হেলাল হাফিজের বিষাদ

হেলাল হাফিজ
রিক্তা রিচি
প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:৫৫
অসংখ্য ভক্তকে কাঁদিয়ে ১৩ ডিসেম্বর কবি হেলাল হাফিজ চির অনন্তের পথে যাত্রা করেছেন। কবি বেঁচে থাকাকালে সমকাল ও কালের খেয়ার মুখোমুখি হয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় জানিয়েছেন তাঁর সাহিত্য, ব্যক্তিগত জীবন, একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতার কথা। সেসব জানা-অজানা কথা ও আলাপচারিতা আজ কেবলই স্মৃতি। সেসব স্মৃতিখণ্ড জড়ো করে এই নিবন্ধ পত্রস্থ হলো...
lনিষিদ্ধ সম্পাদকীয় কবিতাটি ফেব্রুয়ারির ১ অথবা ২ তারিখে লেখা। আমি একদিন পুরোনো ঢাকা থেকে হলে ফিরছিলাম রিকশায়। একটু অব্যবস্থিত চিত্র ছিল। তখন রেলস্টেশন ছিল ফুলবাড়িয়া। রেলস্টেশনের আগে এসে রিকশা একটু দাঁড়াল। ইপিআর ও ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। আমার রিকশার পাশে একটা খালি রিকশা। ইপিআর ছাত্রদের ওপর প্রচণ্ড লাঠিপেটা করছে। ছাত্ররাও ইপিআরকে ঢিল মারছে। সেই মার দেখে পাশের রিকশাওয়ালা বলল– ‘মার, মার ওদের, মার। কোনো কোনো প্রেম আছে মার্ডার করাও জায়েজ।’ এই কথা একজন রিকশাওয়ালার মুখে শুনে অভিভূত হয়েছি। মুহূর্তেই আমার মন ও মগজে গেঁথে গেল এবং আমাকে গ্রাস করে ফেলল।
lরিকশাওয়ালার ওই কথা থেকেই ওই পঙ্ক্তি আসছে– ‘কোনো কোনো প্রেম আছে প্রেমিককে খুনি হতে হয়/ যদি কেউ ভালোবেসে খুনি হতে চান/ তাই হয়ে যান/ উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায়।’ এটা জানুয়ারির প্রথম দিকের ঘটনা। তারপর এক মাস চলে গেছে। আমি পাগলের মতো ঘুরেছি একটা কবিতা লেখার জন্য। তারপর এই কবিতাটি লিখেছি। বইয়ে কবিতার ব্যাপ্তি যতটা রেখেছি আগে এর চেয়ে দীর্ঘ ছিল।
lআমার জীবনের দুঃখ, কষ্ট সবই আমি শিল্পের প্রয়োজনে কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছি। আমার ফেরিঅলা কবিতাটিতে সেই ছোঁয়া আছে। শৈশব, কৈশোর, প্রথম যৌবনে আমি বেশ অনাদর পেয়েছি। অনাদরে বড় হয়েছি। এর জন্য এককভাবে কেউ দায়ী না। কিছু কিছু করে সব পক্ষ দায়ী। অমরত্ব যদি আকাঙ্ক্ষার হয়, তার জন্য বেদনা অনিবার্য। পৃথিবীর সব ধ্রুপদি সাহিত্য বেদনায় মোড়ানো। শিল্পের জন্য বিরহ যতটা জরুরি, সুখ ততটা জরুরি নয়।
lআমার কবি হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ এই মাতৃহীনতার বেদনা। এটা আমাকে প্রতিনিয়ত পুড়িয়েছে। আজকে যে হেলাল হাফিজকে সবাই দেখছে, তার এই অবস্থানে আসা এবং তাকে তৈরি করার রাস্তাটা মাতৃহীনতার বেদনাই পরিষ্কার করে গেছে।
lদুঃখ, বেদনা কিন্তু শুধু কান্নাকাটির বিষয় না। এটা উপভোগেরও বিষয় এবং এটা থেকেই শিল্প তৈরি হয়। ভালো ও মৌলিক শিল্প বেদনা থেকেই শুরু হয়। যত বয়স বেড়েছে, এ বেদনা আমাকে গ্রাস করেছে, আচ্ছন্ন করেছে।
lআব্বার মৃত্যুর মাসখানেক পর আমার প্রেমিকা হেলেন হঠাৎ ডেকে বলল, ‘কবি, তোমার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।’ আমরা গিয়ে বসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে। সে বলল, ‘আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। বাবা-মা আমার বিয়ে ঠিক করেছে।’ ছোটবেলা থেকে আমি খুব সহনশীল ছিলাম। প্রচণ্ড সহ্যশক্তি আমার। তাই ভেতরের ঝড় বুঝতে দিলাম না হেলেনকে। ওখান থেকে উঠে রিকশা নিয়ে সোজা হলে চলে গেলাম। ওটাই হেলেনের সঙ্গে আমার শেষ দেখা ও শেষ কথা। এ ঘটনাও আমাকে সংসারবিমুখ করেছিল।
