মুক্তিযুদ্ধের বিশ্বস্ত বয়ান

রক্তে আঁকা ভোর
গোলাম কিবরিয়া
প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০২২ | ১২:০০
ইতিহাস নিরেট বাস্তব, আর উপন্যাস কল্পনার বর্ণে আঁকা। ইতিহাসকে আশ্রয় করে উপন্যাস লেখা আর যদি হয় বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে, তা সাহসিকতারই বটে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এক মহাকাব্য। আর এ মহাকাব্যের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর আজীবনের স্বপ্টম্ন ছিল বাংলার স্বাধীনতা ও বাঙালির জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠা। এ সংগ্রামে যুক্ত ছিল দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও যুদ্ধ এক অনিঃশেষ মহাকাব্য। আনিসুল হকের উপন্যাসধারা 'যারা ভোর এনেছিল'-এর ষষ্ঠ ও শেষ পর্ব রক্তে আঁকা ভোর সেই মহাকাব্যিক বিশালতা ধরার প্রয়াস। মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে বইটি প্রকাশ পায়। এক দশক আগে ২০১১ সালে 'যারা ভোর এনেছিল' দিয়ে যে উপন্যাসধারার সূচনা, তা আরও চারটি উপন্যাস- উষার দুয়ারে, আলো-আঁধারের যাত্রী, এই পথে আলো জ্বেলে, এখানে থেমো না-এর ধারাবাহিকতায় এই বই রক্তে আঁকা ভোর। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধকে ১২৪টি অধ্যায়ে ধারণ করা হয়েছে এই উপন্যাসে। ৫০ বছর আগে একাত্তরের মার্চে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক বাঙালির মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার, তার স্বাধীনতা ঘোষণা এবং এই বাংলায় ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম গণহত্যার চিত্র দিয়ে যে উপন্যাসের সূত্রপাত; তা শেষ হয় ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক আগমনের মধ্য দিয়ে।
উপন্যাসে উপজীব্য হয়েছে, পাকিস্তানি সৈন্যরা বন্দি করে নিয়ে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে। হত্যাকাণ্ড চলছে বাংলাজুড়ে। লাখ লাখ মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আশ্রয় নিল ভারতের মাটিতে। মুক্তিবাহিনী গঠিত হলো। পারমাণবিক অস্ত্রবাহী মার্কিন সপ্তম নৌবহর রওনা হয়েছে বঙ্গোপসাগরের দিকে। মুক্তিবাহিনী-মিত্রবাহিনী এগিয়ে চলছে ঢাকা অভিমুখে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার পরপরই গ্রেপ্তার হলেন- উপন্যাসটি শুরু হয় এই প্রেক্ষাপটে। এরপর কী হবে, সবাই-ই তা জানে। প্রথমবারের মতো বাংলা নামের দেশটি স্বাধীন হবে, লেখক সেই ইঙ্গিত উপন্যাসের শুরুতেই দিয়ে রেখেছেন, 'বোমা বিস্টেম্ফারণের শব্দে রাতের ঘুম ভেঙে কাক উড়তে শুরু করেছে আকাশে। সেই আকাশে তিনি দেখতে পেলেন যেন আব্বার জ্যোতির্ময় মুখ। শেখ লুৎফর রহমান যেন তাকে বললেন, 'অনেস্টি অব দ্য পারপাজ আর সিনসিয়ারিটি অব দ্য পারপাজ তোমার আছে। তুমি বিজয়ী হবে। বাংলার মানুষ বিজয়ী হবে।' ওপরের উদ্ধৃতাংশে 'তিনি' নামে যার কথা বলা হলো, সেই ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু।
৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের জানা-অজানা এবং আলোচিত নানা দিক পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন লেখক। একাত্তরের এপ্রিলে মেহেরপুরের মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সঙ্গে সঙ্গে 'আমার সোনার বাংলা' গানের সঙ্গে সবার সমবেত কান্নার শব্দচিত্র এভাবে অঙ্কন করেন আনিসুল হক : 'ওমা ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে ... গাইতে গাইতে সবাই কাঁদছেন, সৈয়দ নজরুল কাঁদছেন, তাজউদ্দীন কাঁদছেন ... সবাই দরদর করে কাঁদছেন। কাঁদছে সমবেত হাজার হাজার লুঙ্গি পরা, গেঞ্জি পরা, পাঞ্জাবি পরা, শার্ট পরা, খালি গা, স্যান্ডেল পা গ্রামবাসী। এমনকি সেই আমের বাগানে গাছে গাছে পাখিরাও যেন নিজেদের গান ভুলে কণ্ঠ মেলাতে লাগল ওই আমার সোনার বাংলার সঙ্গে। সাদা বিদেশি সাংবাদিকরা কলকাতার বাঙালি সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করলেন-
সবাই কাঁদছে কেন?
কলকাতার বাঙালি সাংবাদিক বললেন-
ওরা ওদের জাতীয় সংগীত গাইছে।
জাতীয় সংগীত গাইবার সময় কাঁদতে হবে কেন?
