দুঃখের আরেক নাম
আমার উদ্বাস্তু সঙ্গী

হেলাল হাফিজ [৭ অক্টোবর ১৯৪৮–১৩ ডিসেম্বর ২০২৪] প্রচ্ছদ :: আনিসুজ্জামান সোহেল
নির্মলেন্দু গুণ
প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:০১
ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কথিত আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক সেনাবাহিনীর ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতির ক্যান্টনমেন্ট বলে বিবেচিত ইকবাল হলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় সার্জেন্ট জহুরুল হক হল। অপারেশন সার্চলাইট শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তানি সেনারা জহুর হলে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। তারা ধারণা করেছিল, জগন্নাথ হল ও জহুর হল থেকে সশস্ত্র প্রতিরোধ আসতে পারে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে [১৯৭১] মার্চের অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ওই দুই হলের মাঠে ছাত্রদের সামরিক ট্রেনিং দেওয়া হতো। ফলে ওই হল দুটিতে পাকিস্তানি সেনা আক্রমণের ভয়াবহতা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। আমরা আমাদের নিউ পল্টনের মেসে বসে ওই হলে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের খবর পাচ্ছিলাম। প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠছিল পুরো হল এলাকাটি। আমরা ওইসব রক্তমারি প্রাণ কাঁপানো শব্দের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না। হলের আগুনও আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার অনুজপ্রতিম তরুণ কবি হেলাল হাফিজ তখন ওই হলে থাকত। আমি, নজরুল আর আবুল হাসান বহুদিন হেলালের রুমে রাত্রি যাপন করেছি। আমরা হেলালের জন্য খুব চিন্তিত বোধ করি। হলে থাকলে তার পক্ষে মরণ এড়ানো কঠিন হওয়ারই কথা। হেলাল কি বেঁচে আছে? রাস্তায় টহলরত পাকিস্তানি সেনাদের যথাসম্ভব এড়িয়ে ২৭ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আমরা হেলালের সন্ধানে জহুর হলের ভেতরে প্রবেশ করি। অনেকেই প্রাণের ভয়ে সেখানে প্রবেশ করার সাহস পাচ্ছিল না। সামান্য কিছু লোক তখন সেখানে জড়ো হয়েছিল। আমরা এগিয়ে যাই। গিয়ে দেখি, মাঠের একপাশে বেশ ক’টি মৃতদেহ সাজিয়ে রাখা হয়েছে। তাদের দেহ রক্তাক্ত। মুখ যন্ত্রণাবিকৃত ও আগুনে ঝলসানো। ভালো করে চেনা যায় না। দেখলাম, মৃতদের মধ্যে আমাদের প্রত্যাশিত কবি হেলাল হাফিজ নেই; কিন্তু আমাদের আরেক বন্ধু আছে, তার নামও হেলাল। সে ছিল ছাত্রলীগের সাহিত্য সম্পাদক চিশতি শাহ হেলালুর রহমান। চিশতিও কবিতা লিখত। দু’দিন আগেও কবিতা নিয়ে