বইয়ের ভুবন
মহামারিকালের মার্কিন সমাজচিত্র

যুক্তরাষ্ট্রের মফস্বলে করোনা সংকট ও বর্ণবিভেদের বৃত্তান্ত, লেখক-মঈনুস সুলতান, প্রকাশনা-বাতিঘর, প্রচ্ছদ-সব্যসাচী হাজরা, দাম-৩০০ টাকা
গোলাম কিবরিয়া
প্রকাশ: ১৭ জুন ২০২১ | ১২:০০
কর্মব্যস্ত পৃথিবী। কেউ যেন কাউকে দেখবার, কিছু শুনবার সময় নেই। সেই কর্মব্যস্ত পৃথিবীকে যেন থমকে দিয়েছে করোনাভাইরাস। নিরন্তর কলরবমুখর নগরীগুলোকেও হঠাৎ সুনসান নীরবতায় ঢেকে দিয়েছিল এই মহামারি। যুক্তরাষ্ট্রের মতো অর্থনৈতিক মহাপরাক্রমশালী দেশও এর ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পায়নি। প্রখ্যাত পর্যটক ও লেখক মঈনুস সুলতান যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহর ঘুরে বেড়িয়ে করোনায় সেখানকার মানুষের সংকটগুলোকে দেখেছেন। তার সেই অবলোকন তার পাঠকনন্দিত লেখনশৈলীতে উঠে এসেছে সম্প্রতি প্রকাশিত 'যুক্তরাষ্ট্রের মফস্বলে করোনা সংকট ও বর্ণবিভেদের বৃত্তান্ত' বইটিতে। মঈনুস সুলতানের ভ্রমণ গল্প পাঠককে ইতোপূর্বেই মোহিত করেছে। তবে এই বইটি ভিন্ন এক ভাবনার অবতারণা ঘটাবে পাঠক মনে।
করোনা-ক্রাইসিসে যুক্তরাষ্ট্রের সাভানা, ব্রানসউইক, হার্ডিভিল প্রভৃতি শহরে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতার সঙ্গে লেখকের বর্ণনায় যুক্ত হয়েছে পৃথিবীর নানা দেশ থেকে শরণার্থী হয়ে আসা মানুষজন ও বয়স্ক নাগরিকদের চলমান সংগ্রামের খণ্ডচিত্র। যেখানে পাঠককে লেখক পরিচয় করিয়ে দেবেন ইরাক থেকে অভিবাসী হয়ে আসা চিত্রকরের সঙ্গে, কঙ্গোর সাবেক গেরিলা যোদ্ধাদের সঙ্গে। করোনার যে বহুবিধ প্রভাব ছিল মানুষের ওপর লেখক তা দেখিয়েছেন। পরিবার হারানোর শোক যেমন ছিল, তেমনি অর্থনৈতিক মন্দায় কাটানো সময়ের মনস্তাত্ত্বিক রূপ ছিল লেখকের বর্ণনায়। আবার সেখান থেকে কারও কারও উত্তরণের যে চেষ্টা তাও উল্লেখ ছিল বইটিতে। এ বিষয়গুলো পাঠকের মনোযোগ কাড়বে। 'মাউন্টেনবাইকে আইল অব হোপের সারণিতে' শিরোনামের অংশে লেখক করোনা-ক্রান্তিতে ডিপ্রেশন ও নেচার ওয়াকের কথা তুলে ধরেছেন। যেমনটি বলছিলেন লেখক অধ্যায়ের এ অংশে, এসে পড়ি ওয়াটারফ্রন্টের কিনারা ঘেঁষে চলে যাওয়া বৃক্ষশোভিত সরণিতে। এদিককার পেল্লায় মাপের ভিলাগুলোর কোনো কোনোটায় বাস করছেন বিত্তবান সিনিয়র সিটিজেনরা। সচরাচর তাঁরা গাল্কম্ফকার্ট হাঁকিয়ে আস্তে-ধীরে হাওয়া বিধৌত সরণিতে ঘুরপাক করেন। আজ কোথাও আমি কোনো গাড়ি-ঘোড়ার লিমলেশও দেখতে পাই না। এসে পড়ি গ্রিনবার্চ সাহেবের ভিলাটির কোনায় ছায়া ছড়ানো বয়োবৃদ্ধ ওকগাছটির তলায়। বাতাসে ঝুলে থাকা ধূসর বর্ণের স্প্যানিশ মসগুলো কিংবদন্তির দৈত্যের চুল-দাড়ির মতো দুলছে। আমি মাউন্টেনবাইক স্ট্যান্ডে দিয়ে একটু দাঁড়াই। এ ধরনের ওকগাছ প্রাক-ঔপনিবেশিক জমানার, কোনো কোনোটার বয়স দুই-আড়াইশ বছরেরও ওপর। গ্রিনবার্চ সাহেব বৃক্ষগুলোর বয়স বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নিরূপণ করে লেভেল লাগানোর কথা বলতেন। কাজটি তাঁর অসমাপ্ত হয়ে গেছে। মাত্র ১০ দিন আগে তিনি প্রয়াত হয়েছেন। না, করোনা সংক্রমণে তাঁর মৃত্যু হয়নি। তবে লকডাউনের সামান্য দিন আগে তাঁর বসতবাড়িতে সার্ভিস দিতে আসা মেইডকে কাজে আসতে মানা করে দিয়েছিলেন। শরীরে একটি অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু শহরের হাসপাতালগুলো করোনা সংক্রমণে রুগ্ণ মানুষের জন্য প্রস্তুতির প্রয়োজনে বাতিল করে দিয়েছিল সব ধরনের ইলেকটিভ সার্জারি। এমনকি শরীরী দুর্বিপাকে ইমার্জেন্সিতে যাওয়াও নিরুৎসাহিত করছিল। গ্রিনবার্চ সাহেবের অসুস্থতার সংবাদ প্রতিবেশীরা জানতে পারেনি। সম্ভবত রাতের বেলা অকস্মাৎ হার্ট অ্যাটাকে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গতা ছিল না, তবে একটি আনফিনিশড বিজনেস থেকে গেছে। মাইন্টেনবাইকটি তো তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা। তাঁর কোনো ওয়ারিশানকে আমি চিনি না, এ পরিস্থিতিতে কী করা যায়?