এটা তুমি বুঝবে না, এটা কেবল বাঙালিরাই বুঝতে পারে।
বলে কলকাতার বাঙালি সাংবাদিক নিজেই চোখ মুছতে লাগলেন।'
এই উপন্যাসে লেখক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মিত্রদের কথা যেমন তুলে ধরেছেন, পাশাপাশি স্বাধীনতার শত্রুদের স্বরূপও উন্মোচন করেছেন। লেখক তার লেখায় ভাষার মাধুর্য আর ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোকে দৈনন্দিনতার ভেতর দিয়ে মানুষ হিসেবে উপস্থাপনের কারণে পাঠককে কল্পনার জগতে নিয়ে যান এই উপন্যাসে। যা সফলতার সঙ্গে করতে পেরেছেন বলে ধরে নেওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অবিস্মরণীয় অধ্যায়। এই কালপর্বের প্রায় সব কিছুই সূক্ষ্ণভাবে পাওয়া যাবে আনিসুল হক প্রণীত 'রক্তে আঁকা ভোর' উপন্যাসে।
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও যুদ্ধ এক অনিঃশেষ মহাকাব্য। আনিসুল হকের উপন্যাসধারা 'যারা ভোর এনেছিল'-এর ষষ্ঠ ও শেষ পর্ব রক্তে আঁকা ভোর সেই মহাকাব্যিক বিশালতা ধরার প্রয়াস। মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে বইটি প্রকাশ পায়। এক দশক আগে ২০১১ সালে 'যারা ভোর এনেছিল' দিয়ে যে উপন্যাসধারার সূচনা, তা আরও চারটি উপন্যাস- উষার দুয়ারে, আলো-আঁধারের যাত্রী, এই পথে আলো জ্বেলে, এখানে থেমো না-এর ধারাবাহিকতায় এই বই রক্তে আঁকা ভোর। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধকে ১২৪টি অধ্যায়ে ধারণ করা হয়েছে এই উপন্যাসে। ৫০ বছর আগে একাত্তরের মার্চে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক বাঙালির মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার, তার স্বাধীনতা ঘোষণা এবং এই বাংলায় ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম গণহত্যার চিত্র দিয়ে যে উপন্যাসের সূত্রপাত; তা শেষ হয় ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক আগমনের মধ্য দিয়ে।
উপন্যাসে উপজীব্য হয়েছে, পাকিস্তানি সৈন্যরা বন্দি করে নিয়ে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে। হত্যাকাণ্ড চলছে বাংলাজুড়ে। লাখ লাখ মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আশ্রয় নিল ভারতের মাটিতে। মুক্তিবাহিনী গঠিত হলো। পারমাণবিক অস্ত্রবাহী মার্কিন সপ্তম নৌবহর রওনা হয়েছে বঙ্গোপসাগরের দিকে। মুক্তিবাহিনী-মিত্রবাহিনী এগিয়ে চলছে ঢাকা অভিমুখে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার পরপরই গ্রেপ্তার হলেন- উপন্যাসটি শুরু হয় এই প্রেক্ষাপটে। এরপর কী হবে, সবাই-ই তা জানে। প্রথমবারের মতো বাংলা নামের দেশটি স্বাধীন হবে, লেখক সেই ইঙ্গিত উপন্যাসের শুরুতেই দিয়ে রেখেছেন, 'বোমা বিস্টেম্ফারণের শব্দে রাতের ঘুম ভেঙে কাক উড়তে শুরু করেছে আকাশে। সেই আকাশে তিনি দেখতে পেলেন যেন আব্বার জ্যোতির্ময় মুখ। শেখ লুৎফর রহমান যেন তাকে বললেন, 'অনেস্টি অব দ্য পারপাজ আর সিনসিয়ারিটি অব দ্য পারপাজ তোমার আছে। তুমি বিজয়ী হবে। বাংলার মানুষ বিজয়ী হবে।' ওপরের উদ্ধৃতাংশে 'তিনি' নামে যার কথা বলা হলো, সেই ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু।
৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের জানা-অজানা এবং আলোচিত নানা দিক পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন লেখক। একাত্তরের এপ্রিলে মেহেরপুরের মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সঙ্গে সঙ্গে 'আমার সোনার বাংলা' গানের সঙ্গে সবার সমবেত কান্নার শব্দচিত্র এভাবে অঙ্কন করেন আনিসুল হক : 'ওমা ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে ... গাইতে গাইতে সবাই কাঁদছেন, সৈয়দ নজরুল কাঁদছেন, তাজউদ্দীন কাঁদছেন ... সবাই দরদর করে কাঁদছেন। কাঁদছে সমবেত হাজার হাজার লুঙ্গি পরা, গেঞ্জি পরা, পাঞ্জাবি পরা, শার্ট পরা, খালি গা, স্যান্ডেল পা গ্রামবাসী। এমনকি সেই আমের বাগানে গাছে গাছে পাখিরাও যেন নিজেদের গান ভুলে কণ্ঠ মেলাতে লাগল ওই আমার সোনার বাংলার সঙ্গে। সাদা বিদেশি সাংবাদিকরা কলকাতার বাঙালি সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করলেন-
সবাই কাঁদছে কেন?
কলকাতার বাঙালি সাংবাদিক বললেন-
ওরা ওদের জাতীয় সংগীত গাইছে।
জাতীয় সংগীত গাইবার সময় কাঁদতে হবে কেন?
এটা তুমি বুঝবে না, এটা কেবল বাঙালিরাই বুঝতে পারে।
বলে কলকাতার বাঙালি সাংবাদিক নিজেই চোখ মুছতে লাগলেন।'
এই উপন্যাসে লেখক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মিত্রদের কথা যেমন তুলে ধরেছেন, পাশাপাশি স্বাধীনতার শত্রুদের স্বরূপও উন্মোচন করেছেন। লেখক তার লেখায় ভাষার মাধুর্য আর ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোকে দৈনন্দিনতার ভেতর দিয়ে মানুষ হিসেবে উপস্থাপনের কারণে পাঠককে কল্পনার জগতে নিয়ে যান এই উপন্যাসে। যা সফলতার সঙ্গে করতে পেরেছেন বলে ধরে নেওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অবিস্মরণীয় অধ্যায়। এই কালপর্বের প্রায় সব কিছুই সূক্ষ্ণভাবে পাওয়া যাবে আনিসুল হক প্রণীত 'রক্তে আঁকা ভোর' উপন্যাসে।