lআমি বেদনার সাথে বাস করি। শিল্পের জন্য বেদনা খুব জরুরি। এখন নতুন করে লিখলে এই শব্দ-পঙ্ক্তি নাও আসতে পারে। পারিপার্শ্বিকতা, মন, চিন্তা সবকিছুই পরিবর্তিত হয়। তখন যে চিন্তা নিয়ে, যে কারণে শব্দ সমাহার দিয়ে এই পঙ্ক্তি লিখেছি, সেগুলো মানুষকে স্পর্শ করেছে। কিছু কবিতা বোধ হয় পৌঁছেছে মানুষের কাছে। এখন আর লিখতে পারছি না। শারীরিক ও মানসিক কারণে। কবিতা জোর করে লিখে লাভ নেই। এটা স্বতঃস্ফূর্ত বিষয়। সেগুলো মানুষের হৃদয় নাড়াতে পারে না। কবিতা তো লেখা যায়। প্রতিদিনই লেখা যায়। লাভ কী– যদি মানুষের মনে বা মগজে নাড়া না দেয়, টঙ্কার না দেয়। শিল্পীরা নিজের মনের আনন্দেই কাজ করেন। তার পরেও মানুষের মনে ও মগজে যদি সেই কাজ দোলা দেয়, তরঙ্গ তোলে; তবেই না সেই শিল্প সার্থক হয়। প্রভাবিত করতে পারাটা শিল্পীর সাফল্য। কত শিল্পকর্মই তো রচিত হচ্ছে! মানুষকে নাড়া দিতে পারে এমন শিল্পের সংখ্যা সব সময়ই কম।
lআমি খুব কম লিখেছি। কিন্তু কবিতা আমাকে যা দিয়েছে, তা সারাজীবন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেও শেষ হবে না। অল্প কিছু কবিতা লিখে মানুষের যে ভালোবাসা, স্নেহ, শ্রদ্ধা পেয়েছি; তা খুব কম কবির ভাগ্যে হয়। আরও কিছু লেখা আছে আমার। তবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল মনে হয়েছে। তাই বইতে নেই। আমি চেষ্টা করেছি কবিতাকে আমার যাপিত জীবনের অংশ করে নিতে। কবিতা যাপিত জীবনের থেকে আলাদা কিছু না। আমি জীবন খরচ করে কবিতা লিখেছি।’
lদীর্ঘ জীবন পেলাম, কিন্তু আয়ু সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারিনি। সময় অপচয় হয়েছে অনেক বেশি। লেখালেখি ও অন্যান্য কাজকর্ম অনেক করার ছিল। করতে পারিনি। কত সুন্দর সুন্দর কবিতার পঙ্ক্তি এসেছে মাথায়, আমি টেবিলে বসিনি, লিখিনি। কারণ আলস্য খুব প্রিয় আমার। আরেকটি কারণ– মেধা একটু কম ছিল। এত অপচয় নিয়ে আমার অনুশোচনা নেই। তবে কবিতাপ্রেমীদের কাছে আমি লজ্জিত, ক্ষমাপ্রার্থী।
lকবিতা ছাড়া অন্য কোনো কিছু আসলে টানেনি তেমনভাবে। আমার মনে হয়েছে যে, জীবনে আমার অল্প কিছু যদি করার থাকে তাহলে হয়তো এই মাধ্যমটিতেই আমি পারব। আর আমি সত্যিই খুব কম প্রতিভাবান, নিজের সম্পর্কে আমি উচ্চ কোনো ধারণা আসলে পোষণই করি না। সুতরাং আমি নিজের লাগাম নিজে টেনে ধরার এই অভ্যাসটা খুব ভালোভাবেই আত্মস্থ করেছি।
lবেঁচে থাকাটা মিশ্র অনুভূতির। শরীর খুব নাজুক হয়ে পড়েছে। জানি না, পরমায়ু কুলাবে কিনা। আমার বড্ড সাধ আরও দুটি বই লেখার। একটি কবিতার, আরেকটি আমার আত্মজীবনী। পারব কিনা জানি না। শারীরিক জটিলতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে কিনা সন্দেহ।
lকবিদের ছন্দ জানা জরুরি। কবিতা ছন্দে না লিখলেও ছন্দ জানা দরকার। গদ্য কবিতারও অন্তর্গত ছন্দ আছে। আর প্রথাগত বাংলা ভাষার তিনটি ছন্দ– স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত ছন্দগুলো কবির জানা অত্যাবশ্যকীয়। দুর্বোধ্যতায় আচ্ছন্ন কবিতার চেয়ে পাঠকের চিত্তে দোলা দেয় এমন কবিতা লেখা ভালো।
lআমি সবচেয়ে বেশি উপহার পেতাম চুমু, ফুল, কলম। নানান নামের সুগন্ধি, মধ্যাহ্নভোজের টাকা, শার্ট ও প্যান্টের পিস (সত্তরের দশকে রেডিমেড প্যান্ট তেমন একটা পাওয়া যেত না)। এরপর যা বেশি উপহার পেয়েছি, তা হলো গলার মালা। হাতের ব্রেসলেট। আমার কিছু মেয়ে ভক্ত আমাকে এগুলো পরতে বাধ্য করছে। এসব তারা জোগান দিয়েও চলেছে।
lআমার একাকিত্বের জীবন। এখন মনে হয় চলতে একজন সঙ্গী লাগে। এই যে প্রয়োজনের কথা বলছি, সেটা শুধু শরীরের চাহিদার কারণেই নয়। একজন বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য বন্ধু সব সময় পাশে থাকা খুবই প্রয়োজন। সেই অভাবটা অনুভব করি। আর আমি যেহেতু হোটেলে বসবাস করি, সুতরাং আমার অসুবিধাটা একটু বেশি। জীবনের পড়ন্ত বেলায় একজন বন্ধুর পাশে থাকাটা জরুরি। বাট, ইটস টু লেট! এখন অবশ্য কিছুই আর করার নেই।
lএই দীর্ঘ জীবনে যাঁরা আমাকে ভালোবেসেছেন, তাঁদের সবার প্রতি আমি আজীবন কৃতজ্ঞ। আর যাঁরা আমাকে ভালোবাসেননি, তাঁদের প্রতি আরও বেশি কৃতজ্ঞতা। কারণ তাঁদের অবহেলা, অনাদর, প্রত্যাখ্যান আর ঘৃণাই আমাকে কবি বানিয়েছে।
- বিষয় :
- হেলাল হাফিজ