স্বাস্থ্য খাত সংস্কারে সুস্পষ্ট রোডম্যাপ প্রয়োজন

স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন ৫ মে প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়
এফ এম আনোয়ার হোসেন ও শমসের আলী
প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৫ | ০০:২৬
২০২৫ সালের স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে আইনি কাঠামোর অভাব, জনগণের অপ্রতুল অংশগ্রহণ, প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবার দুর্বলতা, জনশক্তি ও হাসপাতালের সক্ষমতার ঘাটতি, ঔষধনীতির সীমাবদ্ধতা এবং পরিবেশগত ঝুঁকি বিশ্লেষণের অভাব মূল চ্যালেঞ্জ। এগুলো মোকাবিলায় বিস্তৃত আইনি কাঠামো, জনগণের অংশগ্রহণ, তথ্যভিত্তিক নীতি ও স্বচ্ছ ডেটাবেজ প্রয়োজন। ২০২৫-৩০ সালের রোডম্যাপ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ডিজিটাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, জনশক্তি প্রশিক্ষণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশ উপযোগী সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা গড়ে তুলতে পারে, যা ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্য কাভারেজের পথ প্রশস্ত করবে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ এটি জীবনমানের উন্নতি ও জাতীয় অগ্রগতির ভিত্তি। সংবিধানের ১৫(ক) এবং ১৮(১) অনুচ্ছেদে নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবার অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। বাস্তবে এই অধিকার বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেমন আইনি কাঠামোর দুর্বলতা, সমন্বয়ের অভাব এবং তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণের ঘাটতি। এর ফলে স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান ও প্রাপ্যতা প্রত্যাশিত মাত্রায় পৌঁছায়নি। সার্বিক বিবেচনায় অন্তর্বর্তী সরকার স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন গঠন করে। স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন ৫ মে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। এ কমিশনের প্রতিবেদন ও স্থানীয় সরকারনীতি সংস্কার প্রতিবেদনে অবকাঠামোগত ঘাটতি, জনশক্তির অপ্রতুলতা এবং প্রশাসনিক অদক্ষতার মতো সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু এই প্রতিবেদনগুলোর কার্যকারিতা সীমিত। কারণ সুনির্দিষ্ট কৌশল, জনগণের অংশগ্রহণ এবং তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ঘাটতি রয়েছে। এই লেখায় আমরা স্বাস্থ্য খাতের আইনি ও প্রশাসনিক দুর্বলতা, দুর্নীতির প্রভাব, প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা এবং পরিবেশগত ঝুঁকির বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করেছি।
চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের ২০২৫ সালের সংস্কার প্রক্রিয়া বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। সংবিধানে স্বাস্থ্যসেবার অধিকার নিশ্চিত থাকলেও জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০১১ ও ডিজিটাল স্বাস্থ্য কৌশল ২০২০-২৫ বাস্তবায়নে আইনি কাঠামোর ঘাটতি রয়েছে। ২০২৫ সালের স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রশাসনিক অস্পষ্টতা ও সমন্বয়হীনতা সেবার মান কমিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ৬৭ শতাংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সার্ভিস চার্টার নেই; জবাবদিহির হার মাত্র ৩৮ শতাংশ। বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ন্ত্রণের অভাবে অতিরিক্ত ব্যয় ও নিম্নমানের সেবা বাড়ছে।
উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালের বিএমডিসি প্রতিবেদনে ৪৩ শতাংশ হাসপাতালে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহারের কথা উল্লেখ করা হয়।
স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন তৈরিতে উল্লেখযোগ্য অংশীজন সভা ও কয়েক হাজার মানুষের জরিপ সত্ত্বেও রোগীর অভিজ্ঞতা, গণমাধ্যম বিশ্লেষণ ও অনলাইন জরিপের অভাব কার্যকারিতা কমিয়েছে। অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে সচেতনতার ওপর জোর দেওয়া হলেও নির্দিষ্ট লক্ষ্য বা কৌশল নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রোগ্রামে প্রভাব মূল্যায়নের তথ্য নেই এবং প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবায় বাজেটের অভাব রয়েছে। বাজেট অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে, যেমন পার্কের সৌন্দর্যায়ন, যা স্বাস্থ্য অবকাঠামোর চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ।
