ঢাকা সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫

বাংলাদেশের একাত্তর

১৯৭১: আন্তর্জাতিক পরিসর

১৯৭১: আন্তর্জাতিক পরিসর

আফসান চৌধুরী

প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১২:০০

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কী করবে, না করবে- সে ব্যাপারে যথেষ্ট নিশ্চিত হয়েই ভারত বাংলাদেশে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে এগিয়েছে। একাত্তরে ভারতের দুশ্চিন্তা ছিল মূলত চীন। এবং এর সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সম্পর্ক ছিল না। চীন-ভারত সীমান্ত নিয়ে ভারত তার নিজের প্রতিরক্ষার স্বার্থেই নভেম্বরের বরফ পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে। বরফ পড়ার পরেই মূলত সেই সীমান্ত থেকে সৈন্যদের এই পূর্ব রণাঙ্গনে নিয়ে আসা হয়। তবে এই সৈন্যরা না এলেও আমার কাছে মনে হয় তেমন কোনো তফাৎ হতো না। কারণ, বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে তেমন কোনো বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি, যা হয়েছে তার বেশির ভাগই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যুদ্ধ। এটা পাকিস্তানি দলিল দেখলেও বোঝা যায়। মানুষ মূলত এত বেশি আবেগাশ্রিত হয়ে একাত্তরের দিকে তাকায় যে তারা ভুলে যায়, একাত্তরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে পাকিস্তানের যুদ্ধ করার কোনো ক্ষমতা ছিল না। পাকিস্তান তখন একটা ব্যর্থ দখলদার; যার দখল করে রাখার কোনো ক্ষমতা নেই, তবু সে বাংলাদেশকে দখল করে রাখার চেষ্টা করছে। কতটা অথর্ব হলে একটা রাষ্ট্র এটা করে থাকে! কিন্তু পাকিস্তান এটা করেছিল। এবং তার মূল্যও সে চুকিয়েছিল।
আমাদের নিজেদের কাছে নিজেদের তো কখনোই যথেষ্ট মনে হয় না- মুক্তিযুদ্ধের আন্তর্জাতিকীকরণ করার মাধ্যমে সেই মনে না হওয়াকে আরও বড় করে ফেলি। যেমন শ্রীনাথ রাঘবান '১৯৭১ :আ গ্লোবাল হিস্ট্রি অব দ্য ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ' নামে যে বইটা লিখেছেন- এই বই বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে, কারণ সেখানে আমরা আমাদের নিজেদের বেশ আন্তর্জাতিক ভাবতে পেরে আনন্দিত হওয়ার সুযোগ পাই। এমনিতেই যেখানে আমাদের সব সময় আন্তর্জাতিক হওয়ার লোভ, ভাব বা প্রবণতা আছে। একাত্তর নিয়ে আমরা ভাবি যে, আমরা কত বড় একটা বিষয়- সারাবিশ্বকেই নাড়িয়ে ফেলেছিলাম প্রায়। এক কদম এগিয়ে অনেককে আবার লিখেতে দেখি যে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধটাই নাকি বেঁধে যাচ্ছিল আমাদের নিয়ে। অথচ ভারত এ যুদ্ধে জেতার পরিপূর্ণ নিশ্চয়তা নিয়েই প্রবেশ করেছিল। তা ছাড়া তেমন কোনো সম্ভাবনা যদি ছিল, তাহলে ভারতীয় কূটনীতিবিদরাই বলুক না যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল! বাস্তবে তাদের কারও এমন কোনো কথাই পাওয়া যাবে না।
ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের কাছে আমি শুনেছি যে, এ ধরনের কিছু নিয়ে তাদের কোনো দুর্ভাবনা ছিল না, তবে র-এর প্রধান আর এন কাউয়ের দুর্ভাবনা ছিল। কারণ ১৯৬২ সালে চীনের সাথে ভারতের যে যুদ্ধ হয়, সেখানে ভারতকে বেশ পর্যুদস্ত হতে হয়েছিলো। যে কারণে ভারতের কাছে চীন একটা ভয়ের কারন ছিলো। অতএব, সেই দিক থেকে দেখতে গেলে এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। এবং ১৩ দিনের মধ্যে যে যুদ্ধটা শেষ হয়ে গেল- এ ব্যাপারে সুব্রামনিয়ম আমাকে বলেছিলেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের বলেছিল, দুই সপ্তাহের মধ্যে যুদ্ধ শেষ করতে হবে। কারণ, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো দিয়ে জাতিসংঘ সিকিউরিটি কাউন্সিলে আটকাতে পারবে; কিন্তু জেনারেল অ্যাসেমব্লিতে চলে গেলে তখন তাদের করার কিছু থাকবে না। কিন্তু তার আগেই তো যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। আর দলিলপত্র ঘেঁটে ডিসেম্বরের এই যুদ্ধটা দেখতে গেলে দেখা যাবে, এই ১৩ দিনে তেমন কোনো যুদ্ধই হয়নি। দিনাজপুরের হিলি ছাড়া তেমন বড় কোনো যুদ্ধের উল্লেখ পাওয়া যায় না। ভারতীয় মিত্র বাহিনী এক প্রকার বাধাহীনভাবেই ঢাকার কাছে চলে এসেছিল। তো, যেখানে যুদ্ধই হয়নি তেমন একটা- সেখানে বিশ্বযুদ্ধ হওয়া কী করে সম্ভব? আসলে ডিসেম্বরে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতীয় বাহিনীর যুদ্ধটা খুবই ছোট আকারের যুদ্ধ। ভারতের কয়েক হাজার সৈন্য মারা গেছে- কিন্তু গোটা যুদ্ধে তাদের মূল দৃষ্টি ছিল ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে। এবং সেখানে পাকিস্তানিদেরও চোখ ছিল, ভারতীয়দেরও চোখ ছিল। এটা একটা কৌশলগত বিষয়। তো, এই পরিস্থিতিকে আন্তর্জাতিকতার নামে আমাদের নিজেদের মহাযুদ্ধের অংশগ্রহণকারী প্রমাণের কোনো দরকার নেই।


