রোকেয়া, নজরুল ও একটি প্রশ্ন

বেগম রোকেয়া [৯ ডিসেম্বর ১৮৮০–৯ ডিসেম্বর ১৯৩২]
মোরশেদ শফিউল হাসান
প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০২৪ | ২২:৩২
বেগম রোকেয়া বিষয়ে সামান্য পড়াশোনা ও অল্পআধটু লেখালেখির অভিজ্ঞতায় যে বিষয়টি আমাকে রীতিমতো অবাক করেছে, তা হলো একই সময়ে ও সমাজে বাস করে আর সে সমাজের জাগরণ প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দিয়েও, রোকেয়া ও নজরুল – বাঙালি মুসলমান সমাজের এই দুই শীর্ষ ব্যক্তিত্বের মধ্যে কোনো উপলক্ষে যোগাযোগ ঘটলো না কেন? নজরুল সম্পাদিত পত্রিকায় (‘ধূমকেতু’) রোকেয়ার কয়েকটি রচনা ছাপা হয়েছিল মাত্র। তখন কলকাতায় বা বাঙলায় মুসলিম নারী লেখকের সংখ্যাও আঙুলে গোনা যেত। রোকেয়ার সাহিত্য সাধনার কথা বাদ দিলেও, কলকাতা শহরেই তাঁর বালিকা বিদ্যালয় পরিচালনা, মহিলা সমিতি (আঞ্জুমানে খাওয়াতিন) ইত্যাদি কর্মযজ্ঞ সম্পর্কেও নজরুল অবহিত ছিলেন না, এ একরকম অসম্ভব। ‘সওগাত’ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ প্রমুখ অনেকেই ছিলেন যাঁরা রোকেয়া ও নজরুল উভয়ের সঙ্গেই পরিচিত ছিলেন এবং যোগাযোগ রাখতেন। রোকেয়ার অন্তত দুজন ভাবশিষ্যা বেগম শামসুন নাহার (মাহমুদ) ও সুফিয়া এন হোসেন (কামাল) তো নজরুলের স্নেহাশীর্বাদ লাভ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে একজন বেগম শামসুন নাহার রোকেয়া এবং নজরুল দুজনকে নিয়েই বই লিখেছেন। নজরুল যে শুধু ফজিলাতুন্নেসাকে নিয়ে কবিতা বা গান লিখেছেন, তা তো নয়; মাতৃসম্বোধনে বিরজাসুন্দরী দেবী বা মিসেস এম রহমানের মতো কাউকে কাউকে কবিতা উৎসর্গ করেছেন। কিন্তু বয়সে তাঁর চেয়ে উনিশ বছরের বড় সময়ের এই দুঃসাহসী ও জ্যোতির্ময়ী নারী এবং সর্বার্থে মহীয়সী ব্যক্তিত্ব রোকেয়া, কী এক অজ্ঞাত কারণে জানি না, নজরুলের কাছে শেষাবধি উপেক্ষিতই রয়ে গেছেন। রোকেয়ার জীবনকালে কিংবা তাঁর মৃত্যুর পর কোথাও নজরুল তাঁর সম্পর্কে একটি বাক্যও লেখেননি বা বলেননি। এমনকি রোকেয়ার মৃত্যুর পর তাঁর স্মরণে ১৯৩২ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার এলবার্ট হলে যে নাগরিক শোকসভাটির আয়োজন করা হয়, তাতে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের অনেক বিশিষ্টজন উপস্থিত থাকলেও, এবং প্রয়াত এই লেখক ও শিক্ষাব্রতীর প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধা নিবেদন করলেও, নজরুল তাতে উপস্থিত হননি। যদিও নজরুল তখনও সুস্থ এবং সক্রিয় (তিনি অসুস্থ হন আরও ৯ বছর পর, ১৯৪১ সালের শেষদিকে)। রোকেয়ার মৃত্যুর পর ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকা তাঁর স্মরণে একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশের উদ্যোগ নেয়, মাঘ ১৩৩৯/১৯৩২ সংখ্যা হিসেবে, যা প্রকাশিত হয়। ‘মোহাম্মদী’র আগের সংখ্যায় এই বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ বিষয়ে যে বিজ্ঞাপন বা ঘোষণাটি দেওয়া হয়েছিল তাতে ‘মরহুমা মিসেস আর-এস হোসেন সম্পর্কিত’ অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে নজরুলের লেখা কবিতাও থাকবে বলে জানানো হয়েছিল। কবি বা লেখকদের নামের তালিকায় স্বাভাবিকভাবেই সর্বাগ্রে নজরুলের নাম উল্লেখিত হয়েছিল। কিন্তু উক্ত বিশেষ সংখ্যায় নজরুলের কোনো লেখা ছাপা হয়নি। বিশেষ ক্রোড়পত্র শুরু হয় কবি শাহাদাৎ হোসেনের একটি দীর্ঘ কবিতা ‘দরদী আম্মা’ দিয়ে। কবি গোলাম মোস্তফারও একটি দীর্ঘ কবিতা (‘দুঃসাহসিকা’) ছিল এই ক্রোড়পত্রে। রোকেয়ার ব্যাপারে নজরুলের এই নীরবতা বা উদাসীনতার কারণ হয়তো কোনোদিনই আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব হবে না। [সংক্ষেপিত]
- বিষয় :
- বেগম রোকেয়া