জনশক্তি ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা উল্লেখযোগ্য। স্বাস্থ্য কর্মশক্তি কৌশল ২০২৩-৪১ জনশক্তি বৃদ্ধির পরিকল্পনা দিলেও উদ্ভাবনী প্রস্তাব বা দক্ষতা বৃদ্ধির নির্দেশনা নেই। ঢাকার হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ ও জনবলের ঘাটতিতে সেবা ব্যাহত হচ্ছে, কিন্তু প্রতিবেদনে এর বিশ্লেষণ নেই। জাতীয় ঔষধনীতি ২০১৬-এর দুর্বল বাস্তবায়ন নিম্নমানের ওষুধ ও অতিরিক্ত মূল্যের সমস্যা তৈরি করেছে। ১৯৮২ সালের নীতির সাফল্য পুনর্মূল্যায়ন ও সামাজিক-অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের অভাব রয়েছে।
পরিবেশগত ঝুঁকি, যেমন– বুড়িগঙ্গার দূষণ ও বায়ুদূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। জলবায়ু পরিবর্তন খাদ্য ও পানির ঘাটতি বাড়াচ্ছে, কিন্তু প্রতিবেদনে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বা নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রস্তাব নেই। স্বাস্থ্য অবকাঠামো, প্রশিক্ষণ ও প্রতিরোধে বিনিয়োগ অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। গভীর গবেষণা ও স্বচ্ছ তথ্য ছাড়া সংস্কারের লক্ষ্য ঝুঁকির মুখে। বাজেটের অগ্রাধিকার নিয়ে সমস্যা আরও জটিলতা সৃষ্টি করছে। গবেষকরা মনে করেন, স্বাস্থ্য অবকাঠামো, প্রশিক্ষণ এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থায় বিনিয়োগ আলংকারিক বেড়া বা পার্ক সংস্কারের মতো অপ্রয়োজনীয় খাতে অর্থ অপচয়ের চেয়ে বেশি উপকারী হবে। গভীর গবেষণা, স্বচ্ছ তথ্য এবং লক্ষ্যভিত্তিক কৌশল ছাড়া নীতিনির্ধারকদের জন্য কার্যকর সমাধান তৈরি করা কঠিন, যা স্বাস্থ্য খাত সংস্কারের লক্ষ্যকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় অন্য দেশের সফল উদাহরণ
স্বাস্থ্য সংস্কারের এই প্রস্তাবনা ‘চাকা পুনরায় উদ্ভাবন’ নয়; বরং বাংলাদেশের আইনি-প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা এবং স্থানীয় নীতির মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করে বিদ্যমান ‘চাকার স্পোকগুলোকে শক্তিশালীকরণ’-এর মাঝেই সার্থকতা হতে পারে। স্বাস্থ্য খাত সংস্কারের জন্য অন্যান্য দেশের সফল উদাহরণ থেকে শিক্ষা নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। থাইল্যান্ডের সর্বজনীন স্বাস্থ্য কাভারেজ (ইউএইচসি) একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
২০০২ সালে জাতীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইনের মাধ্যমে শুরু হওয়া এই ব্যবস্থা একটি শক্তিশালী আইনি কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। জাতীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা অফিস (এনএইচএসও) বাজেট বণ্টন, সেবার মান নিয়ন্ত্রণ এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করে। এ ছাড়াও থাইল্যান্ডের পাবলিক হেলথ ও এনভায়রনমেন্ট মিনিস্ট্রি হাসপাতালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, যা চিকিৎসা বর্জ্যের নিরাপদ নিষ্পত্তি এবং পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করে। উদাহরণস্বরূপ ব্যাংককের হাসপাতালগুলোতে বিশেষায়িত বর্জ্য শোধনাগার ব্যবহার সংক্রামক রোগের ঝুঁকি কমিয়েছে।
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) আরেকটি কার্যকর মডেল। এটি কেন্দ্রীভূত আইনি কাঠামোর মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ২০২৪ সালের এনএইচএস ডিজিটাল স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী, ৯৫ শতাংশ রোগী ই-প্রেসক্রিপশন সিস্টেমে নিবন্ধিত। মেডিকেল ছাত্রছাত্রীর খণ্ডকালীন নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ জনশক্তির ঘাটতি মোকাবিলায় সহায়ক। এনএইচএসের টেলিমেডিসিন সেবা দূরবর্তী এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিচ্ছে, আর স্থানীয় কমিউনিটি হেলথ সেন্টারগুলো জরুরি ও প্রতিরোধমূলক সেবার মাধ্যমে হাসপাতালের ওপর চাপ কমাচ্ছে।
