ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

বইয়ের ভুবন

মনোজাগতিক আখ্যান

মনোজাগতিক আখ্যান

হসপিটাল : লেখক সানিয়া রুশদী মূল্য ৫০০ টাকা

সাঈদ নিশান

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৪ | ০৯:০৪

সানিয়া রুশদীর ‘হসপিটাল’ আসলে কোন জনরার উপন্যাস– মনস্তাত্ত্বিক, বিশ্লেষণধর্মী, না অন্যকিছু? সিদ্ধান্ত নিতে পাঠককে কিছুটা ধাঁধায় পড়তে হতে পারে। কারণ, প্রধান চরিত্র সানিয়া এখানে শুধু হাসপাতালে যাওয়ার আগে ও পরে তার দৈনন্দিন জীবনের কিছু ঘটনার বর্ণনা দিয়ে গেছে। আপাতদৃষ্টিতে উপন্যাসটি পড়ে বোঝা যায়, সানিয়া যা করছে, তা নিজের সিদ্ধান্তেই করছে এবং ভাবছে, তার করা সব কাজই স্বাভাবিক। সানিয়াকে অস্বাভাবিক হিসেবে দেখে তার পারিবারিক গণ্ডির ভেতরে থাকা অন্য চরিত্রগুলো। উপন্যাসটি শুরু হয় ২০১৫-এর টাইমলাইন থেকে। সানিয়া ২০০৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞানের ওপর পিএইচডি করা অবস্থায় মনোরোগে (সাইকোসিস) আক্রান্ত হলে চিকিৎসার মাধ্যমে আস্তে আস্তে সে সুস্থ হয়ে ওঠে। সে সময়কার বিপর্যয় কাটিয়ে স্বাভাবিক গতিতেই চলছিল তার জীবনধারা। হঠাৎ একদিন সানিয়ার মাঝে আবারও পুরোনো অস্থিরতা ফিরে আসে। মানসিক দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। তার মনে হয়, চারপাশের সবকিছু আস্তে আস্তে খয়েরি রং ধারণ করছে। খয়েরির মাঝে সে হারিয়ে যাচ্ছে। ক্রাইসিস অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড ট্রিটমেন্ট টিম সানিয়াকে একটি কমিউনিটি হাউসে কিছু সময় কাটানোর পরামর্শ দেয়। কিন্তু সেখানে থাকতে তার মন সায় দেয়নি। সানিয়ার কাছে কমিউনিটি হাউসে সময় কাটানোকে ধীরে ধীরে গরম হওয়া পানিতে ব্যাঙের নিঃশব্দ মৃত্যুর মতো মনে হয়েছে। ফিরে আসে বাড়িতে। সেখান থেকে অবধারিতভাবে একটি গুরুতর মামলা হিসেবে এবার তাকে পাঠানো হয় হাসপাতালে।
পুরো উপন্যাসে সানিয়া তার রোগ নির্ণয় এবং পরিস্থিতি বোঝার প্রচেষ্টা হিসেবে বিভিন্ন চিকিৎসার মধ্য দিয়ে যায়। সানিয়ার সাইকোসিস মোকাবিলা করার তিন স্তরের যাত্রাটি একটি সর্পিল পথ অনুসরণ করে। এ যাত্রায় কখনও দর্শন, কখনও রক্ষণশীলতা, কখনও রোমান্স, কখনও বিদ্রোহ, আবার কখনও সহমর্মিতা খুঁজে পাওয়া যায়– যা পঠনে বৈচিত্র্যের স্বাদ ও ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে।
একটি সুন্দর রূপক হাসপাতালে সানিয়ার মনের অবস্থাকে মূর্ত করে– “আমার চোখের সামনে তিনটা গাছ ছিল। তাদের গোড়ার কাছে ঝরা পাতারা জমতেছিল একটা দুইটা করে। ... কোনো এতিমখানার বাচ্চারা একত্রিত হইতেছিল যেন। তারপর দমকা হাওয়ায় ছিন্নভিন্ন হইয়া গেল পাতারা। ... এখন তাদের শুধু নিজেরাই সম্বল, আর সম্বল বাতাস ও তার মর্জি। কোথায় নিবে আমারে এই বাতাস, এই সিস্টেম?”
অথবা “এই হাসপাতালে নিজ বইলা কিছু বাড়তে পারে না। এইখানে কম্পিউটার আনা মানা। ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায় না। নিজের পছন্দ মতন বই বা আর্টিক্যাল পাওয়া যায় না। ... কথায় কথায় শুধু ওষুধ দিয়া দমাইয়া রাখা হয় নিজ’রে।”
তাই হাসপাতালে ইন্টারভিউ রুমে সানিয়া ডা. নেভিনকে নির্দ্বিধায় বলে ফেলে, “মেডিকেল মডেলের সাইকোলজিক্যাল ট্রিটমেন্টে আমার আস্থা নাই।” তার উপলব্ধিটা এ রকম– ‘ভাষাই মানুষের চিন্তাভাবনা ও অনুভূতির উৎস। সেইখানেই সে চিন্তাভাবনা ও অনুভূতি ঢালতেছে, আর সেইখানেই তার মানসিক জগতে গোলমাল পাকাইয়া যাইতে পারে। ভাষাই পারে সেই গিঁট খুলতে। ওষুধ পারে না।’
‘হসপিটাল’ মানসিক রোগে আক্রান্ত রোগীর চোখ দিয়ে দেখা। উত্তম পুরুষে গল্পটা বলা। এটি মানসিক অসুস্থতার (ট্রমা) প্রতি সমাজের পক্ষপাতদুষ্ট প্রতিক্রিয়া; যা প্রাতিষ্ঠানিক উদাসীনতা সম্পর্কিত বিষয়গুলোর ওপর একটি সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি সরবরাহ করে। ‘হসপিটাল’ সানিয়া রুশদীর প্রথম উপন্যাস। সম্প্রতি উপন্যাসটি ইংরেজি ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে।

আরও পড়ুন

×