ওর সঙ্গে আমার কথাকাটাকাটি হয়েছিল শরীফের ক্যান্টিনে। আজ আমি ওর মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে। হলের সবুজ ঘাসের ওপর মোট ১২টি লাশ ছিল পাশাপাশি শায়িত। আমি গুনেছিলাম। অন্যদের মধ্যে হলের ছাত্র ছাড়াও ছিল হলের কিছু কর্মচারী। মনে পড়ছিল ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি আবদুল গনি রোডে পুলিশের গুলিতে নিহত কিশোর শহীদ মতিউরের কথা। মতিউরের জানাজা হয়েছিল এই হলের মাঠে। সেদিন ছিল মাঠভর্তি মানুষ। আজ ওই একই মাঠের সবুজ ঘাসের ওপর শুয়ে আছে এক ডজন যুবকের লাশ, কিন্তু সেখানে কেউ আসছে না। সেখানে আজ আর জানাজার কোনো আয়োজন নেই। ওদের নামও কেউ জানবে না কোনোদিন। ওই মৃতের সারিতে হেলাল হাফিজকে না দেখে আমরা খুশি। ওর বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ল।
তখনই হঠাৎ হলগেটের দিকে তাকিয়ে দেখি, হলের ভেতর থেকে হেলাল হাফিজ একটি ছোট্ট ব্যাগ হাতে বেরিয়ে আসছে। হ্যাঁ, হেলাল হাফিজই তো! আমরা দু’জন ছুটে গিয়ে হেলাল হাফিজকে আনন্দে বুকে জড়িয়ে ধরি। আমাদের তিনজনের চোখেই যমের চোখে ধুলো দিয়ে বেঁচে যাওয়ার আনন্দাশ্রু। পাকিস্তানি বাহিনীর ২৫ মার্চের নির্বিচার নরবলিযজ্ঞের পর ২৭ মার্চ যখন দুই ঘণ্টার জন্য সান্ধ্য-আইন শিথিল করা হয়, তখন ঢাকার মানুষ যে যে-দিক দিয়ে পারে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে পালিয়ে যাচ্ছিল। আমিও ছিলাম তাদেরই একজন। পিঁপড়ের সারির মতো দলবেঁধে বুড়িগঙ্গা নদী পেরোনোর জন্য ধাবমান মানুষের ওই সন্ত্রস্ত-দৃশ্যটি যারা সেদিন দেখেছেন, যারা নিজেরাই ছিলেন ওই করুণ দৃশ্যের কুশীলব, তারা কোনোদিনই তা ভুলতে পারবেন না।
আমি চোখ বন্ধ করলে এখনও ওই দৃশ্যটি স্পষ্ট দেখতে পাই। পরবর্তীকালে দেশত্যাগী শরণার্থীদের ভারত সীমান্তমুখী আরও দীর্ঘ, আরও ভয়াবহ মিছিলের দৃশ্য এসে ওই ছবিটাকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছিল বটে; কিন্তু ২৭ মার্চের ঢাকা ছেড়ে পালানো মানুষের মিছিলের দৃশ্য দিয়েই শুরু হয়েছিল একাত্তরের সেই ট্র্যাজেডির। এর আগে ঢাকার মানুষ কখনও এভাবে শত্রুর তাড়া খেয়ে তাদের প্রিয় নগরী ছেড়ে দলবেঁধে পালিয়েছে– আমাদের ইতিহাসে তেমন নজির নেই।
‘তাড়াতে তাড়াতে তুমি কতদূর নেবে?
এইতো আবার আমি ফিরে দাঁড়িয়েছি।’
আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ তখন (নভেম্বর ১৯৭০) বেরিয়ে গেছে। আমার পরবর্তী কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো লেখার জন্য আমি যখন মনে মনে তৈরি হচ্ছিলাম, তখন পাকিস্তানি সেনাদের তাড়া খেয়ে ঢাকা ছেড়ে পালানো মানুষের সন্ত্রস্ত মিছিলের ভেতরে নিজেকে আবিষ্কার করে, উপরে বর্ণিত পঙ্ক্তি দুটো হঠাৎ করেই আমার কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হলো। আমার দুই সঙ্গী বন্ধু নজরুল ইসলাম শাহ ও অনুজপ্রতিম হেলাল হাফিজ (হেলাল তখনও কবিতা লিখতে শুরু করেনি, লিখব লিখব বলে ভাব করছে) আমার কবিতার পঙ্ক্তি দুটি শুনে বলল, বাহ বেশ চমৎকার! এই সময়ের জন্য এর চেয়ে সংগত উচ্চারণ আর কিছুই হতে পারে না। নজরুল বলল, কবিতাটা লিখে ফেল দোস্ত। হেলালও নজরুলের কথায় সায় দিলে কবিতাটি লেখা হয়ে গেল, মনে মনে।
জামগাছে আশ্রয় নেওয়া কাক-পাখিগুলো বিপন্ন মানুষদের অসহায়ত্বের কথা ভেবে আর্তনাদ করে ওঠে। কা-কা কা...।
ভোরের পবিত্র নীরবতা ছিন্ন করে তখন শুরু হয় মর্টারের শেল আর মেশিনগানের গুলিবৃষ্টি।
মেশিনগানের ঝাঁক ঝাঁক গুলির শব্দ আর মর্টার-নিক্ষিপ্ত শেলের আকাশ কাঁপানো প্রলয় ডঙ্কা শুনে মনে হলো, আমরা এবার আরেকটি ২৫ মার্চের মুখোমুখি হতে চলেছি। পূর্ব আকাশে তখনও সূর্য ওঠেনি। সবে উঠি উঠি করছে। আর পশ্চিম আকাশে তখন কালো মেঘের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে ধোঁয়া। ২৫ মার্চে আমরা ঢাকায় দেখেছি ওই রকমের কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়ার উৎস কী? আমাদের দোকানঘরের সামনের রাস্তা ধরে ছুটতে থাকা মানুষজনের কাছ থেকে জানলাম, গানবোট থেকে নেমে পাকিস্তানি সেনারা গান পাউডার ছিটিয়ে জিঞ্জিরা ও বড়িশুর বাজার দুটি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। তারা যাকে পাচ্ছে তাকেই নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করছে। দৌড়ে ছুটে যেতে যেতে একজন চিৎকার করে বলল, ‘আপনারা যেখানে পারেন মেয়েদের লুকিয়ে রাখেন। ওরা মেয়েদের ধরে ওদের গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সাবধান! আপনারা ওঠেন। জাগেন। পালান। পানাপুকুরে লুকিয়ে থাকেন।’ উদ্বিগ্ন মধ্যবয়সী ওই লোকটিকে দেখে মনে হলো, তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা হবেন।
হেলাল হাফিজকে নিয়ে হলো আমাদের বিপদ। আমি আর নজরুল পথের ওপর দাঁড়িয়ে হেলালের জন্য অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি। কিন্তু হেলাল কিছুতেই দোকানঘর থেকে বেরিয়ে আসে না। অগত্যা দোকানঘরের ভেতরে ফিরে যাই। গিয়ে দেখি, দেয়ালে ঝোলানো একটা ছোট্ট আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত যত্নসহকারে হেলাল চুল আঁচড়াচ্ছে। ওর কাণ্ড দেখে রাগে আমার পিত্তি জ্বলে যায়। আমি চিৎকার করে ওকে ধমক দিয়ে বলি, ‘এই বুঝি তোমার চুল আঁচড়ানোর সময়? আগে মাথা বাঁচাও, মাথাই যদি না থাকে, তো চুল দিয়ে করবেটা কী?’
