দুঃখের আরেক নাম
কবির মোহ

হেলাল হাফিজ [৭ অক্টোবর ১৯৪৮–১৩ ডিসেম্বর ২০২৪]। প্রচ্ছদ :: আনিসুজ্জামান সোহেল
আফসান চৌধুরী
প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:৫৯ | আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৫:৫১
আমার মন ভীষণ ভারাক্রান্ত। হেলাল ভাই আর নেই। আমরা যারা ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি, তারা দু-তিন বছরের বড় যাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলাম সেই ঘনিষ্ঠদের প্রায় সবাই চলে গেছে। বিশেষ করে কবি-সাহিত্যিকদের ভেতর যারা ঘনিষ্ঠ ছিলেন তাদের মধ্যে ক’জনই বা আর আছে। কবিদের ভেতর ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তাদের মধ্যে হেলাল ভাই (হেলাল হাফিজ), গুণ দা (নির্মলেন্দু গুণ), রফিক ভাই (রফিক আজাদ)। ১৩ ডিসেম্বর হেলাল ভাই মারা যাওয়ার পর আমার বাড়িতে আসা ঘনিষ্ঠ কবিদের ভেতর এখন কেবল গুণ দা বেঁচে আছেন।
হেলাল হাফিজ আমাদের বড় হওয়ার সঙ্গী। আমাদের বড় করারও সঙ্গী। আমার প্রথম গল্প ছাপিয়েছেন হেলাল ভাই। অতখন পূর্বদেশের সাহিত্য সম্পাদক। হেলাল ভাইয়ের সঙ্গে শরীফ মিয়ার দোকানে আমাদের দেখা হতো। শরীফ ভাইয়ের দোকানের হেলাল ভাই আর পত্রিকার হেলাল ভাই আলাদা ব্যাপার। সেখানে তো তিনি সম্পাদক। লেখাটা যখন ছাপা হলো, দেখলাম তিনি একটা বাক্য বাদ দিয়েছিলেন। এবং আমি কৃতজ্ঞ যে তিনি বাক্যটা বাদ দিয়েছিলেন। ওটা থাকলে সমস্যা হতো। এটুকু বলেছিলেন। সময়টা বাহাত্তর বা তিয়াত্তরের কথা। গল্প নিয়ে তাঁর মন্তব্য জানতে উদগ্রীব ছিলাম। তিনি বললেন, ‘ভালো হয়েছে।’ শুধু এটুকুই।
হেলাল ভাই আমাদের মুরুব্বিস্থানীয় মানুষ। যত সহজ সম্পর্কই থাকুক, একটা স্নেহের বন্ধন সবসময় ছিল আমাদের। নিয়মিত ক্যান্টিনে বসতাম আমরা। কবি-সাহিত্যিকরা একসঙ্গে বসছে এমন নয়। বরং ওই সময়টা আমাদের এক করেছিল।
হেলাল ভাইয়ের সঙ্গে আমার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা হয়ে গিয়েছিল, কেন হয়েছিল তা স্পষ্ট বলতে পারব না। তবে তিনি আমার নিকটজন হয়ে গিয়েছিলেন। ছোট ছোট কত স্মৃতি মনে পড়ছে। একবার সংবাদে আমার একটা লেখা ছাপা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক। যুদ্ধের একটা স্মৃতি নিয়ে লিখেছিলাম আমি। হেলাল ভাই পড়েছিলেন। আমার সঙ্গে দেখা হলে ডেকে বললেন, ‘আফসান, আমরা কবিরা যেমন একটা ঘ্যাচাং মারতে পারি শেষের দিকে, তুমিও তেমন একটা ঘ্যাচাং মেরে দিয়েছ।’ হেলাল ভাইয়ের অনেক অজর পঙ্ক্তি আছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ পড়ে কম। বাংলাদেশের মানুষ এখন না পড়ে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়াটাকেই পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ মনে করে। না পড়ার কারণেই তাঁর একটা পঙ্ক্তিতেই সবার মনোযোগ। ‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’
এখন এই পঙ্ক্তি নিয়ে লোকে হয়তো রাজনীতি করবে। তবে যারা তা করবে, তারা হেলাল ভাইদের বাস্তবতা বোঝেনি, বুঝবেও না। যুদ্ধের সময় ও যুদ্ধের পর হেলাল ভাইরা কীভাবে জীবন যাপন করেছেন, তা এই একমাত্র পঙ্ক্তির উচ্চারকরা ভাবতেই পারবে না কোনো দিন।
বাংলাদেশের সাহিত্যের পটভূমি এই মানুষগুলোর হাত ধরে তৈরি, এবং তারা কোনোদিন সাহিত্যের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি।
একদিন শুনি হেলাল ভাই চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। পঁচাত্তর-ছিয়াত্তরের দিকে। দেখা হলে আমি বললাম, ‘আপনি এখন কী করেন হেলাল ভাই?’