তাহলে শেষ কথাটা কী দাঁড়াল? শেষ কথাটা হলো, এত যে কিছু হলো- এগুলো কেন হয়েছিল? এটা হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষ আন্দোলনটা করেছিল বলে। ভারতীয়রা যে বলে, আমরা তোমাদের স্বাধীন করে দিয়েছি- ভারতীয়দের যদি স্বাধীনই করে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল, তাহলে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো কেন তাদের? বস্তুত বাংলাদেশ যদি পাকিস্তান নামক কৃত্রিম রাষ্ট্রকে শেষ করে দেওয়ার আন্দোলনটা না করত- এবং যেটা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাধ্য হয়ে পাকিস্তানকে বাঁচানোর জন্য গণহত্যাটা চালাল- সেটা না হলে ভারতও এই পথে হাঁটতে পারত না, এটা আমাদের পরিস্কারভাবে মনে রাখা দরকার। ভারত তার অর্জনটা করতে পারত না, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি নিজে কিছু করে দেখাতে চেষ্টা করে থাকে- সেটাও পারত না, সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত নিজের যে প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করল- সেটাও হতো না। এই প্রতিটি হয়েছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ করার, যুদ্ধ করার ক্ষমতা থেকে। আমরা নিজেদের যুদ্ধে যে এত বড় ভূমিকা রেখেছি এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে আমরা প্রভাবিত করতে পেরেছি- সেটাকে আমরা নিজেরাই ভুলে যাই। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণে, হিন্দু জনগোষ্ঠীর যে লাখ লাখ শরণার্থী ভারতে চলে গিয়েছিল, তাদের দিকে তাকিয়েই কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত তৈরি হয়েছে; সেই জনমতের যত শক্তি ছিল, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তত শক্তি ছিল না। নীরবে কষ্ট পেয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরতে মরতে এই শরণার্থীরা সারা পৃথিবীকে জানিয়ে দিয়েছে, আমাদের ওপর কী করা হয়েছে দেখো। তার চেয়ে বড় শক্তি পাকিস্তানিদেরও ছিল না, ভারতেরও ছিল না। যদি এই শরণার্থী না যেত- তাহলে বিশ্বে এই জনমতটা তৈরি হতো না। যেটা ভারতকে ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশে প্রবেশ করার দরজাটা খুলে দিয়েছে। অতএব, এরই পরিপ্রেক্ষিতে যদি আমরা একাত্তরের আন্তর্জাতিক রাজনীতির দিকে তাকাই, তাহলে আমাদের পক্ষে এটা বোঝা সম্ভব যে, শুধু 'কোল্ড ওয়ারের' পুরোনো রাজনীতি দিয়ে বা মার্কিন আর সোভিয়েত যুদ্ধের যে বিশারদরা আছে, তাদের দিকে তাকিয়ে একাত্তরের বাংলাদেশের যুদ্ধের বিশ্নেষণ আর এখনকার দিনে চলবে না। এবং এই বিষয়টাকে অস্বীকার করতে করতে একটা পর্যায় পেরিয়ে গেছে যে, মানুষ একাত্তরের যুদ্ধের ব্যাপারেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। কারণ, একাত্তরের কথা বলতে গিয়ে সবাই তার নিজের কথাই বলেছে, তারা তো বাস্তবতার দিকে তাকিয়ে বলছে না। বাস্তবতা একটাই- বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধ করেছে। সেটা যে পরিসরেই হোক, আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে তারাই প্রভাবিত করেছে। তারাই বিদ্রোহ করেছে, তারাই প্রতিরোধ করেছে এবং তারাই পাকিস্তানিদের বাধ্য করেছে এমন একটা পরিস্থিতিতে যেতে, যেখান থেকে তাদের পক্ষে ফেরত আসা আর সম্ভব নয়।


বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আন্তর্জাতিক পরিসরের দুটি পর্যায়। একটি মানবিক পর্যায়, আরেকটি কূটনৈতিক। মানবিক পর্যায়ে সারা পৃথিবীর মানুষ বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার যারা বিরোধী ছিল, সেখানকার মানুষও অনেকভাবে সহায়তা করে পাশে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন সরকার পাকিস্তানকে সাহায্য করার চেষ্টা করে আসছিল; কিন্তু তার জনসমর্থন পাকিস্তানিদের পক্ষে ছিল না।
মধ্যপ্রাচ্যের যেসব দেশ সৌদি আরবনির্ভর ছিল, তারা পাকিস্তানিদের পক্ষ নিয়েছে। কারণ, ওদের সৈন্যবাহিনী প্রশিক্ষণ পেত পাকিস্তানিদের কাছ থেকে। এমন আরও অনেক কারণে স্বাভাবিকভাবেই তারা পাকিস্তানপন্থি ছিল। তবে এর মধ্যেও কয়েকটা দেশ আবার পাকিস্তানের বিপক্ষে ছিল। যেমন- ইরাক, মিসর; এরা বাংলাদেশের পক্ষে ছিল। এগুলো হলো আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তাদের নিজেদের অবস্থান। সে কারণে একাত্তরের আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে এত বড় করে দেখার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ, আন্তর্জাতিক রাজনীতি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এমন কোনো বড় প্রভাব ফেলেনি। আন্তর্জাতিক রাজনীতি ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ঘরে বন্দি করে রাখতে পারেনি। আন্তর্জাতিক রাজনীতি পাকিস্তানিদের বিশাল সবল করে যুদ্ধে পাঠাতে পারেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গেই লড়াইটা হয়েছে। তবে একই সঙ্গে আমাদের প্রতি সারা পৃথিবীর মানুষের যে সহানুভূতিটা ছিল, মানুষের সহায়তা করার যে ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা ছিল, বিভিন্নভাবে সেটার প্রকাশ ঘটেছে। বিভিন্ন সংস্থা কাজ করেছে আমাদের সাহায্য-সহযোগিতায়। অক্সফ্যামের নাম অনেক শোনা যায়, বিভিন্ন দলিল ঘাঁটতে গিয়ে আমি দেখেছি সুইডিশরা করেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন করেছে। আর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম তো বিশাল ভূমিকাই পালন করেছে।
[ক্রমশ]

আরও পড়ুন

×