ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

হাসান আজিজুল হক

পরম্পরার প্রেরণা

পরম্পরার প্রেরণা

হাসান আজিজুল হক [২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯ ১৫ নভেম্বর ২০২১]

সেলিনা হোসেন

প্রকাশ: ১৮ নভেম্বর ২০২১ | ১২:০০

১৬ নভেম্বর মঙ্গলবার সকালে, আমি যখন রাজশাহী বিমানবন্দর থেকে হাসান আজিজুল হকের বাসা বিহাসের উজানের দিকে রওনা দিয়েছি, হাজারো স্মৃতি আমাকে ভারাক্রান্ত করে তুলেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতিহার ক্যাম্পাস থেকে শুরু করে উজানে তার পড়ার ঘর, কত কত স্মৃতি!
তার পরিবারের মানুষদের সঙ্গেও নানা সময়ে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। কত গল্প, কত আড্ডা! তিনি যখন কথা বলতেন, আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনা ছাড়া ভিন্ন কিছু করার ছিল না। সেটা হোক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, তার বাসা কিংবা ঢাকায় বাংলা একাডেমিতে বা যে কোনো প্রকাশনীর অফিসে। আমি যখন বাংলা একাডেমিতে চাকরি করেছি, হাসান ভাই ঢাকায় এলেই বাংলা একাডেমিতে আমার টেবিলের সামনে এসে বসতেন। সেই আড্ডা, সেই প্রাণখোলা হাসি, কথামালা সবই আমার স্মৃতিপুঞ্জে জমা। কিন্তু এই মুহূর্তে একটা ছবি আমার চোখের সামনে স্থায়ী- আমি দেখতে পাচ্ছি, হাসান ভাই তার সেই পড়ার ঘরের টেবিলে বসে রয়েছেন।
আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। আমি ছিলাম ছাত্রী, তিনি ছিলেন দর্শন বিভাগের শিক্ষক। কিন্তু লেখালেখির সুবাদে তার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সূত্রে তাকে স্যার না ডেকে 'হাসান ভাই' বলে সম্বোধন করতাম। তিনি সে সুযোগটি করে দিয়েছিলেন।
ব্যক্তিগত এসব স্মৃতির বাইরে হাসান আজিজুল হক আমার প্রিয় সাহিত্যিক। তার লেখায় আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি। আমার লেখক জীবনের একটা বড় জায়গা পূর্ণ করে আছেন হাসান আজিজুল হক- এটা আমার জন্য একটা অসাধারণ পাওয়া। হাসান আজিজুল হকের লেখা শুধু পড়ার বিষয় নয়, আমার কাছে সেটা ছিল আত্মস্থ করা, ধারণ করার বিষয়। সেটা হোক গল্প, উপন্যাস কিংবা প্রবন্ধ। হাসান আজিজুল হকের সৃজনশীল চর্চার একটা বড় দিক মানবিক বোধ এবং সামাজিক দায়বদ্ধতাকে ধারণ করে তিনি সাহিত্য করেছেন। আমি বলব, লেখক হিসেবে এটা তার একটা বড় দিক।
আত্মজা ও একটি করবী গাছ, একটি আত্মরক্ষার কাহিনী, শকুন, জীবন ঘষে আগুন, আবর্তের সম্মুখে, নামহীন গোত্রহীন, পাতালে হাসপাতালে, মধ্যরাতের কাব্যি, মানুষটা খুন হয়ে যাচ্ছে, বিধবাদের কথা কিংবা জননী- কোন গল্পের কথা আলাদা করে বলব! তার প্রতিটি গল্পই আমাকে অনুপ্রাণিত করে। তার লেখা আগুনপাখি উপন্যাসটি বারবার পড়েছি। প্রবন্ধ-নিবন্ধ তো রয়েছেই। তবে 'আত্মজা ও একটি করবী গাছ' গল্পগ্রন্থটির কথা আমাকে আলাদা করেই বলতে হবে। সেই সময় বইটি আমাকে দারুণভাবে নাড়া দেয়। নিষ্ঠুর প্রকৃতি ও নিপীড়ক রাষ্ট্রের মুখোমুখি আজীবন সংগ্রাম করা মানুষের মাঝে তিনি যেখানে খুঁজে পেয়েছেন অফুরান প্রাণশক্তি।