রুয়ান্ডার কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্য বীমা ব্যবস্থা স্থানীয় অংশগ্রহণের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এই সংস্কারে স্থানীয় সম্প্রদায়, গণমাধ্যম এবং সুশীল সমাজের ব্যাপক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে। কমিউনিটি হেলথ ওয়ার্কাররা গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্যশিক্ষা ও প্রতিরোধমূলক সেবা প্রদান করছে। মিউচুয়াল হেলথ ইন্স্যুরেন্স প্রোগ্রামের মাধ্যমে স্বল্প প্রিমিয়ামে সাধারণ মানুষ মৌলিক চিকিৎসা পাচ্ছে, যা গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবার কাভারেজ বাড়িয়েছে। বাংলাদেশে এ ধরনের সাফল্যের জন্য নীতিগত সমর্থন, স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা এবং কমিউনিটি অংশগ্রহণ জরুরি।
অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য কৌশল ২০২১-৩০ ধূমপান, স্থূলতা এবং অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি কমাতে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। ধূমপান ত্যাগ ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য প্রচারণা জনসচেতনতা বাড়িয়েছে। ধূমপান ত্যাগে বিনামূল্যে কাউন্সেলিং ও নিকোটিন প্রতিস্থাপন থেরাপি এবং সুষম খাদ্যাভ্যাসের জন্য স্থানীয় ফল-সবজির ব্যবহার উৎসাহিত করা হয়। বাংলাদেশে প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য কৌশল গ্রহণ অসংক্রামক রোগের বোঝা কমাতে পারে। ব্রাজিলের ইউনিফায়েড হেলথ সিস্টেম (এসইউএস) ডেটা-চালিত ব্যবস্থাপনার একটি মডেল। ডেটা এসইউএস নামক জাতীয় স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থা রোগীর তথ্য, চিকিৎসা সুবিধার প্রাপ্যতা এবং জনবল বণ্টন বিশ্লেষণ করে। এটি সেবার মান নিরীক্ষণ, সম্পদ বণ্টন এবং জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে। মোবাইল হেলথ ইউনিট এবং টেলিমেডিসিন প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছেছে। বাংলাদেশে ডিএইচআইএস২-এর কার্যকারিতা বাড়িয়ে এবং ডেটা-চালিত ব্যবস্থা চালু করে ঢাকা ও চট্টগ্রামের হাসপাতালের ওপর চাপ কমানো সম্ভব।
সিঙ্গাপুরের হেলথকেয়ার মাস্টারপ্ল্যান ২০২০-৩০ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে রোগীদের চিকিৎসা ইতিহাস ও হাসপাতালের কর্মক্ষমতা বিশ্লেষণ করে। এটি ব্যক্তিগত চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরি ও ব্যয় কমায়। বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক হেলথ রেকর্ড সিস্টেম চালু করে এই মডেল প্রয়োগ করা যেতে পারে। ভারতের জন-ওষুধ প্রকল্প জেনেরিক ওষুধের দোকানের মাধ্যমে ৫০-৮০ শতাংশ কম দামে ওষুধ সরবরাহ করছে, যা নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় কমিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার ১৯৯৬ সালের জাতীয় ওষুধ নীতি অত্যাবশ্যকীয় জেনেরিক ওষুধের সরবরাহ নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে জেনেরিক ওষুধের উৎপাদন ও বিতরণ বাড়ানো যেতে পারে।
জার্মানির ফেডারেল এনভায়রনমেন্ট এজেন্সি চিকিৎসা ও শিল্প বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কঠোর নীতি প্রয়োগ করে। বর্জ্য পৃথককরণ, পুনর্ব্যবহার এবং নিরাপদ নিষ্পত্তির জন্য উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। সার্কুলার ইকোনমি নীতি বর্জ্য পুনর্ব্যবহারকে উৎসাহিত করে, আর নবায়নযোগ্য জ্বালানি বায়ুদূষণ কমিয়েছে। বাংলাদেশে এ ধরনের ব্যবস্থা পরিবেশগত স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় সহায়ক হতে পারে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে সংস্কার প্রস্তাব
প্রথমেই একটি শক্তিশালী আইনি কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। স্বাস্থ্য অধিকার আইন ২০২৫ প্রণয়ন করে চিকিৎসকদের সেবাকে অত্যাবশ্যকীয় হিসেবে ঘোষণা করা উচিত। একটি স্বাধীন কর্তৃপক্ষ সেবার মান ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারে। দ্বিতীয়ত, জনগণের অংশগ্রহণ বাড়াতে মিটিং, ফোকাস গ্রুপ আলোচনা এবং অনলাইন জরিপের মাধ্যমে রোগী, স্থানীয় সম্প্রদায় ও সুবিধাবঞ্চিতদের মতামত সংগ্রহ করা প্রয়োজন। গত ৫-১০ বছরের গণমাধ্যম প্রতিবেদন বিশ্লেষণ সংস্কারের দিকনির্দেশনা দিতে পারে। তৃতীয়ত, প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবার জন্য সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ, যেমন অসংক্রামক রোগ ১০ শতাংশ কমানো এবং টেলিভিশন, রেডিও, সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণা চালানো দরকার। ফ্যামিলি হেলথ স্ট্র্যাটেজির জন্য কমিউনিটি হেলথ ওয়ার্কার নিয়োগ রোগ প্রতিরোধে সহায়ক হবে। চতুর্থত, মেডিকেল ছাত্রছাত্রীদের খণ্ডকালীন নিয়োগ ও জনশক্তির দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ডিজিটাল প্রশিক্ষণ প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে হবে। পঞ্চমত, একটি জাতীয় স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে হাসপাতালে রোগীর চাপ, রোগের ধরন ও সক্ষমতা বিশ্লেষণ করা উচিত। ষষ্ঠত, ঔষধনীতির কার্যকারিতা বাড়াতে কমিউনিটি ফার্মেসি স্থাপন এবং ১৯৮২ সালের জাতীয় ঔষধনীতির শিক্ষা পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে, যা সাশ্রয়ী ওষুধের প্রাপ্যতা বাড়িয়ে স্থানীয় শিল্পকে উৎসাহিত করেছিল। তার সঙ্গে কেন্দ্রীভূত সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার। সপ্তমত, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের যৌথ গবেষণা এবং কেন্দ্রীভূত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিবেশ সম্পর্কিত স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় সহায়ক হবে। ‘স্বাস্থ্য বাতায়ন’ প্ল্যাটফর্মকে ইলেকট্রনিক মেডিকেল রেকর্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করে ডিজিটাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রসার ঘটানো। তা ছাড়া সর্বজনীন স্বাস্থ্য বীমা চালু করে করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি তহবিলের ৩০ শতাংশ ও ভ্যাটের ২ শতাংশ স্বাস্থ্য বীমা তহবিলে বরাদ্দ করা যেতে পারে। সর্বশেষ, একটি কেন্দ্রীভূত জাতীয় ডেটাবেজ গড়ে তুলে রোগীর তথ্য, দূষণের মাত্রা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত সংস্কারে সুস্পষ্ট রোডম্যাপ প্রয়োজন
২০২৫-২৬ সালে আইন মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্য অধিকার আইন প্রণয়ন করবে, যা স্বাস্থ্যসেবাকে আরও সুনির্দিষ্ট ও জবাবদিহিমূলক করবে। একই সময়ে ২০২৫-২৭ সালের মধ্যে অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রোগ্রাম ৫০০টি ডিজিটাল প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালু করবে, যা গ্রামীণ এলাকায় সেবার প্রবেশাধিকার বাড়াবে। ২০২৬-২৮ সালে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট ১০টি জেলায় সর্বজনীন স্বাস্থ্য কাভারেজ (ইউএইচসি) পাইলট প্রকল্প শুরু করবে। পাশাপাশি ২০২৬-২৯ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও এনজিও সমন্বয় কমিটি ১০ হাজার কমিউনিটি হেলথ ওয়ার্কার নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ দেবে, যারা প্রতিরোধমূলক সেবা ও জনসচেতনতা বাড়াবে।
২০২৭-৩০ সালে বিএমডিসি মেডিকেল ছাত্রছাত্রীদের খণ্ডকালীন নিয়োগের মাধ্যমে জনশক্তির ঘাটতি পূরণ করবে। ২০২৬-২৮ সালে স্বাস্থ্য ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় একটি জাতীয় স্বাস্থ্য ও পরিবেশ ডেটাবেজ গড়ে তুলবে, যা রোগীর তথ্য ও দূষণের মাত্রা সংরক্ষণ করবে। একই সময়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয় কেন্দ্রীভূত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা করবে। এ ছাড়া ২০২৬-২৮ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর ও ঢাকা ওয়াসা বুড়িগঙ্গা নদীর দূষণ নিয়ন্ত্রণে বর্জ্য শোধন প্রকল্প চালু করবে। এসব পদক্ষেপ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতকে আরও দক্ষ ও পরিবেশবান্ধব করবে।
২০২৫ সালের স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। এ প্রতিবেদনের ঘাটতি বিশ্লেষণ করে সমাধানের পথ খুঁজে বের করাই এ আলোচনার উদ্দেশ্য।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে আইনি কাঠামোর অভাব, জনগণের অপ্রতুল অংশগ্রহণ, প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবার দুর্বলতা, জনশক্তি ও হাসপাতালের সক্ষমতার ঘাটতি, ঔষধনীতির সীমাবদ্ধতা এবং পরিবেশগত ঝুঁকি বিশ্লেষণের অভাব মূল চ্যালেঞ্জ। এগুলো মোকাবিলায় বিস্তৃত আইনি কাঠামো, জনগণের অংশগ্রহণ, তথ্যভিত্তিক নীতি এবং স্বচ্ছ ডেটাবেজ প্রয়োজন।
২০২৫-৩০ সালের রোডম্যাপ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ডিজিটাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, জনশক্তি প্রশিক্ষণ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশ উপযোগী সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা গড়ে তুলতে পারে, যা ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্য কাভারেজের পথ প্রশস্ত করবে।
এফ এম আনোয়ার হোসেন ও শমসের আলী: লেখকদ্বয় উন্নয়নকর্মী ও গবেষক
- বিষয় :
- স্বাস্থ্য খাত