'নেচার ওয়াক' অধ্যায়ের এক অংশে লেখক বলেন, বিষাদগ্রস্ত হালতে হাঁটতে হাঁটতে সচেতনভাবে আমার ভেতরে বয়ে চলা ভাবনা-চিন্তার খতিয়ান নেই। প্রলম্বিত লকডাউনের পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয়, আমার দিনযাপন থেকে চিরতরে তিরোহিত হয়ে যাচ্ছে উড়োজাহাজ চড়ে ওভারসিজ ট্র্যাভেলের সম্ভাবনা। যুক্তরাষ্ট্রের মফস্বল শহর থেকে ভিন্ন কোনো দেশে না যেতে পারার ব্যাপারটা যেন কারাপ্রাচীরবিহীন অদৃশ্য এক গারদের মতো চেপে বসছে আমার সত্তায়। সমস্যাটাকে আমি সরাসরি মোকাবিলা করার চেষ্টা করি। এপ্রিলে আমি কিছুদিনের জন্য এশিয়ায় ফিরতে চেয়েছিলাম। প্রথমে যেতে চেয়েছিলাম সাউথ কোরিয়ার বন্দরনগরী বুসানে, তারপর মালয়েশিয়ার পেনাং হয়ে মিয়ানমারের মান্দালয় ও কম্বোডিয়ার সায়াম রিপে। গেল বছরের নভেম্বরে টিকিট কেটে রেখেছিলাম। করোনা ক্রাইসিসের শুরুতে টেলিফোন করে তাবৎ কিছু বাতিল করি। ভেবেছিলাম, কিছু পয়সা ফেরত পাব। মাসখানেক নানা নম্বরে ফোনাফোনি করে দু'দিন আগে বুঝতে পেরেছি, পয়সা জলে গেছে। হাল জামানার এয়ার ট্র্যাভেলে টিকিটের মূল্য ফেরত না পাওয়াটা জলচলের মতো হয়ে যাচ্ছে। এতে ক্ষতবিক্ষত হওয়া বুদ্ধিমত্তার পরিপন্থি।
আমার ডিপ্রেশনের কারণ অন্যত্র। আমি বছর কয়েক ধরে এশিয়ার হরেক দেশে ছড়ানো কয়েকটি বিখ্যাত বৌদ্ধমন্দিরে কিছুক্ষণ কাটানোর প্রেক্ষাপটে একটি ভ্রমণপুস্তক লেখার পরিকল্পনা করছিলাম। নিসর্গ-নিবিড় পরিবেশে স্থাপিত ঐতিহাসিক মন্দিরগুলোতে পূজারিরা কীভাবে তাঁদের উপাসনায় সম্পর্কিত হন প্রাকৃতিক প্রতিবেশের সঙ্গে, নিসর্গ কীভাবে তাঁদের ধ্যানমগ্নচেতনায় একাত্ম হয়ে যায়, মানুষ ও প্রকৃতির পারস্পরিক মিথস্ট্ক্রিয়ার পর্যবেক্ষণভিত্তিক বয়ানকে করতে চেয়েছিলাম পুস্তকটির প্রধান থিম। সাউথ কোরিয়ার বুসান নগরের কাছাকাছি বেওমেওসা মন্দিরে আরেক দফা যাওয়াটা ছিল এ পুস্তকের জন্য ক্রিটিক্যাল।
এভাবেই লেখক তার মনের অবতারণা পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন নানাভাবে, বিভিন্ন আঙ্গিকে। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের চালচিত্রে উঠে এসেছে বর্ণবাদী বিদ্বেষের স্বরূপ। হর্সফার্মে ফ্যামিলি ভেকেশনের নিসর্গ নিবিড় প্রেক্ষাপটে সময়ের যে বিস্তারিত বর্ণনা লেখক করেছেন তা পাঠককে আপল্গুত করবে নিঃসন্দেহে। া
- বিষয় :
- বইয়ের ভুবন
- গোলাম কিবরিয়া