিস্তারিত লিখেছেন করাচির লেখক মোহাম্মদ হানিফ।

মানচিত্রে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান এতটাই লাগোয়া যে, কিছুদিন আগেও দুটি দেশকে একসঙ্গে 'আফ-পাক' বলে ডাকা হতো। ভৌগোলিকভাবে প্রতিবেশী দুই দেশের বাঁচা-মরাসহ অনেক কিছুই একে অপরের ওপর নির্ভর করে বলে বিশ্বাস করতেন শাসকরা। আজ থেকে প্রায় চার দশক আগে আফগানিস্তানে হামলা করে সোভিয়েত রাশিয়া। সে সময় নিজেদের দেশে কমিউনিজম প্রতিরোধ করার দোহাই দিয়ে সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে আফগান মুজাহিদিনদের সাহায্য করে পাকিস্তানের শাসকরা। যদিও শাসকদের এই যুক্তিকে 'অজুহাত' বলেই উড়িয়ে দিয়েছেন মোহাম্মদ হানিফ।

আফগানিস্তানের ওই যুদ্ধে মুজাহিদিনদের সাহায্য করে পাকিস্তানের আসলে কী লাভ হয়েছিল? পাকিস্তানের কিছু লোক অঢেল সম্পদের মালিক বনেছেন, সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের দোহাই দিয়ে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় সামরিক স্বৈরশাসন টিকে ছিল অনেক দিন, দেশের তরুণ সমাজের হাতে সস্তা এবং উচ্চমানের হেরোইন সহজলভ্য হয়েছিল, আর 'কালাশনিকভ সংস্কৃতি' নামে একে অপরকে হত্যা করে রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত বিরোধ নিষ্পত্তি করার সংস্কৃতি চালু হয়েছিল।

আফগান যুদ্ধে জয়ী হওয়ায় আজও তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন পাকিস্তানের জেনারেলরা। তাদের কারও কারও দম্ভ এমন যে, আমরা কেবল সোভিয়েত ইউনিয়নকেই পরাজিত করিনি বরং কমিউনিজমের অবসান ঘটিয়েছি। অথচ তাদের বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা সবসময়ই উহ্য ছিল। যুদ্ধ শেষে চিত্রনাট্য থেকে যুক্তরাষ্ট্র বিদায় হয়, বিজয়ী মুজাহিদিনরা কাবুলে ক্ষমতা দখল করে, পাকিস্তান আফগানিস্তানকে 'ইসলামিক রাষ্ট্র' হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং বহু বছর মুজাহিদিনদের প্রশিক্ষণ এবং 'লালনপালন' করার পর এক সময় তারাই পাকিস্তানকে অপছন্দ করতে শুরু করে। একবার পাকিস্তানি ফুটবল দল আফগানিস্তানে একটি ম্যাচ খেলতে গিয়েছিল। ফুটবলাররা খেলার মাঠে শর্টস এবং শার্ট পরায় তালেবানরা তাদের মাথা কামিয়ে পাকিস্তানে ফেরত পাঠায়। ফলাফল, আফগানিস্তানের মুজাহিদিনদের হাত থেকে মুক্তি পেতে পাকিস্তানকে আরেকটি যুদ্ধ শুরু করতে হয়েছিল।

ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের পতনের সময় তালেবানকে নিয়ে নতুন বিপদে পড়ে পাকিস্তান। ওসামা বিন লাদেনের মতো সন্ত্রাসীকে আশ্রয় দেওয়ায় আফগানিস্তানে হামলার প্রস্তুতি নেয় যুক্তরাষ্ট্র। তালেবানের সঙ্গে 'ভালো সম্পর্ক' থাকায় পাকিস্তানকেও দোষারোপ করতে থাকেন বিশ্বনেতারা। এরপর পাকিস্তানকে পক্ষ বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পক্ষ নির্বাচনের পরামর্শ দিয়ে বলা হয়, তালেবানের সঙ্গে থাকলে পাথর যুগে ফেরত যেতে হবে, আর যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে থাকলে উল্টো আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রকে বেছে নিল। পাকিস্তানে তালেবানের রাষ্ট্রদূতকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করা হলো। তালেবানকে বোমা মারার জন্য পাকিস্তানের বিমানঘাঁটি ব্যবহার করতে দেওয়া হলো।

এত কিছুর পরও পাকিস্তানের শাসকদের একটা অংশ তালেবানের পক্ষে ছিল। তারা এক হাতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অনুদান নিয়েছে, অন্য হাতে তালেবানের জন্য অনুদানের অর্থ সংগ্রহ করে তাদেরকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে। তালেবানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা মোল্লা বারাদার যখন তালেবান সরকারের অংশ ছিল, তখন পাকিস্তান তাকে সমর্থন করেছে। এরপর সীমান্তের ঠিক পাশে কোয়েটায় তাকে কিছুদিন আশ্রয়ও দিয়েছে। সেই বারাদারকেই পাকিস্তান ২০১০ সালে গ্রেপ্তার করে। আট বছর পর যখন তাকে ছেড়ে দেওয়া হলো, তার কিছুকাল পর সে এখন কাবুলের নতুন 'রাজা'। পাকিস্তান আশা করছে, বারাদার হয়তো পাকিস্তানের আতিথেয়তা মনে রাখবেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তালেবানদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করায় তালেবানদের দোসররা ময়দানের যুদ্ধকে পাকিস্তানের রাস্তায়, মসজিদে এবং স্কুলে এনে প্রতিস্থাপন করেছে। অথচ ইসলামাবাদ আশায় ছিল, তালেবানরা কোনো না কোনোভাবে পাকিস্তানের তালেবানদের লাগাম টেনে ধরবে। কিন্তু সেটা কখনোই হয়নি। এরপরও প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আবারও পুরোনো 'বন্ধু' তালেবানের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। এখন আশঙ্কা হচ্ছে, নতুন প্রজন্মের এই তালেবানের হাত থেকে রেহাই পেতে পাকিস্তানকে হয়তো নতুন আরেকটি যুদ্ধ শুরু করতে হবে।

আরও পড়ুন

×