ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

অন্যদৃষ্টি

খিয়াং শিশুদের রেহাই দেওয়া যায় না?

খিয়াং শিশুদের রেহাই দেওয়া যায় না?

খিয়াং শিশুদের রেহাই দেওয়া যায় না?

ঞ্যোহ্লা মং

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৩ | ০৬:১৭ | আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২৩ | ১২:৫৫

গত ২৬ নভেম্বর ডেইলি স্টার পত্রিকার শেষের পাতায় বান্দরবান সদর উপজেলার গুংগুরুপাড়ার একটি বড় ছবি প্রকাশ পেয়েছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, হাইকোর্টের নির্দেশে ইটভাটা বন্ধের ঘোষণা-সংবলিত সাইনবোর্ড ঝুলানো থাকলেও চিমনি দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। ১৯৯৩ সালে স্থাপিত গুংগুরুপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দেয়াল ঘেঁষে ২০০৫ সালে ওই ‘এবিসি’ ইটভাটা তৈরি হয়। 
গবেষণাকার্য এলাকা হিসেবে বান্দরবান সদরের ডলু মৌজায় কাজ করার সুযোগ হয়েছিল ২০০২-০৩ সালে। সে সুবাদে ও পরবর্তী সময়েও গুংগুরু খিয়াংপাড়ায় অনেকবার গিয়েছি। গুংগুরু মধ্যক ও আগাপাড়ায় রাত্রিযাপন করেছিলাম বলেও মনে আছে। 

খিয়াংরা জনসংখ্যার বিচারে খুবই ছোট জাতিগোষ্ঠী। এই গোষ্ঠী থেকে এখন পর্যন্ত একজনও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা আছেন বলে শোনা যায় না। সর্বশেষ জনশুমারি অনুসারে খিয়াংরা জনসংখ্যায় মাত্র ৪ হাজার ৮২৬। এই জাতিগোষ্ঠীর যত্ন নেওয়ার বদলে, তাদের অধ্যুষিত এলাকায় তাদের শিশুদের জন্য গড়ে ওঠা স্কুলের সামনে বিশাল পরিসর নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে ইটভাটা।

স্কুলসংলগ্ন এলাকায় ইটভাটা নির্মাণ শুধু এ পাড়াতেই হয়নি। বান্দরবান জেলায় আরও পাঁচটি বিদ্যালয়সংলগ্ন এলাকায় ১১টি ইটভাটা রয়েছে বলে বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিবেদনসূত্রে জানা যাচ্ছে। এমনকি গত ২৭ নভেম্বর একটি পত্রিকায় পড়লাম, বান্দরবান সদরে অভিযানের এক ঘণ্টা পরই ফের চালু হয়েছে একটি ইটভাটা। ইটভাটার মালিকরা কতটা প্রভাবশালী হতে পারেন, এই ঘটনা থেকে আমরা অনুমান করতে পারি। 

আরও জানা যাচ্ছে, বান্দরবান জেলায় মোট ৬৩টি ইটভাটা রয়েছে, যেগুলোর কোনোটিতেই অনুমতিপত্র নেই। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে জেলায় ২১টি ইটভাটা বন্ধের নোটিশ ঝুলানো রয়েছে। কিন্তু শুধু নোটিশ ঝুলিয়ে কি এসব ইটভাটা বন্ধ হবে?

ইটভাটা শুধু স্কুলের পরিবেশ বা শিশুস্বাস্থ্যেরই ক্ষতি করছে না। তাজিংডং ও আরণ্যক ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগের গবেষণামতে, এক দশকে (২০১১-২০) ইটভাটার প্রয়োজনে জ্বালানি হিসেবে কাঠ সংগ্রহ, তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণ, কাঠ আহরণ ও পাচারে সাড়ে চার হাজার একর প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ধ্বংসসহ প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার বনভূমি উজাড় হয়েছে। অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে মাঝেসাঝে অভিযানও চলে বটে। কিন্তু ইটভাটা নয়; দিন দিন কমছে পাহাড়ের সৌন্দর্য, প্রাকৃতিক সম্পদ, পানির উৎস, বন ও পাহাড়। 

২০১৭ সাল থেকে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম এলে পাহাড় ধসে পড়ছে। মানুষ মরছে। রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। দীর্ঘ সময় ধরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকছে। এমন সময়ে কয়েক দিনের জন্য মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে মাত্র। অল্প ক’দিনেই সব আলোচনা থেমে যায়। 

সমাজ ও সভ্যতা নির্মাণের প্রয়োজনে ইট দরকার হয়। সে জন্য নানা ধরনের পরিবেশসম্মত ব্যবস্থাও রয়েছে। তার বদলে পাহাড়, বনজঙ্গল, সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা ধ্বংস করে আরেক অঞ্চলের সভ্যতা নির্মাণ হতে পারে না। সে সভ্যতা টেকসই হতে পারে না। যে ইটভাটার মালিক স্কুল চেনে না; বন, পরিবেশ, ধানের জমি, স্থানীয়দের ক্ষতি উপলব্ধি করতে পারেন না; অনুভব করতে পারে না, সে ইট টেকসই হতে পারে না। 

স্কুলের শিশুদের ক্ষতিগ্রস্ত করে গড়ে ওঠা ইট সভ্যতা নির্মাণের উপাদান হতে পারে না। শুধু পরিবেশ প্রশ্নে নয়; দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্বের প্রয়োজনে তাদের এলাকায় ইটভাটার মতো কর্মকাণ্ডকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। 

ঞ্যোহ্লা মং: উন্নয়নকর্মী
[email protected] 
 

আরও পড়ুন

×