ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

শিল্পকলা

আলিঙ্গনে মিলছুট

আলিঙ্গনে মিলছুট

শিল্পকর্ম :: মাসুদা খাতুন জুঁই ও শিল্পকর্ম :: জাফরিন গুলশান

নিসর্গ সনাতন

প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৪:৪৩ | আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৪:৪৪

মানুষের ভেতরেই তার অচিনলোক। সে যখন আয়নার সামনে দাঁড়ায়, দেখে নিজেকে; কিন্তু ওভাবে দেখতে গিয়ে প্রকৃত ‘নিজেকে’ যেন এড়িয়েও যায়। ভেতরের মানুষটিই যদি হয়ে থাকে আসল ‘সে’, তাকে তো সরাসরি আয়নায় খোলা চোখে দেখা যায় না। দেখতে হয় তাকে বন্ধ চোখে, মনের আয়নায়।

যদি তাকে বুঝতে চায় কেউ, অনুভব করে, ওই সত্তা আলিঙ্গন চাইছে। যখন আলিঙ্গনে তাকে জড়িয়ে নিতে যায়, দেখে ভেতরের সেই ‘আসল’ সত্তা বাইরের ‘ছায়া-আসল’ সত্তার খুব আপন হয়েও, সমসুর নয়। হারমোনাস নয়। নিজের ভেতর আবিষ্কার করা ওই অচেনা সত্তা অন্তর্জগতের সম্পদ। ‘আত্ম’র (Self) আরেক রূপ। এই আত্মকে আবিষ্কারের পর মানুষ যখন তাকে ভাষায় বা কাজে ব্যক্ত করে, তখন ধীরে ধীরে মানুষের একটা বিবর্তিত সামাজিক রূপ বা সোশ্যাল ইমেজ সৃষ্টি হয়। যখন নতুন সামাজিক রূপ সৃষ্টি হয়, তখন ক্রমশ এক ধরনের অবচেতন রাজনৈতিক চাওয়া-পাওয়া তৈরি হতে থাকে। ব্যাপারগুলো সরল থেকে শুরু। ক্রমশ জটিল। 

এই কথা একটি প্রদর্শনী ঘিরে। এর নাম ‘আলিঙ্গনে মিলছুট’, ইংরেজিতে– এমব্রেসিং ইনহারমোনিয়াস। আজ শুক্রবার এ প্রদর্শনীর প্রথম দিন। এটি একটি যৌথ প্রদর্শনী; এর শিল্পী দু’জন হলেন মাসুদা খাতুন জুঁই ও তাঁর ছাত্রী জাফরিন গুলশান। 

সমসুর বা হারমোনিক নয় যা, তাকে আমরা যখন নিজের সঙ্গে জড়াই, যুক্ত করি, একটা প্রাকৃতিক তরঙ্গ আবিষ্কৃত হয়। সুর তো তরঙ্গ। তরঙ্গ ভাঙলে থাকে শব্দ। ‘মেলোডি’ তাই ‘হারমোনির’ সঙ্গে গাঁটছড়ায় বাঁধা। তরঙ্গটিকে যখন দেখি, বুঝতে পারি ‘ইনহারমোনিক’ বা মিলছুটগুলো কোনো তরঙ্গভঙ্গ নয়। সেও আরেক জাতের সম্পন্ন তরঙ্গ এবং মিলছুটের আলিঙ্গন স্বয়ং প্রকৃতিরই বিকল্প ইচ্ছা। বিকল্পই হোক আর নৈর্ব্যক্তিকই হোক, প্রকৃতির ইচ্ছা মানেই নিয়ম। আর এই নিয়ম যারা চরিতার্থ করেন, তারা শিল্পী। 

এই প্রদর্শনীতে, আমার বিশ্বাস, দর্শনার্থীরা মিলছুট বা ইনহারমোনিককে আলিঙ্গনের দুই ধরনের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাবেন; দুই শিল্পীর দেখার ভিন্নতার কারণে। 

জাফরিন গুলশানের আঁকা ছবি দেখে মনে হতে পারে, তিনি আমাদের চেনা জগতের দেখার ধারাকে ভেঙে দিয়েছেন। তাঁর যে দেখানোর আয়না, সেটা অনেক ভগ্ন-আয়নার কোলাজ। একটা ভাঙা আয়নায় যেমন একই ঘরের শত মাত্রা উঠে আসে, জাফরিনের প্রতিটি ছবিতেও তেমনি জীব ও জড়ের নানান মাত্রা নিয়ে অপূর্ব সব নিরীক্ষা রয়েছে। দেখার ও দেখানোর জগৎকে তিনি মানুষের পরিধির ভেতর রেখেছেন। কিন্তু চরিত্রগুলো আহরণ করেছেন পরিধির বাইরে থেকে। তারপর মুখোমুখি করিয়ে দিয়ে মিলছুটের আলিঙ্গন দেখাতে চেয়েছেন দর্শকদের। দেখিয়েছেন, কোনো উপসংহার টানেননি। 

অন্যদিকে তাঁর শিক্ষক মাসুদা খাতুন জুঁই কাজ করেছেন মূর্ত অবয়ব নিয়ে। জীব আঁকরেও মূর্ত, জড় গড়লেও মূর্ত। তাঁর আঁকা অবয়বগুলো-চরিত্রগুলো আমাদের চেনা। উপরন্তু, উপেক্ষিতা। উপেক্ষার কারণ লুকোনো বৈপরীত্যে। তাদের ভেতর আমরা আমাদের ছায়া খুঁজতে চাই না, তাই উপেক্ষা। কিন্তু খুঁজতে না চাইলেও যা বজায় থাকে, তার অনির্বচনীয়তাকে স্বীকার না করে তো উপায় থাকে না। মাসুদা খাতুন জুঁই তাই দেখালেন। মানুষের আয়ত্তের ভেতর থাকা সমাজের বিভিন্ন বলয় ভেঙে দিলেন। 

ছাত্রী ভেঙেছেন মাত্রা, শিক্ষক ভেঙেছেন পরিধি।

 শিল্পী জুঁই পরিধি ভাঙার পর উন্মোচিত হয়ে পড়া মিলনরেখাগুলোকে এক করে দিয়েছেন তাঁর ১৪টি আঁকায়, অবশিষ্ট ইনস্টলেশন শিল্পে। মিলছুট মানুষগুলোর স্থাবর, অস্থাবর সম্পদ, সম্পদ চিন্তার ধরন, তাদের সঞ্চয়, স্বপ্ন সবকিছু তিনি তাদের ব্যবহার্য সভ্যতার ভেতর খুঁজতে চেয়েছেন। তাঁর কাজ অনেক বেশি লৌকিক, মূর্ত। তিনি দেখিয়েছেন, উপসংহারও টেনেছেন। প্রদর্শনীর অভিজ্ঞতা এমন, যেন শিক্ষক ও ছাত্রী মিলে একটি গোটা জগৎকে সম্পূর্ণ করলেন! প্রদর্শনীটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে কলাকেন্দ্রে। ঠিকানা : ৯/৪, ব্লক ডি, লালমাটিয়া, ঢাকা ১২০৭। প্রদর্শনীটি ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে। আলিঙ্গনে মিলছুটের উদ্বোধন ঘটবে আজ শুক্রবার বিকেল ৫টা ৩০ মিনিটে। সপ্তাহের অন্যান্য দিন দর্শনার্থীদের জন্য এর দরজা খোলা থাকবে বিকেল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। 

আরও পড়ুন

×