প্রতিবেশী
মিয়ানমারের বিদ্রোহীদের ওপর চীনের প্রভাব

.
থারাপি থান
প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২০২৪ | ২৩:০২
এ বছরের ১২ জানুয়ারি চীন ঘোষণা করে যে, তারা মিয়ানমার সামরিক বাহিনী এবং থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স নামে পরিচিত তিন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতা করেছে। তবে শর্ত হলো, চুক্তিটি কেবল উত্তরের শান রাজ্যের জন্য প্রযোজ্য। এ অঞ্চলে চলমান গৃহযুদ্ধে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের বিরোধীরা সর্বাধিক সাফল্য পেয়েছে। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, গত বছরের ২৭ অক্টোবর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নতুন অপারেশন শুরু করার পর থেকে এই জোট প্রতি তিন দিনে শান রাজ্যের একটি করে শহর দখলে নিয়েছে।
বস্তুত বেইজিংয়ের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত চুক্তির লক্ষ্য হলো মিয়ানমারে অধরা শান্তি আনার চেয়েও চীনের স্বার্থ রক্ষা। কারণ মিয়ানমারের সংঘাত চীনে ছড়িয়ে পড়ার হুমকি সম্পর্কে বেইজিং বেশ উদ্বিগ্ন। মিয়ানমারের অস্থিতিশীল উত্তরাঞ্চল চীনা অপরাধীচক্রের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে, যারা মানুষ ও মাদক পাচার করে এবং সীমান্তের ওপার থেকে অনলাইন অপরাধ সংঘটনে জড়িত। চলমান সংঘাতের ফলে ইতোমধ্যে বাণিজ্যিক পথ অবরুদ্ধ এবং সীমান্ত শহরগুলোতে চীনের নাগরিকদের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়েছে। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সংঘাতে লিপ্ত উভয় পক্ষই ‘মিয়ানমারে বিভিন্ন প্রকল্পে কর্মরত চীনের নাগরিক এবং চীনের সীমান্তে বসবাসরত নাগরিকদের কোনো ধরনের ক্ষতি না করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
তবে যুদ্ধবিরতিতে চীনের এ প্রত্যাশা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা কম। বস্তুত মিয়ানমারজুড়ে ব্যাপক প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে উঠেছে, যাকে জেনারেলরা দমন করতে ব্যর্থ হয়েছে। সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতির পরও সহিংসতা যেমন বন্ধ হয়নি, তেমনি চীনের বিরুদ্ধে হুমকিও রয়ে গেছে। যুদ্ধবিরতি ঘোষণার এক দিন পর থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের এক সদস্য আরাকান আর্মি মিয়ানমারের পশ্চিমে ভারতের সঙ্গে সীমান্তবর্তী শহর পালেতওয়া দখল করে। এদিকে কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মি চীনের তৈরি একটি ফাইটার জেটকে গুলি করে। মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এটি ছিল এমন আক্রমণের তৃতীয় ঘটনা। তা ছাড়া মিয়ানমার সেনাবাহিনী যুদ্ধবিরতি রয়েছে এমন এলাকায় তার একটি বিভাগের সদরদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ হারায়।
মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ যখন বাড়ছে তখন চীন অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়েছে। অতীতে চীন মিয়ানমারের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল। কিন্তু গৃহযুদ্ধে নতুন প্রতিরোধ গোষ্ঠীর উত্থানে দেশটি বেকায়দায় পড়েছে। পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের বেশির ভাগ সদস্যই রাষ্ট্রীয় সেনাদের চেয়ে কম বয়সী এবং বেইজিংয়ের অনুরোধ সত্ত্বেও মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে কোনো চুক্তিতে যেতে তারা রাজি নয়। এই নতুন গ্রুপগুলো মিয়ানমারের সীমানার বাইরেও কৌশলগত ও লজিস্টিক সংযোগ তৈরি করেছে, যাতে তারা অস্ত্র ও অন্যান্য বস্তুর চোরাচালান করতে পারে।
সে জন্য মিয়ানমারের ওপর চীনের প্রভাব সীমিত হয়ে পড়েছে। মিয়ানমারের লড়াইয়ের বেশির ভাগ অংশে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতিরোধ ছড়িয়ে পড়ায় এটি সম্ভব হয়েছে। যে কারণে সংঘাত শেষ করার ক্ষেত্রে চীনের প্রচেষ্টায় সুফল আসেনি।
প্রকৃতপক্ষে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সে যুক্ত জাতিগুলোর মূল লক্ষ্য হলো মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করা। সে জন্য সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তির মাধ্যমে মিয়ানমার সীমান্তের ওপারের চীনের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না। গৃহযুদ্ধের আগেই শান রাজ্যে অপরাধীচক্র মোকাবিলায় সেনাবাহিনী সক্ষমতা দেখাতে পারেনি। ফলে যুদ্ধ ছাড়াও অঞ্চলটি যে চীনের জন্য হুমকি হয়ে উঠবে, এটি তারই ইঙ্গিতবহ। ইতোমধ্যে গৃহযুদ্ধের প্রভাব উত্তর মিয়ানমারের গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে চীনের সম্পর্কেও পড়েছে। সে কারণে মিয়ানমারের জাতিগত প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে বেইজিংয়ের ক্ষমতা সীমিত। তবে বেইজিংয়ের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর না হওয়ার আরেকটি কারণ হলো, সামরিক সরকারকে কোনো সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে বেইজিংয়েরও সীমাবদ্ধতা আছে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ব্যাপারে চীনের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। কারণ, তারা চীনা নাগরিকদের টার্গেট করে, এমন অপরাধী চক্রকে দমন করতে ব্যর্থ হয়েছে। অনলাইন স্ক্যাম পরিচালনা করতে অপরাধীচক্র প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার মানুষকে মিয়ানমারে পাচার করেছে, যাদের বেশির ভাগই চীনা নাগরিক। মিয়ানমারের ব্যাপারে চীনের অবস্থান হলো, ঐতিহ্যগতভাবে যে ক্ষমতায় থাকবে তাকে সমর্থন করা। ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের আগে অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক সরকারের সঙ্গেও বেইজিংয়ের ভালো সম্পর্ক ছিল। তার পর থেকে মিয়ানমারের সীমান্ত শহরগুলোর দুর্নীতি এবং অশাসনযোগ্যতা চীনা নাগরিকদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলেছে। এতে সেনাবাহিনীর প্রতি চীনের বিশ্বাসও ভঙ্গ হয়েছে।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর উত্তর মিয়ানমারে স্থিতিশীলতা আনতে না পারার অর্থ হলো, চীন এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় থাকার কারণে তাদের সঙ্গে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে হবে, কিন্তু তাদের প্রতিরোধ আন্দোলনকে দমন করার অক্ষমতা চীনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
থারাপি থান: সহযোগী অধ্যাপক, বিশ্ব সংস্কৃতি ও ভাষাতত্ত্ব বিভাগ, নর্দান ইলিনয়েস ইউনিভার্সিটি