আমার অপর সঙ্গী নজরুল ইসলাম শাহর চুলের পরিচর্যার কোনো দরকার পড়ে না। তার গোল মাথায় শুভ্র-সুমসৃণ টাক। টাক থাকায় ওকে দেখতে আরও সুন্দর লাগে। মাথায় চুল থাকলে ওকে এত সুন্দর লাগত বলে মনে হয় না। আমার মনে হলো, চিরুনি আবিষ্কার না হলেও তার কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি ছিল না। আর আমি? আমার মাথাভর্তি অযত্নলালিত বাবরি দোলানো ঘনকৃষ্ণ কেশদাম। হাতের পাঁচ আঙুল দিয়েই আমি চিরুনির কাজ সারি।
আমার ধমক খেয়ে হেলাল চুলের পরিচর্যা অসম্পন্ন রেখেই বাইরে বেরিয়ে আসে। তখন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে আমরা ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিই, আমাদের নিকটবর্তী মসজিদটিতে গিয়ে আমরা আপাতত আশ্রয় নেব। মনে হলো মানুষজন ওই মসজিদের দিকেই ছুটছে। আমরাও ধারণা করি, আল্লাহর ঘর মসজিদে হয়তো ধর্মপ্রাণ পাকসেনারা আক্রমণ করবে না।
আমরা যখন এ রকম ভাবছি, তখন আগুনের ফুলকি ছড়াতে ছড়াতে আমাদের দোকানঘরের ওপর দিয়ে ছুটে গেল ঝাঁক ঝাঁক গুলি। গুলির পেছনে পেছনে মশালের মতো জ্বলতে জ্বলতে ছুটে আসে কামানের গোলা আর মর্টারের শেল। সামান্য নিচে দিয়ে গেলে সেইসব গুলি-গোলা ও শেলের আঘাতে আমাদের যে-কারও মস্তক মুহূর্তে ছিন্ন হতে পারত, বিশেষ করে আমার। বাহাদুরি দেখাবার জন্য নয়, বাস্তব কারণেই আমার মাথাটি অনেকের উপরে থাকে। ফলে আমার মাথাটি নিয়ে আমার হয়েছে ভারি বিপদ। বিধাতা কেন যে আমার মস্তকটিকে এমন একটি অনাবশ্যক দীর্ঘ দেহকাঠামোর ওপর স্থাপন করে তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সাম্প্রদায়িক ও অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তানের নাগরিক করে পাঠিয়েছিলেন, তা তিনিই ভালো জানেন। তিনি কি জানতেন না, আমার এই ‘চির-উন্নত-শির’টি ছররা গুলির সামনে কত বিপজ্জনক হতে পারে?
আমার মসজিদে পৌঁছাতে বিলম্ব হওয়ায় হেলাল ও নজরুল যে আমাকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিল, ওদের সন্ত্রাসবিদ্ধ বিস্ফারিত চোখের দিকে তাকিয়ে তা বেশ বুঝতে পারলাম। আমি আমার গায়ের কাদামাখা পাঞ্জাবির প্রতি ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। দেখে ওরা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে, আমি কীভাবে কঠিন সংগ্রাম করে শেষ পর্যন্ত জান বাঁচিয়ে ওই মসজিদ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছি। জান বাঁচিয়ে রাখতে পারাটা সেদিন কম কঠিন কাজ ছিল না। শুধু ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে তো বাঁচিনি, পাকসেনাদের পাতা মৃত্যুকূপ থেকে বাঁচার জন্য সেদিন আমাকে যথেষ্ট বুদ্ধিও খরচ করতে হয়েছিল। তবে কি বুদ্ধিমানরা সেদিন মারা পড়েনি? পড়েছে, যাদের ভাগ্য ছিল অপ্রসন্ন। আর ভাগ্যবানদের মধ্যে যারা মারা পড়েছিল, তাদের বেলায় হয়তো বুদ্ধিদেবী প্রসন্ন ছিলেন না। ভাগ্য ও বুদ্ধি– এ দুই দেবীর দয়া যারা পেয়েছিল, একাত্তর সালে পাকহানাদার বাহিনীর মরণবাণ থেকে তারাই শুধু বেঁচেছে।