হেলাল ভাই বললেন, ‘জুয়া খেলি। তাস খেলি। তুমি আসো আমার সাথে, তোমাকে তাস খেলা শেখাব।’
বললাম, ‘না, কোনো দরকার নেই।’
তাস খেলা শেখার কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না। ওসব আমি বুঝিও না, আগ্রহও ছিল কম। একদিন একজন বললেন, ‘আশ্চর্য কপাল হেলালের। আরে যতবার খেলে ও জেতে।’
এই হলো হেলাল ভাই। বোহেমিয়ান। এমন মানুষের কোনো পিছুটান থাকে না। পরিবারের প্রতি কোনো কর্তব্যকর্ম সেই অর্থে পালনের দায়ও থাকে অনুপস্থিত। দায়িত্ব পালনও করেন না। হেলাল ভাইও কি তেমনই ছিলেন?
যে মানুষটি জুয়ায় হেলাল ভাইয়ের ভাগ্যের কথা বলছিলেন, সেই মানুষটিই বলেছেন, ‘হেলাল যদি খেলে পঞ্চাশ টাকা জেতে, তখনই উঠে বিশ টাকা মানি অর্ডার করে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।’
হেলাল ভাইকে যতই বোহেমিয়ান দেখাক বাইরে থেকে, ভেতরে ভেতরে তিনি পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন। তবু একটা বিষয় আমি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলাম– ঘর জিনিসটার প্রতি হেলাল ভাইয়ের বিরূপ মনোভাব ছিল। একদিন, বোধহয় ছিয়াত্তর সালের কথা, দেখা হলে বললেন, ‘আফসান কই যাও?’
ওই সময়ে আমাদের কোনো গন্তব্য নাই। আমিও স্বভাবসুলভ ছদ্মমেজাজ দেখিয়ে বললাম, ‘আমি আবার কই যাব। কোথাও যাই না।’
‘চলো, তোমাকে আমি বিচিত্রার অফিসে নিয়ে যাব।’
রাজি হলাম। যেতে যেতে বললাম, ‘বিচিত্রায় কেন যাচ্ছেন হেলাল ভাই? বিচিত্রায় আপনার কী কাজ।’
বিচিত্রা তখন খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা শিল্প-সংস্কৃতির মানুষের জন্য। আমাদের দেশের শিল্প-সংস্কৃতির ইতিহাসে কেউ যদি বিচিত্রার কথা বিস্তৃত লিখত!
