ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

রাজনীতি

গণতান্ত্রিক উত্তরণ কোন পথে?

গণতান্ত্রিক উত্তরণ কোন পথে?

ফাইল ছবি

মির্জা হাসান ঐশ্বর্য সংযুক্তা রায় প্রমা

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৫ | ০০:৫৭

২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশ একটি ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। গত কয়েক দশকে দেশটি গণতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতির ব্যর্থতার সম্মুখীন। নির্বাচনী প্রক্রিয়া বারবার অভিজাত শ্রেণির প্রতিদ্বন্দ্বিতা, জনপ্রিয় বুলি এবং কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। যদিও নির্বাচনী গণতন্ত্র অপরিহার্য, তবুও এর সীমাবদ্ধতা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। প্রশ্ন হলো, শুধু নির্বাচন আয়োজন করেই কি আমরা জনগণের প্রকৃত ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে পারছি?

রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার আলোকে এই প্রশ্নের উত্তর– না। নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের ভবিষ্যৎ কেবল নিরপেক্ষ নির্বাচনের ওপর নির্ভর করে না। বরং নাগরিকদের রাষ্ট্রের সঙ্গে নিয়মিত, সরাসরি এবং সমষ্টিগতভাবে জড়িত থাকছে কিনা, সেটির ওপরেও নির্ভর করে। 

প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা
আমাদের সংবিধানে বলা হয়– ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’। বাস্তবে জনগণের ক্ষমতা থাকে শুধু ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সময়। এরপর পাঁচ বছর তারা কেবল দর্শকের ভূমিকায়। বাংলাদেশের জনগণ বেশ কয়েকটি সফল গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে নিপীড়নমূলক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। কিন্তু নির্বাচনের দিন ছাড়া তারা মূলত শাসনকার্য থেকে বাদ পড়ে থাকে।
ভোট গণনার পর নাগরিকরা নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকায় অবনমিত হয়, যখন একটি ক্ষুদ্র রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণি প্রায়ই দলীয় সীমানা পেরিয়ে প্রকৃত ক্ষমতা চালায়। এই নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জনগণের স্বার্থের রক্ষক হিসেবে কাজ করার পরিবর্তে প্রায়ই ন্যূনতম তদারকির মধ্যেই তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখেন। 

বাংলাদেশের এই গণতান্ত্রিক ঘাটতি মূলত কাঠামোগত। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে গঠিত কমিশনগুলো সংস্কারের সুপারিশ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু অনেকেই প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের সংকীর্ণ যুক্তির মধ্যে আবদ্ধ। তারা ধরে নিয়েছেন যে, নির্বাচিত রাজনীতিবিদরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন এবং করবেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস এই ধারণার বিপরীতে সুস্পষ্ট প্রমাণ প্রদান করে। 
এই পরিস্থিতি শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়। বিশ্বজুড়ে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রগুলো আস্থার হ্রাস, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এবং রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার সঙ্গে লড়াই করছে। এই প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রের অর্থ এবং প্রক্রিয়া সম্প্রসারণ শুধু কাঙ্ক্ষিত নয়, বরং অপরিহার্য।
সরাসরি গণতন্ত্র কেন?

সরাসরি গণতন্ত্রকে প্রায়ই কেবল গণভোট বা প্রত্যাহার হিসেবে ভুল বোঝা হয়। এটি তার চেয়ে অনেক বেশি বিস্তৃত এবং রূপান্তরমূলক। এটি এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে নাগরিকরা ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে শাসনকার্যে অংশ নেয়, কেবল নেতা নির্বাচনের মাধ্যমে নয়, বরং সিদ্ধান্ত গঠন, প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের পরিবর্তে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে।
রুশোর ‘সাধারণ ইচ্ছা’ ধারণা এখানে প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেন, ইংরেজরা নিজেদের মুক্ত ভাবে শুধু ভোটের সময়। এরপর তারা আবার শৃঙ্খলিত। এই মন্তব্য আজকের বাংলাদেশেও প্রযোজ্য। 
অধিক অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র, যাকে কখনও কখনও ‘সমষ্টিগত নাগরিক গণতন্ত্র’ বলা হয়; এটি এই অচলাবস্থা থেকে মুক্তির সহজ ও কার্যকর পথ হতে পারে। এটি কেবল সুযোগের সমতার পরিবর্তে ফলাফলের সমতাকে অগ্রাধিকার দেয়। সমষ্টিগত নাগরিক গণতন্ত্রকে জনজীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রসারিত করতে হবে, যেমন কমিউনিটি পুলিশিং প্রতিষ্ঠা, লিঙ্গ সম্পর্কের গণতান্ত্রিকীকরণ, শিল্প সম্পর্কের শাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক সুরক্ষা। প্রান্তিক গোষ্ঠী যেমন গ্রামীণ কৃষক, পোশাক শ্রমিক, নারী, জাতিগত সংখ্যালঘু এবং শহুরে দরিদ্রদের নীতি গঠন এবং অভিজাতদের জবাবদিহির জন্য অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ক্ষমতায়িত করার জন্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

