ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

বইয়ের ভুবন

নবজাগরণে বাঙালি মুসলমানদের ভূমিকা ও অন্যান্য

নবজাগরণে বাঙালি মুসলমানদের ভূমিকা ও অন্যান্য

কলিকাতা কেন্দ্রিক নবজাগরণ ও বাঙালি মুসলমান, লেখক- ড. সুনীল কান্তি দে, প্রকাশক-পাঠক সমাবেশ, দাম-২৯৫ টাকা

গোলাম কিবরিয়া

প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১২:০০

ড. সুনীল কান্তি দে গবেষণা ক্ষেত্রে একটি প্রতিষ্ঠিত নাম। ঔপনিবেশিক বাংলার সমাজ-সংস্কৃতি, রাজনীতি, শিক্ষা বিষয়ে তাঁর আছে মৌলিক গবেষণাকর্ম। বাঙালি মুসলমানদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণে মধ্যবিত্ত তরুণ প্রগতিশীল বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা নিয়ে পাঠক সমাবেশ থেকে লেখকের 'কলিকাতা কেন্দ্রিক নবজাগরণ ও বাঙালি মুসলমান' বইটি প্রকাশিত হয়েছে। বইটিতে ভূমিকাসহ ছয়টি অধ্যায় রয়েছে। উনিশ শতকের কলকাতাকেন্দ্রিক নবজাগরণের প্রভাবে প্রভাবিত বিশ শতকে 'শিখা গোষ্ঠী' এবং 'পূরবী সাহিত্য গোষ্ঠী'র প্রগতিশীল তরুণ বাঙালি মুসলমান লেখকগণের চিন্তা-ভাবনা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হলে রক্ষণশীল বাঙালি মুসলমানরা তাঁদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। সেই সব রক্ষণশীল বাঙালি মুসলমান বিশেষত উলেমা সম্পাদিত সংবাদ-সাময়িকপত্রগুলো কবি নজরুল ইসলামসহ তরুণ প্রগতিশীল লেখক-বুদ্ধিজীবীর সমালোচনায় অবতীর্ণ হয়। ফলে সৃষ্টি হয় তরুণ প্রগতিশীল বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও আধুনিকতাবিমুখ রক্ষণশীল বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে দ্বন্দ্ব। ষোড়শ শতকে ইউরোপের মানুষের মাঝে জাগরণ এসেছিল। প্রচলিত নিয়মনীতি, ধর্মবিশ্বাসকে সেদিন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। এ জিজ্ঞাসার মূলে ছিল বিভিন্ন বিজ্ঞানী, দার্শনিকের অনুসন্ধিৎসু রচনাসম্ভার। আর ভারতীয় উপমহাদেশে জাগরণ এসেছিল ঊনবিংশ শতাব্দীতে। সেই জাগরণ বা রেনেসাঁস ছিল খি ত। কারণ বৃহৎ মুসলিম সমাজকে সেই রেনেসাঁস স্পর্শ করেনি। মূলত হিন্দু মধ্যবিত্তের বিকাশ সাধিত হয়েছিল এ জাগরণে। হিন্দু কলেজ ও সংস্কৃত কলেজ হয়ে ওঠে নতুন চিন্তা ও দর্শনচর্চার ক্ষেত্র। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, বিবেকানন্দ প্রমুখ ছিলেন এ নবজাগরণের অগ্রদূত। তাদের সাবলীল বিতর্কে, তৎপরতায় শানিত হয়ে উঠেছিল সেই সময়ের চিন্তাধারা।
বাঙালি মুসলমান সমাজে মুক্তবুদ্ধির প্রসারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত। ঢাকায় 'বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন' গড়ে ওঠে মুসলিম সাহিত্য সমাজের নেতৃত্বে। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারবিরোধী একটি প্রগতিশীল আন্দোলন। ১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল হুসেনের নেতৃত্বে ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলার মুসলমান সমাজের যে ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও কুপ্রথা বিরাজমান ছিল, সেসব দূরীকরণই ছিল এ আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য। এই সমাজ তাদের মুখপত্র হিসেবে 'শিখা' নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করত, যার প্রতিটি সংখ্যায় লেখা থাকত 'জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব'। কলকাতার দি বেঙ্গলি পত্রিকা সাহিত্য সমাজের এই আদর্শকে বুদ্ধির মুক্তি নামে অভিহিত করে। আবদুল ওদুদ তাঁর এক প্রবন্ধে 'বুদ্ধির মুক্তি' শব্দটি উচ্চারণ করেন। এসব থেকেই একসময় মুসলিম সাহিত্য সমাজের আন্দোলনই বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন নামে পরিচিতি লাভ করে।
বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন গঠিত হয় কয়েকজন আলোকিত মানুষের উদ্যোগে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল হুসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, আবদুল কাদির প্রমুখ। তাঁরা ছিলেন যুক্তিবাদী, প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক। মুসলমানদের কুসংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে যুক্তি ও জ্ঞানের রাজ্যে আহ্বান করাই ছিল এই গোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের মূল প্রবক্তা আবুল হুসেন তাঁর একাধিক প্রবন্ধে বলেন, যে কালের প্রেক্ষাপটে বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে সত্যকে জানতে হবে। বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে জানা এবং বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে জানার মধ্যে পার্থক্য আছ। গোঁড়ামি পরিহার করে যুগের আলোকে সত্যের পক্ষে তিনি মত প্রকাশ করেন। কাজী মোতাহার হোসেন তাঁর একটি প্রবন্ধে মুসলিম পরিবারের সংগীত ও ললিতকলা চর্চার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। সুকুমার বৃত্তির বিকাশ ছাড়া সমাজ মানসের উৎসর্গ সাধিত হয় না। শিখাগোষ্ঠীর এসব বক্তব্য তৎকালীন ঢাকার রক্ষণশীল সমাজ মেনে নেয়নি।
কাজী আব্দুল ওদুদ, আবুল হুসেন, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজলের মতো মুক্তচিন্তার বাহকেরা ছিলেন এই আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তাদের মুখপত্র 'শিখা' এর প্রত্যেক সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা থাকা 'জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।' এই অসাধারণ উক্তির ভেতর স্পষ্ট হয়ে যায় তাদের জীবনদর্শন। মুক্তবুদ্ধি, প্রগতি ও আধুনিকতার প্রতি তাদের আগ্রহ আজও আমাদের বিস্মিত করে। এসবের আলোচনা উঠে এসেছে বইটিতে।
আঠারো-উনিশ শতকে যখন বাঙালি মুসলমান সমাজে সামাজিক ও রাজনৈতিক টানাপোড়েন চলছিল, সেইসঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতিতে স্বাতন্ত্র্যের অনুসন্ধান করে সমাজ যখন দিশাহারা, ঠিক তখনই প্রকাশিত হয় বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবনায় কিছু পত্রিকা ও সাময়িকী। এর মাঝে সাপ্তাহিক সওগাত অন্যতম। নারীমুক্তি আন্দোলনে যার ভূমিকা অপরিসীম। সওগাত নারীশিক্ষার পক্ষে ছিল। পত্রিকায় নারীশিক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধ ছাপানো হতো। নারী লেখকদের নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। বইটিতে নারীমুক্তি আন্দোলনে সওগাত পত্রিকার ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা থাকছে। পাঠক সে সময়কার মধ্যবিত্ত তরুণ প্রগতিশীল বাঙালি মুসলমানদের ভূমিকা জানতে পারবেন বইটি পড়ে।

আরও পড়ুন

×