সেই সময়ের আড্ডা নিয়ে একটু বলি। আমাদের আড্ডার একটা বিশেষত্ব ছিল। সেই সব আড্ডায় কিন্তু কোনো গুরুআলাপ, কোনো মহত্ত্ব, বড়দের প্রতি শ্রদ্ধানত থাকা– এসব কিছু মুখ্য ছিল না। একটা স্নেহের সম্পর্ক ছিল এবং খুব সহজ ছিল আড্ডাগুলো।
বিচিত্রার নিচে দাঁড়িয়ে দ্বিধাগ্রস্ত তখন, আসলেই যাব কিনা। হেলাল ভাই বললেন, ‘ওপরে চলো।’ শেষমেশ গেলাম। বিচিত্রা তো আমারও জায়গা। গিয়ে দেখি শাহরিয়ার ভাই (শাহরিয়ার কবির), শাহাদাত ভাই (শাহাদাত হোসেন), মাহফুজ ভাই (মাহফুজ আনাম)সহ আরও অনেকে আছে। সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছে, চা খাচ্ছে। সেখানে হেলেনের কথা উঠেছিল। কে এই হেলেন? অনেকেই বলেন, হেলেন হেলাল ভাইয়ের ছোটবেলার ভালোবাসার মানুষ। আমি একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম হেলাল ভাইকে, ‘হেলাল ভাই, হেলেন বলে কি আসলেই কেউ আছে? নাকি এসব আপনার কল্পনা।’
হেলাল ভাই উত্তর দেন না। মজা পেয়ে হাসেন।
যে জলে আগুন জ্বলে যখন বের হলো, ১৯৮৬ সালে, আমি ইংরেজিতে বইটির রিভিউ লিখেছিলাম। খুব সম্ভব হলিডে পত্রিকায়। হেলাল ভাইয়ের দুয়েকটা কবিতা আমি ইংরেজিতে অনুবাদও করেছিলাম সেই লেখায়। হেলাল ভাই পড়ে এত যে খুশি। এত খুশি হবেন আমি ভাবিনি। আমাকে বললেন, ‘আফসান, তোমাকে যে আমি কী বলব!’
আমি বললাম, ‘আশ্চর্য হেলাল ভাই। মানুষটা তো আমি। আমাকে আবার কী বলবেন।’
হেলাল ভাই কবিতার মানুষ। মানুষ যেগুলো পড়ে ওগুলো মাঠে-ময়দানের কবিতা। ওগুলোর পাশাপাশি আরও কত ভালো ভালো কবিতা তাঁর আছে, যেগুলো মানুষ পড়ে না।
আমি যখন আমার ছোটকাগজের কাজ করতাম, হেলাল ভাইয়ের কাছে চাইলে হেলাল ভাই কবিতা দিয়ে দিতেন। গুণ দার কাছে চাইলে গুণ দাও দিয়ে দিতেন। একদিন দেখি হেলাল ভাই আবার চাকরি নিয়েছেন। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। বললাম, ‘একি হেলাল ভাই, আপনি না বললেন আপনি আর চাকরি করবেন না?’
হেলাল ভাই তখন যে কথাটি বললেন তা আমার মনে চিরদিনের জন্য ছাপ রেখে গেল।
‘বিজয় বড় ক্লান্তিকর, আফসান।’
কোনো একটা পত্রিকায় সাহিত্য পাতায় যোগ দিয়েছিলেন তখন। তখন প্রেস ক্লাবে প্রচুর আড্ডা দিতেন। আমি প্রেস ক্লাবের সদস্য না। তাই আর নিয়মিত দেখা হতো না। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা হতো। আমাদের সকলের শেকড় কিন্তু শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন। শুরুতেই এর নাম একবার বলেছি। হেলাল ভাই হোক, কি গুণদা হোক, কি আমি আফসান চৌধুরীই হই– ওটাই আমাদের শেকড়। ওখানেই আমরা জন্মেছি। মানুষগুলোর সঙ্গেই আমাদের জন্ম হওয়া, ও বড় হওয়া। একবার টেলিভিশনে তাঁকে নিয়ে একটা প্রোগ্রাম হবে। আমাকে ফোন করে বললেন, ‘আফসান, তোমাকে আমি একটা অনুরোধ করতে চাই।’
আমি বললাম, ‘ফালতু কথা বাদ দেন তো হেলাল ভাই। অনুরোধ করতে চাই আবার কী। কী করতে হবে বলেন।’
‘টেলিভিশনে আমাকে নিয়ে একটা অনুষ্ঠান করবে। তুমি আমার ইন্টারভিউ করবে। তুমি আমাকে জানো, আমার কবিতাকে জানো। আমি আর কাউকে বলব না।’
অতএব, একটা বেসরকারি টেলিভিশনে হেলাল ভাইয়ের ইন্টারভিউ করলাম আমি। কী যে খুশি হলেন। এত সহজে এত খুশি হওয়া মানুষ আমি খুব কম দেখেছি।
মাঝখানে হেলাল ভাইয়ের একবার শরীর খারাপ হয়ে গেল। আমি বললাম, ‘আপনি হোটেল ছাড়েন না কেন?’