এটি কীভাবে করা যায়?
বাংলাদেশে ইতোমধ্যে স্থানীয় শাসন কাঠামো রয়েছে– ওয়ার্ড সভা, উন্মুক্ত বাজেট সভা; যেগুলোকে সাংবিধানিক ক্ষমতাসম্পন্ন নাগরিক পরিষদে রূপান্তর করা যেতে পারে। এইগুলোকে সাংবিধানিক কর্তৃত্ব দিতে হবে, যাতে তারা সিদ্ধান্ত নিতে; কর্মকর্তাদের তদারকি করতে, এমনকি অকার্যকর বা দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিনিধিদের প্রত্যাহার করতে পারে।
তা ছাড়া প্রস্তাবিত দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদকে আরেকটি অভিজাত আখড়ায় পরিণত হতে দেওয়া যাবে না। বরং উচ্চকক্ষে পেশাদার, শ্রমিক, লিঙ্গ এবং জাতিগত সংগঠনের সমষ্টি দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হওয়া উচিত। এই সংগঠনগুলোকে স্বাধীন, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হতে হবে। প্রত্যাহারের ক্ষমতাও এই ফোরামগুলোর কাছে প্রসারিত করতে হবে, যাতে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষ তাদের প্রতিনিধিদের বৈধতা হারালে বা অসদাচরণ করলে তাদের অপসারণ করতে পারে।

একই সঙ্গে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শ্রম, লিঙ্গ এবং আদিবাসী অধিকারের জন্য স্থায়ী জাতীয় কমিশন গঠন করতে হবে, যেগুলো সরকারের নির্বাহী শাখা থেকে স্বাধীন এবং সংসদ ও নাগরিক সমাবেশ উভয়ের কাছে জবাবদিহি করবে। বিদ্যমান সংস্থাগুলো, যেগুলো প্রায়ই দুর্বল এবং রাজনৈতিকভাবে আপসকৃত, তাদের বিপরীতে এই কমিশনগুলোর প্রকৃত প্রয়োগ ক্ষমতা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসন কাঠামো থাকতে হবে। 
নির্বাচনী সংস্কার কমিশনের গণভোট, প্রত্যাহার প্রক্রিয়া এবং ‘না ভোট’ বিকল্প প্রবর্তনের সুপারিশ একটি পদক্ষেপ। যদি এই সরঞ্জাম অংশগ্রহণমূলক শাসনের একটি বৃহত্তর কাঠামোর মধ্যে সন্নিবেশিত না হয়, তবে তারা রূপান্তরমূলক পরিবর্তনের পরিবর্তে প্রতীকী উদ্যোগ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
কেন এটি এখন গুরুত্বপূর্ণ?

বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখনও অনেকটা অরক্ষিত। এই সমালোচনা বাংলাদেশে গভীরভাবে প্রতিধ্বনিত হয়, যেখানে নির্বাচনী গণতন্ত্র প্রায়ই নাগরিকদের ক্ষমতায়িত করার পরিবর্তে অভিজাত আধিপত্যকে বৈধতা দেয়। তাই সংস্কারগুলো বিমূর্ত আদর্শ নয়, বরং রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা। 
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের অভ্যুত্থানের পর গঠিত এবং একটি ঐতিহাসিক সুযোগের সম্মুখীন। যদি তারা সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যায়; যেখানে রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজজুড়ে একটি জোট গড়ে তোলে, তবে এটি এমন একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারে, যেখানে ক্ষমতা ওপর থেকে নয়, নিচ থেকে উঠে আসে।
এটি করতে সাংবিধানিক সংশোধনী, আইনি সংস্কার এবং রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন। এর জন্য একটি সাংস্কৃতিক পরিবর্তনও প্রয়োজন, যেখানে রাজনীতিকে অভিজাতদের খেলা হিসেবে দেখা থেকে সরে এসে এটিকে সব নাগরিকের দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

আজ বাংলাদেশে ছাত্র, কৃষক, পেশাজীবী এবং মধ্যবিত্তদের কাছ থেকে ‘নতুন কিছু’ আহ্বান ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। সেই নতুন কিছু মানে শুধু নতুন সরকার নয়। বরং নতুন ধরনের রাজনীতি, যেখানে জনগণ দর্শক নয়; সিদ্ধান্ত গ্রহণের অংশীদার।

প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র আমাদের সেই পথ দেখাতে পারে। এটি প্রতিনিধিত্বমূলক কাঠামোকে বাতিল করে না, বরং সেটিকে সম্পূর্ণ করে। 
সরাসরি গণতন্ত্র বাস্তবায়নের অর্থ নির্বাচন পরিত্যাগ নয়। সরাসরি গণতন্ত্র এই অভিজাততন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি গণতান্ত্রিক প্রতিরোধ। এটি নাগরিকদের কেবল ভোটার নয়, রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ গঠনের সক্রিয় অংশীদার করে তুলবে।
যদি আমরা সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক রূপান্তর চাই, তাহলে কেবল অভিজাত গোষ্ঠীর হাত বদল নয়; নাগরিকদের হাতে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ লেখার সুযোগ দিতে হবে। সরাসরি গণতন্ত্র এখন আর বিলাসিতা নয়, বরং গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধারে একান্ত প্রয়োজন।

মির্জা হাসান ও ঐশ্বর্য সংযুক্তা রায় প্রমা: যথাক্রমে জ্যেষ্ঠ ফেলো ও গবেষণা সহযোগী, বিআইজিডি, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
 

আরও পড়ুন

×