'আত্মজা ও একটি করবী গাছ' গল্পে প্রতীকী শিল্প-কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে। ইনাম, সুহাস ও ফেকু- তিন বন্ধুকে নিয়ে গল্পের শুরু। তাদের কথাবার্তায় ফুটে ওঠে জীবনধারণের বিচিত্র রূপ। দিন কাটে তাদের নানা অপকর্মে। রাতে যায় ধর্মভিত্তিক দেশবিভাগে জন্মভূমি ছেড়ে আসা বুড়োর বাড়িতে। স্ত্রী আর আত্মজা রুকুকে নিয়ে তার বাস। তাদের সংসার চলে রুকুর দেহ বিক্রি করা টাকায়। বুড়ো বাধ্য হয় তাদের সহযোগিতা করতে। সেই সঙ্গে ভোগের গ্লানিতে। বাড়ির উঠোনের করবী গাছের বিষাক্ত খেয়ে একই সঙ্গে মৃত্যুও কামনা করে। গল্পের বুনন, শিল্পরূপ, বিন্যাস-বর্ণনা, প্রতীক-রূপকের ব্যবহার কিংবা অনুভব ও ভাবনার দিগন্ত বাংলা ছোটগল্পকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। সমাজকে দেখা, বিশ্নেষণের নিবিড় ও মানবিক দৃষ্টি ছিল তার। একই সঙ্গে খুঁজে পাই উন্মূল হওয়ার বেদনা।
গল্পটিতে আমরা দেখি হাসান আজিজুল হক লিখেছেন- 'জানলার কাঠের রডে মুখ লাগিয়ে বুড়োমানুষ চিৎকার করে, কে কে ওখানে গো-অ্যাঁ? লাল আলোটা সরে যায় জানলা থেকে, হড়াম করে দরজা খোলে, হাতে হারিকেন নিয়ে খোলা জায়গা পেরিয়ে গেটের কাছে আসে মানুষটা। সমস্ত উঠোনটায় বিরাট ছায়া, খাটো লুঙ্গির নিচে শুকনো দুটো পা। গেটের পাশে করবী গাছটার কাছে এসে দাঁড়ায়। আলোটা মুখের কাছে তুলে ধরে লোকটা। বোশেখ মাসের তাপে মাটিতে যেন ফাটলের আঁকিবুকি এমনি ওর মুখ। ঠাণ্ডা চোখে ইনামকে দেখে, সুহাসকে দেখে, ফেকুকে দেখে, দেখতেই থাকে, বিঁধতেই থাকে, হারিকেনের বাতিটা তোলে কাঁপা হাতে, এসো। তোমরা? ভাবলাম কে আসছে এত রাতে। তা কে আর আসছে এখানে মরতে? জেগেই তো ছিলাম। ঘুম হয় না মোটেই- ইচ্ছে করলেই কি আর ঘুমনো যায়- তার একটা বয়েস আছে- অজস্র কথা বলতে থাকে সে, মানে হয় না, বাজে কথা বকবক করেই যায়। এসো, বড্ড ঠাণ্ডা হে, ভেতরে এসো। কিন্তু ভেতরে কি ঠাণ্ডা নেই? একই রকম, একই রকম। দেশ ছেড়েছে যে তার ভেতর বাইরে নেই। সব এক হয়ে গেছে।'
শিকড় ছেঁড়া মানুষের এই হাহাকার ছিল হাসান আজিজুল হকের মর্মে গাঁথা। 'পরবাসী' বা 'মারী' গল্পেও আমরা দেখি দাঙ্গার উন্মত্ততা এবং উদ্বাস্তু জীবনের ছবি। ধর্মীয় উন্মাদনাকে পুঁজি করে দাঙ্গার রাজনীতি 'পরবাসী' গল্পটি স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে। এখানে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে ধ্বংস হয় মানুষের মানবিক সত্তা; মানুষ কীভাবে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে। সেদিন বশিরের মতো প্রতিহিংসাপরায়ণ মানুষ কোমল বাংলাদেশকে হিংস্র করে তুলেছিল। শান্তি, সহাবস্থানের নিজস্বতাকে ভুলে এক মরণ খেলায় মেতে উঠেছিল মানুষ সেদিন। তখনই ধর্ম তার ধারণ করার শক্তি হারায়। দাঙ্গার নিজস্ব রাজনীতিতে তাই ওয়াজুদ্দি চাচার মতো স্থির প্রত্যয়ী মানুষদের খুন হতে হয় দাঙ্গাবাজদের হাতে।
'আগুনপাখি' উপন্যাসেও হাসান আজিজুল হক এঁকেছেন দেশভাগের গল্প। উত্তম পুরুষে লেখা উপন্যাসটিতে আমরা পাই গ্রামের এক নারীকে; যার বয়ানে পুরো উপন্যাসটা রচিত। তিনিই উপন্যাসের কথক চরিত্র। দশজন গ্রামের নারীর মতো চার দেয়ালের মাঝে আবদ্ধ ছিল তার জীবন। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের এই মেয়ে গৃহবধূ হয়ে আসেন বিরাট একান্নবর্তী পরিবারে। তার স্বামী পাঁচ ভাই, তাদের বউ-ছেলে-মেয়ে এবং একটি বাল্যবিধবা বোন নিয়ে শ্বশুরবাড়ির বিরাট সংসার। সেই পরিবারটি যখন সিদ্ধান্ত নেয় ভারতের ভিটাবাড়ি ছেড়ে পাকিস্তান চলে আসার, তখন এই সাধারণ নারীটিই বেঁকে বসেন। কিছুতেই তিনি তার বাস্তুভিটা ছাড়তে রাজি নন; তা মৃত্যু হলেও।