আমাদের অস্থায়ী বাসস্থানটির কাছে পৌঁছে দেখি, দোকানঘরটির সামনে বেশ কিছু মানুষ ভিড় করে আছে। পাকসেনারা গানবোটে উঠে শুভাড্যা ত্যাগ করেছে– এই খবরটি পেয়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে হেলাল আর নজরুল আমার আগেই দোকানঘরে পৌঁছে গিয়েছিল। আমার জন্য পথের দিকে তাকিয়ে ছিল বলে দূর থেকেই ওরা আমাকে দেখতে পেল। ওরা দু’জনই ভিড়ের ভেতর থেকে আমার দিকে ছুটে এলো। আমরা পরস্পরকে আমাদের বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলাম। আমি ভয় পাচ্ছিলাম ওদের দু’জনকে নিয়ে, আর ওরা ভয় পাচ্ছিল আমাকে নিয়ে।
ওখানে কীসের ভিড়? প্রশ্ন করে জানার আগেই ওরা জানাল, জানিস, বুকে গুলি লেগে রফিক ছেলেটি মারা গেছে। ওর মৃতদেহ ঘিরেই দোকানঘরের সামনের এই জটলা। রফিক? রফিকের নাম শুনে আমার মাথাটা ঘুরে গেল। মাথায় হাত দিয়ে আমি পথের ওপর বসে পড়লাম। হা ভগবান! কিছুক্ষণ বসে থাকার পর আমি উঠলাম। হেলাল আর নজরুলের কাঁধে ভর দিয়ে এগিয়ে গেলাম ওই ভিড়ের দিকে। ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখি, বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ভিড়ের ঠিক মাঝখানটায় রক্তাক্ত দেহ নিয়ে রফিক শুয়ে আছে। মনে হলো প্রাণভরে ঘুমাচ্ছে। ওর নিষ্প্রাণ দেহটিকে ঘিরে মাতম করছে তার আপনজন। রক্তে ভেজা বুকের দিকে চেয়ে বুঝলাম, ওর বুকের মাঝখান দিয়ে গুলি ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। মাটিতে শায়িত রফিকের নিথর নিষ্প্রাণ দেহটি দেখে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো। ভোরে আর্মি আসার সংবাদ জানিয়ে আমাদের সে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছিল। বলেছিল, তাড়াতাড়ি পালান। সেই আমরা ঠিকই বেঁচে গেলাম, আর পাকসেনাদের গুলিতে প্রাণ দিল রফিক?
রফিক যদি সেই সকালে আমাদের ঘুম থেকে ডেকে না তুলত? তবে তো আমরা ঘুমিয়েই থাকতাম। আমরা ঘুমের মধ্যে নিশ্চিত মারা পড়তাম পাকসেনাদের হাতে। রফিকের বাবা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। বললেন, আপনারা দোকান ছেড়ে চলে যাওয়ার পর রফিক দোকানে গিয়ে বসেছিল। ভেবেছিল, দোকানে বহিরাগত কেউ না থাকলে পাকসেনারা তাকে কিছু বলবে না। কিন্তু ওরা যখন শিলাবৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে ছুড়তে দোকানের দিকে এগিয়ে আসছিল, তখন রফিক ভয় পেয়ে দোকানের আলমারির পেছনে লুকিয়ে পড়ে। পাকসেনারা– ‘মুক্তি কাঁহা? মন্টু-খসরু কিধার হায়’ বলতে বলতে দোকানের সামনে পজিশন নিয়ে দোকানের ভেতরে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। ওইসব ঝাঁক ঝাঁক গুলির দুটো গুলি আলমিরার পাতলা কাঠ ফুঁড়ে আলমিরার পেছনে লুকানো রফিকের বক্ষ ভেদ করে চলে যায়।
একজন আত্মীয়ের বাসায় রাত কাটাবে বলে নজরুল আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। থাকলাম আমি আর হেলাল হাফিজ। স্থির করলাম, আমরা আজকের রাতটা বেলাল বেগের সঙ্গে গল্প করে কাটাব। বিদ্যুৎ না থাকাতে সুবিধেই হলো। কারও দৃষ্টিতে না পড়ে আমরা আমাদের মেসের ভেতরে অন্ধকারে লুকিয়ে থাকতে পারলাম। পাড়ায় কিছু বিহারির বাস, তাই সংগতকারণেই ওদের নিয়ে আমাদের বেশ ভয় ছিল। পাকসেনাদের সঙ্গে মিশে ওরা কীভাবে নগরীতে বাঙালি নিধনে অংশ নিচ্ছিল, ২৭ মার্চের সকালে আমরা নিজ চোখে তা প্রত্যক্ষ করেছি।
[নির্মলেন্দু গুণ রচিত ‘মহাজীবনের কাব্য’ গ্রন্থ থেকে নির্বাচিত অংশ]
- বিষয় :
- হেলাল হাফিজ