বিশুদ্ধ জঙ্গলের ঠিকানা

যেখানে জঙ্গলের শুরু লেখক উপল বড়ুয়া প্রকাশক উড়কি মূল্য ২৪০ টাকা
ওয়াহিদ সুজন
প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫ | ০০:১১
মহাপ্লাবনের পর অনেক সময় কেটে গেছে। নির্বাচিত মানুষ ও জীবজন্তু নিয়ে ভাসছে নূহের নৌকা। কমতে শুরু করেছে প্লাবনের জল। এ অবসরে পৃথিবীর কোনো ভূমি জেগে উঠেছে কিনা, তার তালাশে ঘুঘু পাখি উড়ালেন পয়গম্বর। পাখি যখন ফেরে না, বুঝতে পারেন সামনে কোথাও আছে ভূমি। প্লাবনের জলে উর্বর আদিম এক পৃথিবী। অপেক্ষায় আছে হয়তো, কীসের? মানুষের। যে এ অদেখা ভূমি প্রত্যক্ষ করবে, বর্ণনা করবে। অকর্ষিত ভূমি চাষ করবে।
‘যেখানে জঙ্গলের শুরু’ বইয়েও একটা পাখি উড়িয়ে দিয়েছেন কবি উপল বড়ুয়া। পাখির চোখ অনুসরণ করে তিনি দেখেন ‘জঙ্গলে যাওয়ার রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি–/পাখিদের অনুসরণ করে এত দূর এসে দেখি/এখানে সব দালান, মানুষে ভরা।’ (হারানো জঙ্গলে)
জঙ্গলের হয়তো নিজস্ব ভুবন আছে। যদিও ভুবন কথাটাই এলেবেলে হতে পারে। বরং আমরা যদি কোনো বিশুদ্ধ জঙ্গল খুঁজি, সেটা কেমন? তার ঠিকানা কি জানা আছে? যাই হোক, নিশ্চয় তার কোনো স্মৃতি বিদ্যমান নাগরিক মন-মগজে। সেখানে যাপনের কিছু অভিজ্ঞতা আছে, যা কিনা বিশুদ্ধ জঙ্গলের কল্পনা জাগিয়ে তোলে। এই যে মানুষের জঙ্গল লাগে না। লাগে জঙ্গলের স্মৃতি! ‘বনের পাশে এক শুকনো শীর্ণ নদী/সেই নদীর পাড়ে খানিক বসে দেখি/কেমন শান্ত চারপাশ, হালকা শীতে/রোদ পোহাচ্ছে বক, জনশূন্যে ঘেরা একটু দূরে মরা পাতার স্তূপ, যেন/বহু আগের দৃশ্য তৈরি করে রাখা।’ (এখানে, বনে)
অথবা মদ-মাংসের আয়োজনে আদিম জঙ্গলের প্রতি আমাদের টান। যেমন ‘তাঁবু ফেলা হবে আজ; ঝলসানো হবে পাখির হৃদয়’। (রাবার বাগানের রাত্রি)
মানুষ যখন পোড়ে– জঙ্গলও পোড়ে, যদিও উপল বড়ুয়ার জঙ্গলমুখী হওয়া মূলত কৃত্রিম ও জটিল জগৎ থেকে দূরে সরে শান্তির অন্বেষণ। কিন্তু জঙ্গল পোড়া আগুনে বিদ্ধ হন তিনি। বেশ পরিহাসমূলক হলেও বেশ সহজ ও জুতসই ভাষায় সেই বর্ণনা আছে, ‘সারা দিন গেল এক পরিবেশবাদীর সঙ্গে/হাতি বাঁচানোর কথা বলতে বলতে আমরা/ঢুকে পড়লাম জঙ্গল রক্ষার দাবিতে। সন্ধ্যায় শিল্পকলায় টি স্টলে প্লাস্টিকের কাপে/চায়ে চুমুক দিয়ে আমি তাকালাম তার পায়ে/বললাম, আপনার জুতোটা বেশ সুন্দর তো!/মুচকি হাসিতে জবাব তার, পশমের তৈরি।’ (পরিবেশবাদীর সঙ্গে)
এই বইয়ে উপল বড়ুয়ার ভূমিকা স্বভাব কবির। যেভাবে আমরা বলি-ভাবি, তা কবিতা-গান হয়ে উঠে এসেছে। অন্তত এমনটা ভাবতে বাধ্য করে। শব্দ বাছাই ও এর অর্থ-অনর্থ থেকে বাস্তবিক জঙ্গলের অংশ হয়ে ওঠার বাসনায় নিয়ে গেছে। কিন্তু উপল নিজেকে ঠিকই আলাদা করে শনাক্ত করতে পেরেছেন। হয়তো ভাবালুতা ভর করবে, ঠিক তখনই শব্দরা পিঠ চাপড়ে জানিয়ে দেবে, আমরা কোথায় আছি। নগরে, ব্যস্ত জীবনে। জঙ্গল যাপন স্রেফ বিশ্রামই। যে জগৎ বড়ই বিপন্ন। যেখানে জঙ্গলের শুরু আছে, কিন্তু আমরা জানি বিশুদ্ধ জঙ্গলের ঠিকানা মানুষ জানে না। যদি জানত, তবে কি কবিতা লিখত! মানুষের ভাষায়! নাকি জঙ্গল যখন কবিতা হয়ে ওঠে তখন মানুষ আসলেই মূক-বধির। সে যখন অংশ হয়ে ওঠে সমগ্র নিয়ে আর কীই বা বলবে। v
- বিষয় :
- বই