‘তুমি বুঝবে না।’
‘বললেই হলো আমি বুঝব না!’
এরপর কিছুদিন আর আলাপ নেই। একদিন হেলাল ভাই জানালেন তিনি একটা কবিতার বই করবেন। নাম রাখবেন, বেদনাকে বলেছি কেঁদো না, কিংবা আমার ভুলও হতে পারে, হয়তো অন্য কোনো বই। কবিতা ৭১? আমি বললাম, ‘হেলাল ভাই, আপনি একটা জায়গায় থাকেন না কেন।’
তিনি বললেন, ‘আমার পক্ষে থাকা সম্ভব না আফসান।’
‘কেন?’
আবার সেই উত্তর। ‘তুমি বুঝবে না।’
একদিন ভীষণ অনুযোগ করে বললাম, ‘হেলাল ভাই, আপনি নিজের একটু যত্ন করেন না কেন?’
হেলাল ভাই নিজের যত্ন নিতেন না। একা তো গুণ দাও থাকেন। কিন্তু তিনি নিজের খেয়াল রাখেন। তা ছাড়া গুণ দার পরিবার আছে। গুণ দার মেয়ে তো গুণ দাকে খুবই আদর করে। কিন্তু হেলাল ভাইয়ের তো কেউ নাই। আমার বন্ধু শবনম ফেরদৌসী, একদিন কোথাও যাচ্ছে। বললাম, ‘কই যাও।’ বললেন, ‘হেলাল ভাইকে একটু সঙ্গ দিতে যাই।’
আমি বললাম, ‘এই লোকটাকে এটাই খেলো। ওনাকে এত লোকে ভালোবাসে যে ভালোবাসার চাপেই লোকটা মরে যাবে।’
এই মানুষটিকে ভালোবাসে না, এমন কোনো লোক কি ছিল? আমার ধারণা ছিল না।
হেলাল ভাই শান্ত হলেও, তাঁর কিন্তু রাগ ছিল। একদিন কী নিয়ে খুব ক্ষেপে গিয়েছিলেন। বললেন, ‘জানো, আমি কিশোরগঞ্জের পোলা।’ আমি বললাম, ‘কিশোরগঞ্জের পোলা তা আমারে কইয়া কী লাভ।’ তিনি বললেন, ‘তুমি জানো না আফসান, আমার কিন্তু রাগ আছে।’ আমি বললাম, ‘খুব দেখেছি আপনার রাগ। কারও সঙ্গেই আপনি ঠিকঠাক রাগ করতে পারেন না।’
আমার মেসেঞ্জার বক্স ভরা, ‘আফসান, ভালোবাসা নিও’, ‘ভালোবাসা নিও’। আমি এই মেসেজগুলো আর বহন করতে পারছি না। মুছে দিতেও পারছি না। যেভাবে তিনি চলে গেলেন, সেভাবে কি তাঁর যাওয়ার কথা? আমার কাছের মানুষগুলো একে একে চলে যাচ্ছেন। এই বয়সে যাওয়ারই কথা। কিন্তু এখন আর এসব বহন করতে পারি না।
দুঃখের প্রতি হেলাল ভাইয়ের একটা মোহ ছিল, আমার প্রায়ই মনে হয়েছে। তবে এসব কিছুর ঊর্ধ্বে হেলাল ভাই ভালোবাসা চাইতেন মানুষের। পেয়েছেন তো?
- বিষয় :
- হেলাল হাফিজ
- আফসান চৌধুরী