গল্পের নির্মাণ, গাঁথুনি, দৃশ্য বর্ণনায় হাসান আজিজুল হক সব সময় অনবদ্য। অসাধারণ তার ভাষার ব্যবহার। কিন্তু সেটাই তার লক্ষ্য নয়। পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় তিনি তা স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবে ব্যবহার করেন। 'পাতালে হাসপাতালে' গল্পে আমরা দেখা পাই জমিরুদ্দিনকে, যে হাসপাতালে মৃত্যুর মুখোমুখি। হাসান আজিজুল হক লিখেছেন, 'সকালের ঠাণ্ডা ভাবটা খুব তাড়াতাড়ি কেটে যাচ্ছে। এলোমেলো গরম বাতাসের হলকা আসছে মাঝে মাঝে। হাসপাতালের ভিতরের বিরাট চৌকোনা প্রাঙ্গণগুলোয় বুক-সমান উঁচু বেনাঘাস শুকিয়ে ঝনঝনে হয়ে আছে। একটুখানি আগুন দরকার। রাশেদের মাথার মধ্যে কথাটা পাক দিতে থাকে। জনগণকে, সমগ্র জনগণকে সঙ্গে নিতে হবে। জমিরুদ্দিনের অসাড়, পচে-ওঠা বিবর্ণ ফোলা পায়ের দিকে তার চোখ যায়। চোখ বন্ধ করে জমিরুদ্দিন ঘুমোয়। বাইরের পৃথিবী তার কাছে একটু একটু করে বন্ধ হয়ে আসছে। জনগণকে সঙ্গে নিতে হবে নয়, জনগণের সঙ্গে থাকতে হবে, মিশে যেতে হবে, তলিয়ে যেতে হবে জনগণের মধ্যে, মাছ যেভাবে গভীর জলে তলিয়ে যায়। রাশেদের কটা চোখ দুটি থেকে মুহূর্তের জন্য আগুন ঠিকরে বেরোয়, সে হঠাৎ চিৎকার করে ডাকে, চাচা, চাচা শুনছো?'
এই গল্পেরই আরেক অংশে হাসান আজিজুল হক লিখছেন, 'বুকের ভেতরের সবটুকু জোর গলায় এনে, কথা বলার চেষ্টায় তলপেট পিঠের সঙ্গে আটকে দিয়ে সে আবার বললো, আমি এখানে অনেকদিন রয়েছি। বাঁচবো বলে নয়, মরবার জন্যে। মরণ হচ্ছে না। এতবড়ো হাসপাতাল আমার মরার ব্যবস্থা করতে পারছে না। হাসপাতালের বাইরে গিয়ে দেখেছি- পোড়াদেশ এই হাসপাতালেরই মতোন- আমার মরার বন্দোবস্ত করতে পারে না। মরতে না পারার কী কষ্ট রে বাবা! সবাই বাঁচতে চায়, বাঁচবার জন্যে হাসপাতালে আসে, আমি মরার জন্যে এসেছি কিন্তু কোনো উপায় করতে পারছি না বাপ। অথচ এই দিনকতক আগে একতলার এক শূলের রুগী রাত থাকতে থাকতে গিয়ে ওয়ার্ডের পিছনের আমগাছটায় ঝুলে পড়ে সবাইকে কলা দেখিয়ে চলে গেল। দেখেন বাবা, দেখেন ঐ যে ঐ ছোটো আমগাছটা এখান থেকে দেখা যাচ্ছে- ঐ যে ডালটা, মাটি থেকে বেশি উঁচু নয়, লোকটা ন্যাংটো হয়ে ঝুলতে ঝুলতে দুলতে দুলতে চলে গেল।
বুড়োর গলার আওয়াজ চোত মাসের ফাঁকা মাঠের বাতাসের মতো। মাঝখানটা গম্বুজের মতো ফাঁকা, চারপাশে ধুলো আর শুকনো পাতা চর্কির মতো পাক দিতে দিতে উপরে উঠে যায়।'
এমন গদ্য বোধকরি হাসান আজিজুল হকের পক্ষেই কেবল সম্ভব। তার সাহিত্য, তার গল্প, তার ভাবনা যেভাবে আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে, আমি অন্য কোথাও তা পাইনি। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের সাহিত্যের স্রোতকে বহমান রাখার জন্য হাসান আজিজুল হক যেভাবে একটি জীবনকে পূর্ণ করলেন, এটা আমার কাছে একটা অসাধারণ অনুভূতি এনে দেয়। আমি মনে করি, তাকে হারানো আমাদের জীবনে একটা বড় শূন্যতা তৈরি করল, যা কখনোই পূর্ণ হবে না। আমি নবীন প্রজন্মের তরুণদের বলতে চাই, আজ যে শূন্যতা তৈরি হলো তা পূরণ করার জন্য নিজেদের সৃজনশীলতার চর্চা অব্যাহত রাখেন। হাসান আজিজুল হক সাহিত্যের যে ধারাটি তৈরি করেছিলেন; নবীনরা অব্যাহত গতিতে এ ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, এটাই আমি প্রত্যাশা করি।

আরও পড়ুন

×